২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

যেন ডেঙ্গুকে ভুলে না যাই

যেন ডেঙ্গুকে ভুলে না যাই - সংগৃহীত

চোখে দেখা যায় না, এ ধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু, ভয়ানক ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের কোভিড-১৯ আক্রমণে সমগ্র বিশ^ স্তম্ভিত, উদ্বিগ্ন, বিচ্ছিন্ন ও স্থবির। করোনার সর্বগ্রাসী বিস্তার, সংক্রমণ ও শক্তি মনুষ্যসৃষ্ট যেকোনো মারণাস্ত্রকে হার মানিয়ে বিশে^র প্রায় প্রতিটি দেশ, জাতি, জনপদ ও মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাস মিউটেশনে রূপ বদলায় এবং পরিবেশ পেলে বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। এতে রূপান্তরিত জিনের অংশ থাকায় সুপ্ত প্রোটিন সতেজ করতে ভাইরাসকে শরীরে ঢুকতে হয়। ফিউরিন নামক এনজাইম সুপ্ত প্রোটিনকে সতেজ করে তোলে। ভাইরাস ফিউরিনকে আক্রমণ করে প্রোটিনকে সতেজ করে। এই ক্রিয়া ও প্রক্রিয়ায় ভাইরাস ও মানবকোষের সংমিশ্রণ ঘটে এবং রোগের বিস্তার ঘটে। রোগটি যে কত বিধ্বংসী, তা বিশ^ব্যাপী মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে গত ৩১ ডিসেম্বর করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছে। তার পর এ পর্যন্ত (২৬ মার্চ, ২০২০) বিশে^র ১৯৮টি দেশে চার লাখ ৭১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত এবং ২১ হাজার ২৯০ জনেও বেশি মৃত্যুবরণ করেছে। সংক্রমণের কেন্দ্র চীনে করোনাআক্রান্ত ৮১ হাজার ২৮৫ জন এবং তার মধ্যে মোট ৬৭ হাজার ৮০০ জনের অধিক চীনের উহান শহরের, যেখানে প্রথম ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়েছিল। সেই শহরে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে মাত্র একজন ছাড়া আর কোনো নতুন সংক্রমণ হয়নি বলে চীন দাবি করেছে। ঘটনার সূত্রপাতের সাথে সাথেই প্রথমে উহান শহরকে এবং পরে হুবেই প্রদেশকে অবরুদ্ধ করে পুরো চীনকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছিল। আর তা সম্ভব হয়েছিল চীনের কর্তৃত্ববাদী চরিত্র, সুদূরপ্রসারী চিন্তা, কঠোর পরিশ্রম ও বিপুল সম্পদ বিনিয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু চীন থেকে মধ্যে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিশ^ দিশাহীন এক গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত। চীনের বাইরে স্পেন, ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় সংক্রমণের ব্যাপ্তি ও ভয়াবহতা অত্যধিক উদ্বেগজনক। ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণের ভয়াবহতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাস নামক অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবেলা করার জন্য ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছেন। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা সব চেষ্টা করেছি, আমরা ব্যর্থ, এখন বাকিটা আকাশে যিনি বসে আছেন, উনার হাতে।’ বুঝতে কষ্ট হয় না, ইতালিতে করোনার নিয়ন্ত্রণ তাদের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, তা এখন দেখার অপেক্ষায়। এসব পরাশক্তি, উন্নত ও সম্পদশালী দেশ যদি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এত বেশি অসহায় হয় তা হলে বাংলাদেশের জনগণের জন্য তো স্বাভাবিকভাবেই নিদারুণ দুশ্চিন্তার বিষয়।

চীনের সাথে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক যোগাযোগ এবং ভৌগোলিকভাবে অদূরবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের করোনাভাইরাস সম্পর্কে উদাসীনতা, নীরবতা ও দায়িত্ববোধহীনতা ক্ষমার অযোগ্য। চীনে করোনাভাইরাস চিহ্নিত হওয়া আর সংক্রমণের বিস্তার দেখে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এ বিষয়ে আগেই সব দেশকে সতর্ক করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কোনো কর্ণপাত করেনি। ১ ফেব্রুয়ারি চীনের উহান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার পর কোয়ারেন্টিন পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও ঘাটতি প্রকাশিত হওয়ার পরও সরকার সেগুলো কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সরকার এতই উদাসীন ছিল যে, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খোলা রেখেছিল ঢাকা-কুনমিং আকাশপথ। টেস্টিংয়ের পরীক্ষাগার, কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল প্রস্তুত করার কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। ৩ মার্চ করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দিশাহীন বিশ্ব এবং চীনসহ ৭৫টি দেশে ৯১ হাজার আক্রান্ত ও বিশে^ তিন সহস্রাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। তখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ১০০ বছরে একবার আমরা পাবো। যেহেতু দেশে একজনও করোনা রোগী পাওয়া যায়নি, কাজেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের কোনো অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে না।’ এর পর থেকেই জনগণের মধ্যে গুঞ্জন উঠে যে, মুজিববর্ষের মূল অনুষ্ঠান ১৭ মার্চ পালনের জন্য করোনা মহামারী সম্পর্কে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই তথ্য গোপন করেছে এবং বিমান চলাচল বন্ধ করাসহ দৃশ্যত প্রস্তুতি গ্রহণে সময়োপযোগী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

করোনা মহামারী সম্পর্কে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর লাগামহীন বক্তব্যের ফলে জনমনে অবিশ^াস ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই জনগণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট থেকে বঞ্চিত হয়ে সরকারের প্রতি চরমভাবে ক্ষুব্ধ। করোনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘করোনা যত বড় শক্ত হোক, আমরা তার চেয়েও শক্তিশালী’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন বলেছেন, ‘করোনা বিধ্বংসী রোগ নয়; ফ্লু ও জ্বরের মতো’। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বেশি প্রস্তুত।’ নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ চৌধুরী জনগণকে আরো আশ^স্ত করেছেন, ‘দেশে শেখ হাসিনা থাকতে করোনাভাইরাস আমাদের কিছুই করতে পারবে না।’ স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রামক ব্যাধি, তবে বিধ্বংসী নয়।’ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষ যখন বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের তাণ্ডব ও শক্তি দেখছে, তখন এ দেশের মন্ত্রীদের দায়িত্বহীন ও অসার বক্তব্য জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রথম ঘুম ভাঙে ৭ মার্চ, ২০২০। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা: মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘বাংলাদেশ যেকোনো সময় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে।’ তত দিনে সারা বিশে^ করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি। ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস গেব্রেয়াসুস জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে ভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা উদ্বেগজনক বলে বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দল বিএনপির করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এবং সরকারের উদাসীনতার সমালোচনা করে সংবাদ সম্মেলন করেছে। ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাদের দলীয় কার্যালয়ে এক সভায়, করোনা নিয়ে ‘বিএনপি নোংরা রাজনীতি করছে’ বলে মন্তব্য করেন। বিশ^ যখন দল-মত-গোষ্ঠী নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে করোনা মোকাবেলা করছে, তখন শাসকদলীয় সাধারণ সম্পাদকের এহেন মন্তব্য নিদারুণ দুর্ভাগ্যজনক।

করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের বিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ দুঃখজনক। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই ভাইরাস মোকাবেলায় নমুনা পরীক্ষা (টেস্ট) করার মতো মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান ‘আইইসিডিআর’কে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করার জন্য সরঞ্জাম (কিট) ‘এক হাজার ৭৩২টি মজুদ আছে’ বলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে। ফলে এই একটিমাত্র কেন্দ্রে সীমিতভাবে পরীক্ষা করার কাজ চলছে। ভিড় এড়ানোর জন্য ‘আইইসিডিআর’ হটলাইনে টেলিফোন করে রোগী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে। গত ২২ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী আশ^াস দিয়েছেন, সারা দেশে আরো আটটি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে এবং তার জন্য ১০ থেকে ১২ দিন সময় লাগবে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। বিভিন্ন আক্রান্ত দেশ এই পরীক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়ন করছে। অবিশ্বাস্য বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য মাত্র একটি পরীক্ষা কেন্দ্র। সেখানে দিনে গড়ে ২৫-৩০ জন রোগীর বেশি নমুনা পরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় আড়াই মাস সময় পাওয়ার পরও দেশে পর্যাপ্ত মানসম্মত পরীক্ষাগার প্রস্তুত এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় কিট কেন আমদানি করা হলো না, তার জবাব কে দেবে? টেস্টের পরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কোয়ারেন্টিনের কার্যকর পদক্ষেপ। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী আকার ধারণ করার পরও আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দর খোলা রাখা হয়েছিল। এ সময়কালে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ প্রবাসী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিগত ১৫ দিনে এসেছেন এক লাখ ৭০ হাজারের বেশি এবং পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ৪৬৯ জনকে। কোয়ারেন্টিনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে চরম ব্যর্থতা ও গাফিলতি। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের গাফিলতি, ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতার জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের এবং মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। রোগী পরীক্ষার জন্য শুধু একটি কেন্দ্রে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী পরীক্ষা করে যে তথ্য দেয়া হচ্ছে, তা অসম্পূর্ণ ও অনির্ভরযোগ্য। যে বিশাল জনগোষ্ঠী এ পরীক্ষার বাইরে তাদের মধ্যে কতজন সংক্রমিত রোগী আছে আর কতজন মারা যাচ্ছে সে হিসাব কেউ দিতে পারবে না। আরো দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, বিদেশফেরত ব্যক্তি ছাড়াও বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই এ ধরনের ব্যক্তিরাও ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছে। ২২ মার্চ সরকারের দেয়া হিসাব মোতাবেক যে ২৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১০ জন বিদেশফেরত এবং ১৩ জন বিদেশফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন। অবশিষ্ট চারজন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি। অতএব, বিধ্বংসী করোনাভাইরাস যে সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে তা স্পষ্ট। ২৬ মার্চ সর্বশেষ আইইসিডিআর পরিবেশিত অর্থাৎ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সর্বমোট ৩৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। মৃত্যুবরণ করেছে মোট পাঁচজন, আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে সাতজন। সরকারি এ তথ্য সম্পর্কে বিভিন্ন মহলে সন্দেহ রয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশে আইইসিডিআর ছাড়া করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার দ্বিতীয় কোনো স্থান নেই।

চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া করোনাভাইরাস সংক্রমণকে মোটামুটি সামলে নিতে পেরেছে, অবরুদ্ধ (খড়পশফড়হি) করা এবং দ্রুত পরীক্ষা পরিচালনার মাধ্যমে। পশ্চিমা দেশগুলো একই পথে হাঁটছে। গত ২৪ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের ১৩৮ কোটি মানুষের দেশ ২১ দিনের জন্য বন্ধ (খড়পশফড়হি) ঘোষণা করেছেন। ইতালিতে করোনাভাইরাসের তাণ্ডব চলছে। বিশেষজ্ঞরা করোনা সম্পর্কে ইতালির দীর্ঘ নীরবতা, উদাসীনতা ও অবজ্ঞা করাকে দায়ী করেছেন এ জন্য। ইতালিসহ বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের পিছে নয়, সামনে ছুটতে হবে। যারা এই উপলব্ধিতে পিছিয়ে পড়েছে তারাই এর খেসারত দিচ্ছে।

বাংলাদেশে অপ্রতুল টেস্ট (পরীক্ষা) ব্যবস্থার মধ্যেও যারা রোগী হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন বা হবেন তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল প্রস্তুত হয়নি। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (চবৎংড়হধষ চৎড়ঃবপঃরড়হ ঊয়ঁরঢ়সবহঃ-চচঊ) পর্যাপ্ত আমদানি করা হয়নি। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার সময় চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সংক্রমিত হওয়ায় তাদের অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। চীনের উহান শহরে প্রথম যে চিকিৎসক করোনাভাইরাস শনাক্ত করেছিলেন, তিনিও আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াও ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় নিবিড় পরিচর্র্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং ভেন্টিলেশন মেশিন অপ্রতুল। বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে এসব সুবিধা নেই, এসব সুবিধা সৃষ্টির কোনো পদক্ষেপও নেই।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সারা বিশ^সহ বাংলাদেশ বন্ধ হয়ে গেছে এবং তার মোকাবেলায় পুরো জাতি এখন যুদ্ধে লিপ্ত। তখন বাংলাদেশে আরেকটি মরণব্যাধি ‘ডেঙ্গু’ দরজায় কড়া নাড়ছে। সাধারণত মে-জুন মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে এডিস মশার জন্মের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। যেসব এলাকায় ডেঙ্গুবাহক এডিস মশা একবার বিস্তার লাভ করে, সে এলাকায় এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এডিস মশার ডিম শুকনো পরিবেশে ৯ মাস পর্যন্ত নষ্ট হয় না। যখনই বৃষ্টির পানির সংস্পর্শে যাবে, তখন তা লার্ভায় পরিণত হয় এবং পরিপূর্ণ মশার জন্ম দেয়। উদ্বেগের বিষয়, গত বছর সরকারি হিসাবে এ দেশে ডেঙ্গু জ¦র নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ এবং মৃত্যুবরণ করেছিল ২৪৮ জন। পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃত ভর্তির ও মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশি। ১৯৯৬ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হওয়ার পর ২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের ও মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ, যা ২০১৮ সালের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ। গত বছরে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে সারা দেশে। এমতাবস্থায় গত বছরের ডেঙ্গু প্রকোপের ভয়াবহতা (মহামারী) থেকেই এ বছরের সতর্কবার্তা বিদ্যমান। গত বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতার কারণে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করেছিল। ডেঙ্গুকে প্রতিরোধ করতে এডিস মশাকে নিধন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই মার্চ-এপ্রিল মাসেই (বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে) ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং সারা দেশে পৌরসভাগুলোকে এ জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে এবং কার্যকর ওষুধ ছিটিয়ে এডিস মশার ডিম ধ্বংস করার এখনই সময়। তা না হলে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

গত বছরে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নির্মূলে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার কারণ এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য বিগত ২২ নভেম্বর, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ ঢাকা জেলা জজের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। কমিটিকে ভবিষ্যতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে সুপারিশমালা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। এ কমিটিকে ১৫ জানুয়ারি, ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত তারিখে প্রতিবেদন দাখিলে ব্যর্থ হলে তাদের আরো দুই মাস সময় বৃদ্ধি করা হয়। তবে ১৫ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন পেলেও তাদের সুপারিশ মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের আর সময় অবশিষ্ট থাকে না। ইতোমধ্যে চলতি বছরের পয়লা জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুরোধে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৪১ জন। গত বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৫৬ জন। বিগত বছরের চেয়ে এ বছরে রোগীর সংখ্যা প্রায় চার গুণেরও বেশি। অর্থাৎ এ বছর ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ গত বছরের চেয়ে আরো ভয়াবহ হতে পারে। এ পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে এখনই সারা দেশে ডেঙ্গু মশার সম্ভাব্য প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে।

উদ্ভূত এই কঠিন পরিস্থিতিতে দেশের সব জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিলম্বে হলেও সরকারকে তাদের দম্ভ, অহঙ্কার ও প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করা জরুরি। জাতীয় দুর্যোগ বিবেচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জনগণকে আস্থায় নিয়ে করোনাভাইরাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানো উচিত। অন্যান্য দেশের মতো এই অদৃশ্য শক্তির মোকাবেলায় সব জনগণকে সাথে নিয়ে দৃঢ়তা ও সাহসের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। সারা দেশে সর্বাত্মকভাবে ভাইরাস পরীক্ষা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা এবং উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রস্তুত করাসহ সব কার্যক্রম সমন্বিতভাবে জোরদার করতে হবে। ডেঙ্গুর সম্ভাব্য ভয়াবহ প্রকোপ থেকে দেশের জনগণকে রক্ষা করতে এখনই এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস এবং ডেঙ্গু রোগ চিহ্নিত করার পর্যাপ্ত পরীক্ষার কিট আমদানি করা অত্যাবশ্যক। ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পৃথক ইউনিট প্রস্তুত করার আগাম কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিধ্বংসী করোনাভাইরাস এবং সম্ভাব্য ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে জনগণকে সুরক্ষা করা সহজ হবে না। আগাম প্রস্তুতি ও দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণকে সাথে নিয়ে এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সফলতা লাভ করার কোনো বিকল্প নেই। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হবেন।

লেখক : সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি-বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement