০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪২৩১, ৬ শাবান ১৪৪৬
`

আফিয়া সিদ্দিকীর আর্তনাদ

-

দুই শত্র“দল পরস্পর হাত মিলিয়েছে এবং একটি শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এরপর চার দিক থেকে ‘মোবারক হো, মোবারক হো’ আওয়াজ আসতে শুরু করেছে। এ আওয়াজগুলোর আড়ালে ফোঁপানো কান্না শুনতে পাই। আমি ওই কান্না গভীরভাবে শোনার চেষ্টা করেছি। দূর-বহু দূর থেকে ভেসে আসা ফোঁপানো কান্নাকে আমরা অলীক কল্পনা ভেবে উপেক্ষা করার চেষ্টা করি। কিন্তু এটা অলীক কল্পনা ছিল না। এটা এক নারীর আওয়াজ, যিনি বেদনাভরা ভঙ্গিতে কেঁদে কেঁদে জিজ্ঞাসা করছিলেন, এই আমেরিকা, এই ব্রিটেন, এই জাতিসঙ্ঘ, এই সভ্য পৃথিবী- এরা সবাই তো তালেবানকে ‘সন্ত্রাসী’ বলত। এরপর ওই ‘সন্ত্রাসী’দের সাথে শান্তি আলোচনাও হয়েছে। অবশেষে দোহায় তাদের সাথে শান্তিচুক্তিও হয়ে গেল। যদি তারা সন্ত্রাসী না হয়, তাহলে আমার অপরাধ কী? আমার বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসের অভিযোগ আনা হয়েছিল। আপনারা সবাই আরো বলেছিলেন, তালেবানের সাথে যোগ দিয়ে আমেরিকানদের ওপর হামলার পরিকল্পনা আঁটছিলাম। এখন ওই তালেবানদের জিজ্ঞাসা করুন, আমি কবে ও কোথায় তাদের সাথে যোগ দিয়ে হামলার পরিকল্পনা করেছি?

গভীরভাবে লক্ষ করে দেখি, এটা ড. আফিয়া সিদ্দিকীর আওয়াজ। আমার মাথা জোরে ঝাঁকি দিলাম। দোহায় আফগান তালেবানের প্রতিনিধি মোল্লা আবদুল গনি ব্রাদার ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিনিধি জালমে খলিলজাদের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ এ দৃশ্য দেখে একে অপরকে মোবারকবাদ জানাচ্ছিল। আর আমার কানে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর আওয়াজ ধ্বনিত হচ্ছিল, যিনি দোহা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে আমেরিকার একটি কারাগারে ৮৬ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। তিনি শুধু একজন নারী নন, বরং তিনি একটি ট্র্যাজেডি। আপনার অন্তর যদি এখনো জীবিত থাকে, তাহলে ওই ট্র্যাজেডির ফোঁপানো কান্না আপনিও শুনতে পাবেন। আপনিও গভীরভাবে ওই ফোঁপানো কান্না শুনুন। ড. আফিয়া সিদ্দিকী আপনার কাছে জানতে চাচ্ছেন- হে আমার প্রিয় পাকিস্তানের জনগণ! আজ তোমরা বিশ্বকে বেশ গৌরবের সাথে বলছ, যদি পাকিস্তান সহায়তা না করত, তাহলে আমেরিকা ও আফগান তালেবানের মধ্যে শান্তিচুক্তি কখনোই হতো না। আচ্ছা, আমাকে একটু বলো তো, ওই চুক্তির অধীনে আমেরিকা ও আফগান সরকার পাঁচ হাজার আফগান তালেবান বন্দীকে মুক্তি দেবে এবং তালেবান এক হাজার প্রতিপক্ষ বন্দীকে মুক্তি দেবে; এ সবকিছুর মধ্যে পাকিস্তান সরকার কি তার জাতির এক কন্যার মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারত না? যারা তালেবানের সাথে হাত মিলাল এবং তাদের সাথে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরও করল, তাদের কাছে ড. আফিয়া সিদ্দিকী এখনো ‘সন্ত্রাসী’ কেন?

ড. আফিয়া সিদ্দিকীর সাথে আমার কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। তবে ২৯ ফেব্র“য়ারি, ২০২০ সালে দোহায় তালেবান ও আমেরিকার মধ্যে শান্তিচুক্তির পর কয়েকজন পাকিস্তানি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ড. আফিয়া সিদ্দিকী কবে মুক্তি পাচ্ছেন? আমি পড়েছি বিপাকে। আমাকে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানি ছাত্রী মালালা ইউসুফজাইয়ের সমর্থকও মনে করা হয়, যার ওপর পাকিস্তানের তালেবান সোয়াতে হামলা করেছিল। আমাকে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর হিতাকাক্সক্ষীও বলা হয়, যাকে আমেরিকা ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করেছে। সম্ভবত এর কারণ হচ্ছে, ২০০৩ সালে ইমরান খান প্রথম ব্যক্তি, যিনি জিও নিউজে আমার প্রোগ্রাম ক্যাপিটাল টকে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর অপহরণ নিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল সালেহ হায়াতের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। ওই টিভি প্রোগ্রামে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আফিয়া সিদ্দিকীকে একজন ‘ভয়ঙ্কর নারী’ আখ্যা দেন। এতে স্পষ্ট হয় যে, এ নারী আমাদের সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। এরপর ইমরান খান বারবার আফিয়া সিদ্দিকীর জন্য সোচ্চার হলেন, কিন্তু তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। আফিয়ার ব্যাপারে মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংগঠনগুলো বেশি সোচ্চার হয়নি। কেননা জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ‘উদারমনা সরকার’ নিজেদের অনেক অপরাধকে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আখ্যায়িত করে দেশের মানুষকে বোকা বানাত। আফিয়ার ব্যাপারে এ প্রোপাগান্ডা করা হয়েছে যে, তিনি তো পাকিস্তানের নাগরিকই নন, তিনি আমেরিকার নাগরিক। এরপর আফিয়ার মাতা ইসমত সিদ্দিকী আমাকে করাচিতে তার বাসায় ডেকে নিয়ে কন্যার পাকিস্তানি পাসপোর্ট দেখান, যেখানে আমেরিকার ভিসা লাগানো ছিল। এ দাবিটি মিথ্যা প্রমাণিত হলো যে, ড. আফিয়া সিদ্দিকী মার্কিন নাগরিক ছিলেন। এ কথাও বলা হয়েছে, আফিয়া তার সাবেক স্বামী আমজাদকে তালাক দিয়ে আলকায়েদার কোনো সন্ত্রাসীকে বিয়ে করেছেন। কিন্তু এ অভিযোগও কখনো প্রমাণিত হয়নি। ড. আফিয়া সিদ্দিকীর সঙ্কটময় জীবনের সূচনা ২০০২ সালের অক্টোবরে, তার স্বামীর সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর। তার সাবেক স্বামীর দাবি, তিনি ২০০৩ সালে গ্রেফতার হননি, বরং তিনি নিজেই গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ ৩০ মার্চ, ২০০৩ সালে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা লোকজন তাকে করাচি থেকে গ্রেফতার করেছিল। বহু মানুষ এ গ্রেফতারি চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছে এবং পরের দিন এ সংবাদ করাচির কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশও করা হয়। ইসমত সিদ্দিকী যাদের মাধ্যমে তার কন্যার মুক্তির জন্য চেষ্টা করেন, তাদের মধ্যে তৎকালীন সিনেট চেয়ারম্যান মিয়া মুহাম্মদ সুমরুও শামিল আছেন, যিনি বলেছিলেন, ‘অল্প দিনের মধ্যেই আফিয়াকে ছেড়ে দেয়া হবে।’ তবে এরপর তার গুম হয়ে যাওয়াটা এক রহস্যে পরিণত হয়।

এটা শুধু একজন আফিয়ার কাহিনী নয়। মোশাররফের শাসনামলে আলী আসগর বাঙ্গুলজাই ও জারিনা মারিসহ অসংখ্য মানুষের গুম হওয়াটা রহস্যই থেকে গেল। আজ পর্যন্ত তাদের বেশির ভাগের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আফিয়ার কাহিনী নতুন মোড় নেয় ২০০৮ সালের জুলাইয়ে। মোশাররফের ক্ষমতা শেষ হওয়ার মাত্র এক মাস আগে মার্কিন সরকার দাবি করে, আফিয়াকে আফগানিস্তানের গজনি শহর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওখানে তিনি তালেবানের সাথে মিলে হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। আফিয়াকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়। ২০১০ সালে আফিয়ার বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করে অভিযোগ দেয়া হয়, তিনি এক মার্কিন সেনার কাছ থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে তার ওপর গুলি চালিয়েছেন, তবে ওই সেনা বেঁচে যান। আফিয়ার বিরুদ্ধে নতুন সাক্ষীও উপস্থিত করা হলো। তন্মধ্যে একজন আফগান নাগরিক আহমদ গুলও ছিলেন। তবে কোনো রাইফেলেই আফিয়ার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেল না। ১৪ দিনের ট্রায়াল চলাকালে আফিয়া বারবার বলেছেন, ‘তার ওপর মার্কিনিরা নির্যাতন চালিয়েছে।’ এ কারণে আদালতের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টির অভিযোগে তাকে আদালত থেকে বের করে দেয়া হয় এবং শুধু হত্যা পরিকল্পনার অভিযোগে ৮৬ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ বন্দিদশা ৩০ আগস্ট, ২০৮৩ সালে শেষ হবে। আফিয়ার মুক্তির জন্য পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ২১ আগস্ট, ২০০৮ সালে প্রথম প্রস্তাব গৃহীত হয়। ওই সময় ইউসুফ রাজা গিলানি প্রধানমন্ত্রী ও শাহ মাহমুদ কুরাইশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। সিনেট যখন আফিয়ার মুক্তির জন্য ১৫ নভেম্বর, ২০১৮ সালে প্রস্তাব পাস করে, তখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন শাহ মাহমুদ কুরাইশি। দোহাতে যখন শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়, তখনো সেখানে কুরাইশি সাহেব উপস্থিত ছিলেন। ইমরান খানকে চুক্তির কৃতিত্ব দেয়া হচ্ছিল। এই সেই ইমরান খান, যিনি ২০০৩ সালে সর্বপ্রথম আফিয়ার জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন। আজ তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আফিয়া কিছু দিন আগে কারাগারে হিউস্টনের পাকিস্তানের কনস্যুলেট জেনারেলকে ইমরান খানের নামে একটি পত্রও দিয়েছেন। জানা নেই, ওই পত্র খান সাহেব পর্যন্ত পৌঁছেছে কি না। কিন্তু আফিয়ার ফোঁপানো কান্না অনেক মানুষের কাছে পৌঁছেছে। তিনি জিজ্ঞাসা করছেন, আমার বিরুদ্ধে কোনো মানুষ হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবু আমাকে ৮৬ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আর যারা আত্মঘাতী হামলার দায় স্বীকার করে বেড়ায়, তাদের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়ে গেল। আমার অপরাধ কি শুধু এই যে, আমি একজন পাকিস্তানি?

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ০২ মার্চ, ২০২০ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement