২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দিল্লি পুড়ছিল অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো রেখেছিল মুখ ঘুরিয়ে

-

শিশুরা ভীতিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, দিশাহারা মায়েরা নোটবুক ও ক্যামেরাওয়ালা লোকজনের সামনে বিলাপ আর আহাজারি করছেন। মেহনতি যে মানুষগুলো গর্ববোধ করতে পারতেন, তাদের বাধ্য করা হয়েছে বহিরাগতদের দানদক্ষিণার ওপর নির্ভর করতে। ওরা দয়াবশত নিজেদের বাড়ির দুয়ার খুলে দিয়েছে এই মানুষগুলোর জন্য। কারণ, রাষ্ট্র তাদের জন্য নিরাপদ স্থান তৈরি করতে রাজি নয়। বিভীষিকা কমছে না। বাবারা মর্গে খুঁজে বেড়াচ্ছেন হারানো ছেলের লাশ; মায়েরা অপেক্ষা করছেন আতঙ্কের সাথে। পুঁতিগন্ধময় নালা-নর্দমা থেকে মৃতদেহগুলো টেনে তোলা হচ্ছে।

দেশের সরকারের প্রতি নাগরিকদের এত কম আস্থা কোনো সময় দেখিনি। গায়ে গুলির ক্ষত বয়ে কিংবা অনেক ভাঙা হাড় নিয়ে মুসলমানরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার বদলে তারা বরং মৃত্যুকে বরণ করে নেবেন। কারণ, এসব হাসপাতালে তারা তাদের প্রতি ঘৃণা ও অবহেলাই আশা করতে পারেন। যেসব কর্মকর্তা মৃত্যু ও সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ ফরম পূরণ করছেন, সহিংসতার শিকার হওয়া লোকজন তাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। কারণ, তাদের সন্দেহ, এসব কর্মকর্তা গোপনে পূরণ করছেন ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার (এনপিআর) ফরম যা তাদের নাগরিকত্ব হরণ করে নেবে।

রাজনৈতিক শ্রেণীর ব্যর্থতা
হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে যারা বেঁচে গেছেন, ভাগ্যহত সে মানুষেরা ব্যাপকভাবে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন অনেকের দ্বারা। এ ক্ষেত্রে সবার আগে বলতে হয় প্রায় পুরো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কথা। ক্ষমতাসীন মহল গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অপরাধ করেছে ঘৃণায় উসকানি এবং সহিংসতার জ্বালানির জোগান দিয়ে। ক্ষমতার শীর্ষ থেকে বিষাক্ত ঘৃণা ছড়ানো ভাষণ দিয়ে তা করা হলো। ওদের ‘রাজনৈতিক প্রকল্প’টি হচ্ছে, সব ধরনের প্রতিরোধকেই নির্মূল করে দেয়া। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, দেশজুড়ে জনগণের ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে অভূতপূর্ব ঐক্য ও সংহতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অপর দিকে, সাম্প্রদায়িক নরহত্যার ঘটনা যেন ছিল অপেক্ষমাণ। ক্ষমতার বাইরের যে রাজনৈতিক শক্তি, তারা এর প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিতে পারত। কিন্তু এই মহল এমন কিছুই করেনি। মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক দৃঢ়তা নেই। নেই তাদের নৈতিক সাহসও। ময়দানে সহিংসতা রোধের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাডারের অভাবও রয়েছে।

জম্মু ও কাশ্মিরের বাইরে, কোনো প্রদেশ কিংবা ইউনিয়ন টেরিটরিতে দিল্লির মতো এত বেশি পুলিশ নেই। এই পুলিশের ইচ্ছা থাকলে, তারা দিল্লির এবারের সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারত; কিংবা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এটাকে ঠাণ্ডা করে দেয়া সম্ভব ছিল। ভীতিপ্রদ নিরেট বাস্তবতা হলো, দিল্লির বুকে সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ ঘটতে পেরেছে; কারণ আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তা চেয়েছেন এবং পুলিশ এর পথ করে দিয়েছে। দিল্লিতে যত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে, এর ক্ষুদ্র একটি অংশ তৎপর হলেও অল্প কয়েক ঘণ্টার বেশি কোনো দাঙ্গা চলতে পারে না, যে পর্যন্ত না রাষ্ট্র তা কামনা করে।

পুলিশের ভূমিকা
এই নিধনযজ্ঞে পুলিশের ভূমিকার অনেক চিত্র আছে যেগুলো আমাদের বিবেকের তিক্ত বা বেদনাদায়ক স্মৃতি হয়ে দীর্ঘদিন থাকা উচিত। সহিংসতার শিকার হাজার হাজার মানুষ তাদের উদ্ধারের জন্য মরিয়া হয়ে পুলিশকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ কোনো সাড়া দেয়নি। অথচ তখন মানুষকে জবাই করা হচ্ছিল আর ঘরবাড়িতে দেয়া হচ্ছিল আগুন। এমনকি, সহিংসতায় আহতদের হাসপাতালে নেয়ার সময় পুলিশ এ কাজটা নিরাপদে করার ব্যাপারে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। অথচ যুদ্ধের সময় পরস্পর শত্রু দেশের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে না। এমনকি, পুলিশ দিল্লিতে একজন আহত ব্যক্তিকে চারটি চেকপোস্টে চারবার বাধ্য করেছে তার ক্ষতস্থানের ব্যান্ডেজ খুলে দেখানোর জন্য। মানুষটা আসলেই আহত কিনা, এটা জানার জন্যই নাকি এই কাজ করা হয়েছে! মধ্যরাতের নির্দেশে দিল্লি হাইকোর্ট পুলিশকে বলেছেন সহিংসতায় আহত ব্যক্তিদের নিরাপদ পরিবহন এবং জরুরি সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে। তার পরেও উল্লিখিত ঘটনা ঘটেছে। উচ্ছৃঙ্খল লোকজন একটি ধর্মের অনুসারীদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে যখন তাণ্ডব চালাচ্ছিল, তখন পুলিশ এসব দেখছিল নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কখনো কখনো কয়েকজন পুলিশ নিজেরাই সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে। এক জায়গায় দাঙ্গারোধের জন্য সুসজ্জিত পুলিশের দল নিরস্ত্র মুসলমানদের একটি গ্রুপকে হয়রানি করেছে। পুলিশ তাদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করেছে এবং লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে। জাতীয় সঙ্গীত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তাই এই পুলিশরা প্রতিবাদের কারণে শাস্তি দিচ্ছিল। পুলিশের নির্যাতনে এই মানুষগুলোর একজন মারা গেছেন। এখন জাতীয় সঙ্গীত আমার কাছে নিছক ভালোবাসার গান নয়; বেদনারও বাহন।

দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলিধর (যাকে এরপর বদলি করে দেয়া হলো) মধ্যরাতে আদেশ দিয়েছিলেন যেন অ্যাম্বুলেন্সগুলো নিরাপদে চলাচল করতে পারে। তিনি আরো নির্দেশ দেন যাতে ঘৃণাত্মক বক্তৃতার দায়ে বিজেপির সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে মামলা করার বিষয়ে বিবেচনা করা হয়। এ ঘটনা প্রমাণ করে, বিবেক থাকলে সাংবিধানিক আদালত এমন পরিস্থিতিতে কী ভূমিকা পালন করতে পারে।

আমাদের নাগরিক গ্রুপ একটি কন্ট্রোল রুম চালু করেছিল যা সপ্তাহের প্রতিদিনই ২৪ ঘণ্টা খোলা। বিপন্ন যে কারো ফোন পেয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এটা করা হয়েছে। সহিংসতার সময় রাত যত গভীর হয়েছে, ততই মানুষ মরিয়া হয়ে ফোন করেছে। অথচ পুলিশ ততই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা রেখেছে যা একটা অপরাধ। একটি ছোট বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২২ ব্যক্তি সহিংসতায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। তাদের দ্রুত বড় হাসপাতালে স্থানান্তর করা জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল জনতা এতে বাধা দিয়েছে এবং পুলিশ এই রোগীদের সুরক্ষা দিতে অস্বীকার করেছে। এ অবস্থায় তাদের দু’জন মৃত্যুবরণ করেছেন। মাঝরাতে বিচারকের দরজায় ধাক্কা দিয়ে নিশ্চিত করতে হলো অন্যদের জীবন বাঁচানোর বিষয়। সেই সাথে, আরো অনেকের প্রাণ রক্ষা পায় সে রাতে। পরদিন এই বিচারক পুলিশকে ২৪ ঘণ্টা সময় দেন যাতে ঘৃণার উসকানিদাতা সবাইকে গ্রেফতার করার বিষয়টি দেখা হয়। কিন্তু, তার বদলে আরেক বিচারক আসার পরে এই জরুরি নির্দেশ হাওয়া হয়ে গেছে।
চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের চরম সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সাক্ষ্য প্রমাণ গায়েব করে দেয়া হয়েছে খেয়াল খুশি মাফিক। এই প্রেক্ষাপটে পুরো চিকিৎসক সমাজকে ভাবতে হবে- যে পেশা পরিচর্যা ও আরোগ্যের, তাতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিষ ঢোকানোর মতো উদ্বেগজনক ঘটনা কিভাবে ঘটতে পারে?

কোথাও নেই তারা
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন এবং শিশু অধিকার রক্ষার জাতীয় কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে আমরা প্রায় ভুলেই গেছি। যখন অসহায় সংখ্যালঘুরা নির্বাহী বিভাগের হাতে বৈষম্য আর সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন, তখন এসব প্রতিষ্ঠানের মাঠে নামাই দায়িত্ব। কিন্তু এবার যখন দিল্লি পুড়ছিল আর মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছিল, তখন এদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দিল্লির রাজ্য সরকারের করা উচিত ছিল বহুকিছু। দাঙ্গার পয়লা রাত থেকেই রাজ্য সরকার মানুষকে উদ্ধার করার জন্য কন্ট্রোল রুম চালু করে তা পরিচালনা করা উচিত ছিল। প্রয়োজন ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের সবকিছু এক করে আহতদের জন্য সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিত করা। মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে রাতারাতি বড় বড় রিলিফ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করাও দরকার ছিল বৈকি।

দুঃস্বপ্নতুল্য অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রিয়জনদের হারানো, বাড়ি-ব্যবসায় এবং সারা জীবনের যাবতীয় সঞ্চয় ও সম্পদ শেষ হয়ে যাওয়া মানুষকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। যদি জানা যায়, যাদের দায়িত্ব হলো আপনাকে রক্ষা করা, তারাই সহিংসতাকে সম্ভব করে দিয়েছে এবং আরো যদি জানতে পারেন, যারা লোকজনকে আপনার ঘর চিনিয়ে দিয়েছে, তাদের মধ্যে ছিল আপনার পড়শিও, তা হলে এটা কতই না ভয়ানক ঘটনা।

একাধারে তিন দিন হত্যাযজ্ঞ গ্রাস করে নিয়েছিল দিল্লির মেহনতি শ্রেণীর বসতির সরু গলিগুলোকে। এর দ্বারা এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ভারত রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অবমাননাকর ও সম্পূর্ণ পতন ঘটে গেছে। এখন যদি জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে এহেন পরিস্থিতির মোকাবেলা করা না হয়, সংবিধান চালিত একটি রাষ্ট্রের অবলুপ্তির বিষয় প্রত্যাশা, শান্তি, সামাজিক আস্থা, উন্নয়ন, অর্থনীতি এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের সহানুভূতি ও সুবিচারের দেশ গড়ার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেবে।

সৌজন্যে : দিহিন্দুডটকম, ৯ মার্চ
লেখক : ভারতের মানবাধিকার সংগ্রামী ও লেখক
ভাষান্তর : মীযানুল করীম


আরো সংবাদ



premium cement
সব সংস্কার শেষে নির্বাচনের পক্ষে ৬৫.৯ ভাগ মানুষ সোনার দেশ- এটিই হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ জুলাই বিপ্লবে আহত বাবুকে নেয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড সৈন্যের বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে রাশিয়া! প্রথম দিন শেষে স্বস্তিতে বাংলাদেশ বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের দাবি বাংলাদেশ অরবিসের সাথে কাজ করতে আগ্রহী : অধ্যাপক ইউনূস ঢাবি সিন্ডিকেটে এখনো বহাল আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা হাসিনা বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করতে দিগন্ত টেলিভিশনসহ অসংখ্য গণমাধ্যম বন্ধ করেছে : ফখরুল শীত শুরু হচ্ছে তবু কমেনি ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যয়বহুল তদন্তেও শনাক্ত হয়নি লাশটি কার ‘রহস্যজনক’ কারণে নেয়া হয়নি ডিএনএ নমুনা

সকল