করোনাকালে প্রকাশনা শিল্প সরকারের বই ক্রয়
- মাছুম বিল্লাহ
- ০১ জুলাই ২০২০, ০৫:৫০
সংবাদপত্রে দেখলাম এবং আমার প্রকাশক একদিন ফোন করে জানালেন, সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ১৫০ কোটি টাকার বই কিনতে যাচ্ছে। সংবাদটি নিশ্চয়ই আনন্দের এবং একটু ভিন্নধর্মী। কারণ সরকারি শিক্ষা বিভাগ এতগুলো টাকার বই কেনা ব্যতিক্রমী ব্যাপার বৈকি! আমাদের দেশে সরকারি স্কুল-কলেজের সংখ্যা খুবই নগণ্য, তবে সেগুলোর প্রতিটিতেই পাঠাগার আছে। সেগুলোর জন্য কখনো কেন্দ্রীয়ভাবে বই কেনা হয়, এ ধরনের খবর কখনো দেখা যায়নি। বেসরকারি স্কুল-কলেজের সংখ্যাই বেশি বাংলাদেশে। সেগুলোতে কিছু কিছু বই স্থানীয়ভাবে ক্রয় করা হয়, স্কুল বা কলেজের কমিটির মর্জি অনুযায়ী কিংবা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের আগ্রহের ওপর নির্ভর করে। যাহোক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর একসাথে এতগুলো বই ক্রয় করবে, তা তো আমাদের দেশে কল্পনাও করা যায় না। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বই কিনবে কেন? জ্ঞানচর্চার প্রতি হঠাৎ এই আগ্রহ কেন, বিষয়টি আমাকে একটু ভাবিয়ে তুলেছে।
কিন্তু তারপরই শুনলাম, বইগুলো কেনা হবে মাত্র কয়েকটি প্রকাশনা থেকে। দ্বিতীয় আরেকটি সংবাদ হচ্ছেÑ এই বইগুলো কেনায় কোনো নিয়ম মানা হবে না। তাই সব কিছু মিলে একটু ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেলাম। আরো পরে জানলাম, বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণার’ তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে বইগুলো দেয়া হবে। বিষয়বস্তু সাধারণত বঙ্গবন্ধুর জীবনকর্ম, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ। এটি নিশ্চয়ই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমাদের শিশুরা বই পড়বে, তাদের জানার জগত বিস্তৃত হবে। কিন্তু নিয়ম না মেনে বই কেনা হচ্ছে কেন? এমনিতেই অনিয়মের শেষ নেই সরকারি অফিস আদালতে। প্রায় সব সরকারি দফতরে জনগণের সেবা শূন্যের কোঠায়। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরি করেন সরকারের, জনগণের সাথে তাদের কোনো লেনদেন নেই। এটি যেন সব সরকারি দফতরের নিয়ম এবং নীতি। কাজ যদি কিছু করতেই হয় তাহলে আপনাকে সরকারের প্রভাবশালী কারো মাধ্যমে যেতে হবে, নয়তো দিতে হবে বড় অঙ্কের ঘুষ।
শিশুদের জন্য বই কেনার ক্ষেত্রেও সেই একই অবস্থা! তাহলে সেই বই পড়ে শিশুরাই বা কী শিখবে আর আমরাই বা বিবেকের কাছে কী জবাব দেবো? শুনেছি, সরকারের জাতীয় গ্রন্থাগার অধিদফতর ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র মিলে প্রতি বছরই নাকি দুই থেকে তিন কোটি টাকার বই কেনে। এসব কেনাকাটার সাথে অনেক দীর্ঘসূত্রতা, ধরাধরিসহ আরো অনেক বিষয় জড়িয়ে থাকে। সবকিছু মিলে সৃজনশীল বইয়ের জগৎ, সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্প অত্যন্ত দুরবস্থার মধ্যে আছে। বাংলাদেশ প্রকাশনা শিল্পের সাথে জড়িত শ’তিনেক প্রকাশক। তারা প্রতি বছর নতুন বই প্রকাশ করে থাকেন, নতুন লেখকদের বই ছাপেন। এই সংখ্যা ১৬ কোটি মানুষের দেশে গড়ে মাত্র হাজার চারেকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ জ্ঞান, জ্ঞানের বিস্তার ইত্যাদি নিয়ে এ দেশে কারো এত চিন্তা-ভাবনা নেই বা থাকার কথাও নয়। বই সবাই পড়তে পারে না, বইয়ের মধ্যে যে ‘মানসিক খাবার’ লুক্কায়িত সেটি সবাই খেতেও জানেন না। অধ্যাপক আবদুল্লøাহ আবু সায়ীদ একবার বলেছিলেন, ‘বই পড়ার পর যে জ্ঞান মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তা মানুষের মনে ছড়িয়ে যায় যা হজম করার ক্ষমতা সবার থাকে না।’ এটি যথার্থই সত্য। আর তাই আমরা দেখি, একটু সচ্ছল হলে দু’জন বন্ধু মিলে আড্ডা দিতে দিতে বার্গার কফি কিংবা কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে আট শ’ থেকে এক হাজার টাকা খরচ করে ফেলেন, তদুপরি ওয়েটারের হাতে ৫০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে দিব্যি চলে আসেন। তারা একটি বিকেল এভাবে কাটিয়ে দেন। কিন্তু মাত্র ২০০ বা ৩০০ টাকা দিয়ে একটি বই হয়তো সারা বছরই কেনা হয় না।
জানা গেছে, এবার বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে চিঠি দিয়েছে, নির্বাচিত প্রতিটি বই ৬৫ হাজার কপি করে ক্রয়ের-প্রক্রিয়া বাতিলের আবেদন করেছে। সৃজনশীল প্রকাশকদের কাছে উপযুক্ত বইয়ের তালিকা ও নমুনা কপি আহ্বানের মাধ্যমে বাছাই কমিটি কর্তৃক বই নির্বাচন করে দ্রুত ক্রয়-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তারা অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। সৃজনশীল প্রকাশকরা দাবি করেছেন, ৩০০ প্রকাশকের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকার বই কিনলে কমপক্ষে ৬০০ থেকে দ্্ুই হাজার আইটেমের কয়েক হাজার কপি করে বই কেনা সম্ভব। এটি করা হলে ৩০০ প্রকাশক মোটামুটি সমানুপাতিক হারে বই সরবরাহ করতেন এবং বেঁচে যেতেন সৃজনশীল প্রকাশকরা, স্বস্তি পেতেন তাদের পরিবার পরিজন এই দুর্বিষহ সময়ে। প্রকাশকদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখিত বই ক্রয় করলে একদিকে যেমন ভালো বইগুলো সংগ্রহ করা যেত, অন্যদিকে প্রকাশকরা বেঁচে যেতেন, সাথে কিছু লেখকও রয়্যালটি পেতেন; যেটি এই প্রকাশনা শিল্পে একটি বিরল ঘটনা শুধু দু-চারজনের ক্ষেত্রে এটি ঘটে থাকে। বলা যায়, পেশাদারিত্ব বাংলাদেশের এই শিল্পে একেবারেই গড়ে ওঠেনি।
এই পেশাদারিত্ব গড়ে না ওঠার পেছনে সবাই কমবেশি দায়ী। সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পের সাথে যারা জড়িত, তাদের ভেতর দেখা যায়, যারা টাকা দিয়ে বই ছাপান তারা তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। ‘নগদ কিছু’ পাওয়ার জন্য তাদের বই ছাপিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সেই বই পাঠক পড়বেন কি না তা নিয়ে তারা চিন্তা করেন না। তা ছাড়া যে বই পাঠকের হৃদয়কে সমৃদ্ধ করবে না বা করে না, পাঠককে আনন্দ দেবে না, নতুন তেমন কিছু দেবে না সে ধরনের বই তারা কেন আগেভাগে ছাপেন সেটি একটি আশ্চর্যজনক বিষয়। যে বই পাঠকের হৃদয়কে নাড়া দেয়, যে বই পাঠক চান বা বইয়ের কন্টেন্ট দেখতে চাইবেন, শিক্ষার্থীদের, শিক্ষকদের, অন্য অনেক পেশার লোকদের কাজে লাগবে যা, সেই বই তারা ফেলে রাখেন, খোঁজ রাখেন না। অনেকে খোঁজেন টাকা দিয়ে কারা বই ছাপাবেন সে ধরনের লেখকদের। এটি আমাদের প্রকাশনা শিল্পের একটি অন্ধকার দিক। এই শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদের দায়িত্ব তো শুধু একুশে ফেব্রুয়ারির মেলায় একটি স্টল দিয়ে নতুন কিছু বই টাকা দিয়ে ছেপে তাদের মাধ্যমে কিছু ‘জোরপূর্বক বিক্রি করা’ নয়। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, পাঠকদের কাছে ভালো বই পৌঁছে দেয়া, নতুন পাঠক সৃষ্টি করা। একজন পাঠক যখন অপাঙ্ক্তেয় কোনো বই হাতে পেয়ে পড়েন, তখন তার বই পড়ার স্বাদ নষ্ট করে দেয়া হয়। তার তখন ‘ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়’ অবস্থা হয়। তার রুচি দীর্ঘ দিনের জন্য কিংবা সারা জীবনের জন্য নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। এটি তো সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পের করার কথা নয়। নিজে দেখেছি, যেসব লেখা শিক্ষাবিষয়ক এবং যা শিক্ষার্থী, শিক্ষক, যারা শিক্ষক হবেন, সমাজ নিয়ে যারা ভাবেন তাদের নিয়ে লেখা ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত, সে লেখাগুলোর সমৃদ্ধ ও প্রসারিত কপি দিয়ে বই করার জন্য যখন প্রকাশকদের বলা হয়, তখন তারা নেন। কিন্তু রেখে দেন একেবারের শেষের সারিতে। বইমেলা শেষ হয় তখনো তারা ছাপেন না, ‘ছাপি ছাপছি’ করে দু-এক বছর একেবারেই ছাপেন না। যারা টাকা দিয়েছে তাদেরটা ছাপেন বলে অনেকের অভিযোগ।
পাঠকদের রুচি নষ্ট না হওয়া কিংবা পাঠকদের কাছে ভালো কিছু পৌঁছানো এ বিষয়টি না ঘটলে প্রকাশনা শিল্পে দুর্দিন তো থাকবেই। সবাই তো হুমায়ূন আহমেদ নন, কিংবা মুহাম্মদ জাফর ইকবাল নন। তাদের একটি বই নেয়ার জন্যও প্রকাশকরা হন্যে হয়ে খোঁজেন, বহু ধরাধরি করেন। কিন্তু নতুন লেখক বানাতে হবে। নতুন ভালো লেখকদের চিন্তার জগতকে প্রসারিত সমৃদ্ধ করার জন্য যে প্রচেষ্টা, যে সহযোগিতা প্রয়োজন তা প্রকাশকরা করেন না। প্রকাশনা শিল্পের দুর্দশার জন্য শুধু পাঠক কিংবা সরকার দায়ী নয়, কমবেশি সবাই দায়ী।
শুনে অবাক হয়েছি, দু-চারটি ছাড়া প্রায় কোনো প্রকাশকের জেলা পর্যায়ে কোনো প্রতিনিধি নেই, কোনো বইয়ের দোকানের সাথে তাদের যোগাযোগ নেই। দেশের ৬৪টি জেলায় যদি কোনো প্রকাশকের পরিচিত একটি করেও দোকান থাকে আর ঢাকা থেকে ১০টি করে বই পাঠানো হয়, তাহলে ৬৪০টি বই চলে গেল। প্রতিটি জেলায় গড়ে ১৪টি উপজেলা আছে। ৪৮৫টি উপজেলায় যদি পাঁচটি করে বইও যায়, তাহলে কত হাজার বই বিক্রি হলো। একজন প্রকাশকের প্রতিটি জেলায় বা উপজেলায় নিজের দোকান থাকতে হবে এমন নয়, অথবা বেতনভোগী কর্মী রেখে দিতে হবে এমনও নয়। একটু ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থাপনা, বইয়ের বড় বড় দোকানদারের সাথে এক ধরনের যোগাযোগ রক্ষা করা প্রয়োজন। সেটি তারা করেন না। তাদের ধারণা, একুশে বইমেলায় সবাই তাদের কাছে এসেই বই কিনবেন। না হয় লেখককে জোর করে ধরিয়ে দেবেন বই বিক্রি করতে। বই প্রকাশ ও বিপণন তো আলাদা স্কিল, আলাদা দক্ষতা, আলাদা বিষয়। লেখকদের তো সেই ধরনের দক্ষতা থাকার কথা নয়, থাকবে না। তারা চিন্তার জগতে, ভাবনার জগতে থাকেন। এই কাজগুলো প্রকাশকেরই।
তাই সবার প্রকাশক হওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে যারা শুধু ব্যবসার মানসিকতা নিয়ে এই পেশায় আসেন। ব্যবসা তারা অবশ্যই করবেন। কিন্তু সেটি মানসম্মত বই না ছেপে অর্থের সাময়িক লোভে নিম্নমানের বইকে অগ্রাধিকার দিয়ে নয়। পাঠক সৃষ্টি করা, বইয়ের বাজার প্রসারিত করার মুখ্য দায়িত্ব তাদেরই।
এসব প্রকাশক করেন না বলেই সরকারি কোনো বই কেনার কথা এলে তারা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। শুরু হয় কে কাকে পেছনে ফেলে সামনে আগাবেন। আর সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে শুরু হয় অসৎ লেনদেন। এভাবে দেশের সর্বত্রই যদি দুর্নীতি থাকে তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? লেখকরা যাবেন কোথায়? অসৎ উপায়েই যদি এসব করতে হয়, তাহলে বইয়ের মতো মহান বস্তুর কারবার না করাই ভালো। অন্য বহু ব্যবসা আছে। সেগুলোর দিকে হাত বাড়ানো যেতে পারে। বই শিল্প, প্রকাশনা শিল্প তো সাধারণ কোনো ব্যবসা নয়, এটি জ্ঞানের জগৎ, এটি আলাদা জগৎ, আলাদা পেশা। সেটি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। আমরা চাই এই পেশায় পুরো পেশাদারিত্ব সৃষ্টি হোক, তাহলে পাঠকও বাড়বে, প্রকাশকদের ব্যবসারও প্রসার ঘটবে। তখন আর দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তাদের পেছনে ছুটতে হবে না, ঘুষ দিয়ে বই বিক্রির কথা চিন্তা করতে হবে না।
লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত এবং সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যিালয় শিক্ষক
masumbillah65@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা