২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দেশ চলছে উল্টো পথে

-

এই রূপসী বাংলার রূপের অকৃত্রিম প্রশংসা কে না করেছে? রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তো এর অপরূপ রূপে বিমুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর অপরাপর অংশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলেছেন- ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/খুঁজিতে যাই না আর’। এই ভূভাগের রূপ-ঐশ্বর্যের টানে মুগ্ধ হয়ে কত দেশ দেশান্তরের লোক এখানে এসেছেন, আবাস গেড়েছেন, সাম্রাজ্য করেছেন প্রতিষ্ঠা। তাদের মধ্যে বিদেশী সেনাপতি তো ছিলেনই, আরো ছিলেন দেদার পীর দরবেশ। রবিঠাকুর এই বাংলাকেই লক্ষ্য করে লিখেছেন- ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন,/শক-হুন-দল পাঠান মুঘল এক দেহে হলো লীন’। আধুনিককালের গীতিকার লিখেছেন- ‘বিশ্ব কবির সোনার বাংলা/নজরুলের বাংলাদেশ/রূপের যে তার নেইকো শেষ/বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি এই বাংলাদেশ অবিমৃশ্যকারী দেশনায়কদের হাতে পড়ে আজ কোন পথে? সে কথাই ভাবতে হয়।

এটা যন্ত্রকেন্দ্রিক পার্থিব উন্নয়নের যুগ। তবে এই উন্নয়ন প্রকৃতির রূপমাধুর্য ও পরিবেশকে ধ্বংস, বিপন্ন কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত করে নয় কিছুতেই। যন্ত্রকে বশে রেখে এটাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে যান্ত্রিক সভ্যতার বিস্তার যেন এই সুন্দর দেশের রূপমাধুর্যকে ধ্বংস না করে। এ দেশকে আরো সুন্দর ও সৌকর্যমণ্ডিত করে গড়ে তুলতেই যন্ত্রকে কাজে লাগাতে হবে। প্রকৃতির রূপমাধুর্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং এর উৎকর্ষ নিশ্চিত করেই সামগ্রিক উন্নয়নের পথে আমাদের এগোতে হবে। তবেই উন্নয়ন হবে সার্বিকভাবে কল্যাণকর, সার্থক এবং মানব ও প্রকৃতিবান্ধব। যন্ত্রের প্রয়োগের ফলে আমাদের যেন একদিন এই বলে হাহাকার করতে না হয় যেমন প্রখ্যাত গায়ক হেমন্ত মুখার্জি গেয়েছেন- ‘এখানে আকাশ নেই/এখানে বাতাস নেই’। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, হালে দেশের উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি সেই হতাশাব্যঞ্জক পরিণামের দিকেই এগিয়ে চলেছে। অন্যান্য উদাহরণের মধ্যে বিশেষ করে সুন্দরবনের সন্নিকটে বাগেরহাট জেলার রামপাল এবং সাগরসংলগ্ন কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কথা বলতে হয়। প্রকৃতিকে বিনাশ করে এসব বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে চলেছে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে নয়। আশ্চর্য!

সম্প্রতি বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) এবং জাপানি প্রতিষ্ঠান জাইকা বাংলাদেশে দু’টি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি করছে একটা রামপালে এবং অপরটি জাইকা করছে মাতারবাড়িতে। এ ছাড়াও মহেশখালীতে আরো কয়েকটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। দেশে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সাধারণত মনে করা হয় দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। সব উন্নয়ন প্রকল্পেরই ‘কস্ট-বেনিফিট’ বা লাভ ও লোকসান বলে দু’টি দিক থাকে। যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে এর ‘কস্ট-বেনিফিট’ হিসাব পরীক্ষা করে দেখা জরুরি। বলা বাহুল্য, যে প্রকল্পে লাভ বেশি সেটাই বাস্তবায়নযোগ্য। আমাদের আরো বিবেচনায় নিতে হবে- যেসব দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তাদের অভিজ্ঞতা কী।

দেখা গেছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উপাদন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে প্রায় শতবর্ষ আগেই এসব প্রকল্প উন্নত দেশগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। এ জাতীয় প্রকল্প মারাত্মক পরিবেশ দূষণ এবং নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটায় বলে উন্নয়নশীল দেশেও জনবসতি এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে এর অনুমোদন দেয়া হয় না। অথচ রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি লোকালয় থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার এবং মহেশখালীতে লোকালয়ের মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যেসব দেশ এজাতীয় বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করছে তাদের নিজ দেশেই লোকালয়ের এত কাছাকাছি এমন প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমতি দেয়া হয় না। ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি বাংলাদেশের রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সত্য; তবে এজাতীয় বিদ্যুৎ প্রকল্প, ভারতের ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের কারণে, এই এনটিপিসি নিজ দেশের তামিলনাডু এবং মধ্যপ্রদেশে বাস্তবায়নের অনুমতি পায়নি। ভারত সরকার প্রণীত, এনভায়রনম্যান্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের (ইআইএ) নির্দেশনা অনুসারে লোকালয়ের বা বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের ভেতরে কোনো প্রকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না। অথচ বাংলাদেশ ভারতীয় এবং অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানিকে অনুরূপ প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসের দিক থেকে কয়লার স্থান ফসিল জ্বালানির পরেই। সে কয়লা জ্বালিয়েই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৬৩ গুণ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য ও জাপানের মতো কয়েকটি দেশ প্রভাবকের ভূমিকায় আছে। দেশের ভেতরে এর বিরুদ্ধে সচেতন মানুষের ব্যাপক আন্দোলন সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেন কয়লাকে আঁকড়ে ধরেছে, সেটা দুশ্চিন্তার বিষয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা সর্বাধিক ‘নোংরা’ ও ক্ষতিকর জ্বালানি হিসেবে সমালোচিত। জ্বালানি হিসেবে কয়লা বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা (পিএম ২.৫), কয়লার ছাই এবং এসিড নির্গমন করে পানি ও বাতাসকে দূষিত করে থাকে। এ ছাড়াও দুরারোগ্য ব্যাধি এবং অকালমৃত্যুর কারণ হতে পারে- এমন ‘ভারী ধাতু’ যেমন সিসা, পারদ ও ক্রোমিয়াম পোড়া কয়লা থেকে নির্গত হয়। এ কারণে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো জীব ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।

কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে নদী থাকা ‘জরুরি’। কারণ এর বর্জ্য হিসেবে টন টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ফেলা হবে এ নদীতে। এতে করে সুন্দরবনের কাছের পশুর নদী এবং মাতারবাড়ির পাশের কুহেলিকা খালের, যা বঙ্গোপসাগরের সাথে যুক্ত হয়েছে, মৎস্যসম্পদ অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। উপরন্তু হাজার হাজার টন বিষাক্ত সালফারযুক্ত ছাই বাতাসে মিশে গাছপালা ও প্রাণীর জীবনকে বিপন্ন করে তুলবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকার জমিতে উৎপাদিত ফসল-শাক-সবজি খেলে মানবদেহে অ্যাজমাসহ ফুসফুসবাহিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়বে; এমনকি ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিও মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদীপথে বছরে ৫০ লাখ টন আমদানিকৃত কয়লা বহন করতে হবে বলে কয়লার ভাঙা টুকরো ও জাহাজের তেল সুন্দরবনের ‘ইকো সিস্টেম’ পুরোপুরি নষ্ট করে দেবে। তাপবিদ্যুতের জন্য প্রতিদিন যে ৭২টি গভীর নলকূপ দিয়ে ১৪৪ কিউসেক ভূগর্ভস্থ মিঠা পানি উত্তোলন করা হবে, তাতে করে ভূগর্ভস্থ মিঠাপানির মজুদ অতিদ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে। এতে করে পার্শ্ববর্তী ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা দেবে গিয়ে প্রায় আট হাজার পরিবার তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ হবে। মহেশখালীর ক্ষেত্রেও কয়লাবিদ্যুতের প্রভাবে প্রায় দেড় লাখ মানুষ জীবিকাহীন হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এসব কথা জেনেও সরকার এ পথেই এগোচ্ছে কেন?

অপর দিকে, এ সব বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশকে কেবল কয়লা আমদানি করতেই বার্ষিক ২০০ কোটি মার্কিন ডলার গুনতে হবে। এ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রকল্প বাস্তুবায়নের জন্য ছয় কোটি ১০ লাখ টন কয়লা আমদানি খাতে। এতে করে বাংলাদেশ কয়েক দশক ধরে উচ্চমূল্যে কয়লা আমদানির ফাঁদে পড়ে যাবে। ফলে দেশ নতুন করে এক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়তে পারে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য অধিকতর প্রতিকূল হবে। এ ছাড়াও এত বিপুল পরিমাণ কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হলে বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্যত দেশে ঘটে যেতে পারে ‘কার্বন বিস্ফোরণ’। এতে বিপুল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এবং ভৌগোলিকভাবে এই ছোট্ট দেশটিতে, যা আগে থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে দুর্দশার সম্মুখীন, প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যাবে। এতে করে দক্ষিণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে দেশটির স্থলভাগের প্রায় ১১ শতাংশই পানিতে তলিয়ে যাবে। উপরন্তু উপকূলভাগের এক কোটি ৫০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হবে। এ ছাড়া কয়লাভিত্তিক নতুন আরো ২৯টি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এ ক্ষতির পরিমাণ এমন হতে পারে যে, উত্তরে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া পর্যন্ত তলিয়ে যেতে পারে। এতে লাভ হবে কার? নিশ্চয়ই বাংলাদেশের নয়?

রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে করমুক্ত সুবিধাসহ মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ভারত ৫০ শতাংশ বিদ্যুতের মালিকানা পাবে। বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের ৭০ ভাগ ঋণের সুদসহ দায় বর্তাবে বাংলাদেশের ওপর। উপরন্তু এই প্রকল্পের বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৮.৮০ টাকা, যা দেশীয় কোম্পানির বিদ্যুতের দামের দ্বিগুণ। এই প্রকল্পে লাভবান হবে ভারত এবং দেশীয় কমিশন ভোগীরা। উপরন্তু সুন্দরবন ধ্বংস হওয়া ছাড়াও সর্বব্যাপী প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতি হবে এ দেশের জনগণের। তুলনামূলকভাবে বিদ্যুতের অতিরিক্ত দামের কারণে এ বাবদ বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর সাথে যদি সম্ভাব্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত ক্ষতি যোগ করা হয় তবে এর পরিমাণ দাঁড়াবে মোট পাঁচ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। অপর দিকে, মহেশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়িত হলে পুরো মহেশখালী ধীরে ধীরে মরুভূমিতে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ক্রমবর্ধমান বিদেশী অর্থায়নে বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বর্তমান একটি থেকে বাড়িয়ে ৩০ গুণ করা হবে। এটা যদি হয়, বর্তমানের ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের পরিবর্তে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৩ হাজার ২৫০ মেগাওয়াটে। ফলে বাতাসে বছরে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড যুক্ত হবে ১১ কোটি মেট্রিক টন।

বাংলাদেশের একমাত্র কয়লানির্ভর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বর্তমানে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া। এটি মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী পাওয়ার প্ল্যান্ট। চালু হওয়ার পর থেকেই সেখানে নানাবিধ সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। প্রথমত বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ পানি টেনে নেয়ার ফলে এলাকাবাসী দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার এবং চাষাবাদের জন্য পানি পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত কেবল ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম কেন্দ্রটি চালু রাখতে কয়লা জ্বালাতে হয় প্রতিদিন দুই হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। এতে করে প্রতিদিন যে ৩০০ মেট্রিক টন ছাই উৎপন্ন হয়, তাতে পুরো এলাকা ছেয়ে যাচ্ছে। এ ছাই যেসব পুকুরে জমা হচ্ছে এগুলোর তো ক্ষতি হচ্ছেই; উপরন্তু এই ছাই মিশ্রিত পানি চুইয়ে মাটির নিচে ও পার্শ্ববর্তী জলাভূমিতে গড়িয়ে পড়ছে। এর আশপাশে দেখা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের নালা বেয়ে কয়লা ধোয়া কালো পানির স্রোত কৃষি জমিতে মিশে জমির রঙ নিকষ কালো হয়ে গেছে। মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেদ্রের পরিবেশ দূষণের এই হয় যদি আংশিক চিত্র ১৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল এবং ১২০০ মেগাওয়াটের মহেশখালী কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকার জনবসতি, পরিবেশ এবং কৃষিজমির কী দশা হবে তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ কী এটা বুঝেন না?

এটা বিদ্যুৎ জ্বালানিনির্ভর যুগ, সত্য। বিদ্যুৎ না হলে আধুনিক সভ্যতা অচল। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, মানব জীবন লালনকারী প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে এর জোগান নিশ্চিত করতে হবে। যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূলনীতি হতে হবে স্রষ্টার পরে তার সৃষ্টিজগতে- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/তার উপরে নাই’। মানবকল্যাণেই বিদ্যুৎ। যেনতেন প্রকারে বিদ্যুৎ উপাদনের জন্য মানুষ নয়। প্রকৃতির সৌন্দর্যবর্ধন এবং এর উৎকর্ষ বিধানের জন্যই যন্ত্র; যন্ত্রের উৎকর্ষ বিধানের জন্য প্রাকৃতিক নান্দনিকতার নিরাকরণ নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য মানুষ ও প্রকৃতিকে বিসর্জন দিয়ে দেশে উন্নয়নের বিকাশ ও রূপান্তরের দ্বৈরথ এগোচ্ছে। সরকার দেশটিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে যে, এ সরকার তো পারবেই না, এমনকি এর পরবর্তীও ভিন্ন কোনো দলের সরকারের পক্ষেও দেশটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা দুরূহ কিংবা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ও সম্পদের লীলাভূমি যে বাংলার রূপবর্ণনা করে এ লেখা শুরু করেছিলাম শেষেও এরই নান্দী পাঠ করেই বলতে চাই- এ দেশের সম্পদের ও সৌন্দর্যের হানি হোক, এটা কেউ চায় না। ক্ষতিকর ফসিল জ্বালানি ও কয়লার পরিবর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার প্রচলন ও বৃদ্ধি করাই কাম্য। পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের শক্তি দিন, আমরা যেন দেশের সৌন্দর্য ও সম্পদ কেয়ামত পর্যন্ত রক্ষা করতে পারি। আমিন!

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল, কুমিল্লা মহিলা সরকারি কলেজ


আরো সংবাদ



premium cement