২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সাইবার যুদ্ধের ঝুঁকিতে বিশ্ব

-

আক্রমণাত্মক সাইবার অস্ত্র রফতানি বেড়েই চলছে। এই অস্ত্র ও প্রযুক্তি বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য গোয়েন্দারা ব্যবহার করছে। আধিপত্য বিস্তারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জার্মানির মতো উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী দেশের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অত্যাধুনিক সাইবার অস্ত্র এত দিন ব্যবহার করে আসছিল। তবে কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না দিলেও এখন ইসরাইল, চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের কাছেও সাইবার অস্ত্র রয়েছে। শক্তিশালী হ্যাকিং সরঞ্জাম এবং পরিষেবার জন্য একটি শক্তিশালী বাণিজ্যিক বাজারের উত্থান হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও অন্যান্য দেশের সরকারের সাবেক সাইবার বিশেষজ্ঞরা এই বাণিজ্যে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। ভবিষ্যতে সাইবার অস্ত্র এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করবে, যা কার্যত নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হবে।

বিশ্বজুড়েই সাইবার নিরাপত্তা চরম হুমকির মধ্যে থাকায় বাড়ছে উদ্বেগ। আর এর ফলে সাইবার অস্ত্র বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটছে। বর্তমান বিশ্বে অস্ত্র যুদ্ধের চেয়ে সাইবার যুদ্ধ অনেক বেশি শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ আজ আর শুধু বন্দুক, গোলাবারুদ বা ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সাইবার স্পেসে হামলাও এখন বাস্তব জগতকে তছনছ করে দিতে পারে। সরাসরি যুদ্ধের চেয়ে অদৃশ্য মাধ্যমে যুদ্ধ কম বিপজ্জনক নয়। ২০২১ সাল নাগাদ বছরে সাইবার অপরাধজনিত ক্ষতি দাঁড়াতে পারে ছয় ট্রিলিয়ন ডলার বা ছয় লাখ কোটি ডলারে।

সাইবার অস্ত্র কেনা, বিক্রি ও মোতায়েনের পদ্ধতি এবং সাইবার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারগুলোর পদক্ষেপে নতুনত্ব এসেছে। সাইবার অস্ত্রের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক বাজারে দাপটের সাথে শীর্ষস্থানে রয়েছে এনএসও গ্রুপ ও ভারিন্টসহ প্রতিরক্ষা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমস নামক ইসরাইলি কোম্পানিগুলো। সেলফোন ও কম্পিউটারসহ অন্য প্রযুক্তিপণ্যগুলোর ব্যবহারকারীদের গোপনে নিরীক্ষণের জন্য সফটওয়্যার সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে বড় প্রতিরক্ষা অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি রফতানিকারীরা তাদের সাইবার অস্ত্র বিক্রির বিবরণ খুব বেশি বিশদভাবে জানায় না বলে এ সংক্রান্ত সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া কঠিন। তবে ইসরাইলের সাইবার সেনারা কম্পিউটার যেখানে আছে সেখানেই হানা দিতে পারে বলে মনে করা হয়। কোনো গুপ্তহত্যা করার সময় আশপাশের কয়েকটি সিসিটিভি হ্যাক করে অচল করে দেয়া, ফোনে আড়িপাতা বা কম্পিউটারের ফায়ারওয়াল ভেঙে ফেলাকে মামুলি ব্যাপার বানিয়ে ফেলেছে দেশটি।

এ দিকে সাইবার হামলা যত বাড়ছে, নিরাপত্তা ঝুঁকি তত বাড়ছে, তথ্য হাতিয়ে নেয়া বাড়ছে; আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে সাইবার অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রি বৃদ্ধির ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও বাড়ছে। বিভিন্ন ব্যবসা ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি অফিস, ইন্টারনেট কানেক্টেড গাড়ি, পাওয়ার স্টেশন, হাসপাতাল, কুরিয়ার ও পোস্টাল সার্ভিসের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক কোনো কিছুই সাইবার হামলা থেকে নিরাপদ নয়। ধারণা করা হচ্ছে- আকাশ, ভূমি ও সমুদ্রের পর সাইবার জগতই হবে কঠিন যুদ্ধক্ষেত্র।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ইসরাইলের প্রতিবেশী দেশগুলো ইসরাইলের কোম্পানিগুলো থেকে গোয়েন্দা অস্ত্র সংগ্রহ করছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারি কর্মকর্তারা ইসরাইলের কোম্পানিগুলো থেকে গোয়েন্দা অস্ত্র কিনেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করতে শক্তিশালী সাইবার অস্ত্র তৈরি করা, উত্তর কোরিয়ার সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে সাইবার অস্ত্র বানানোর প্রপাগান্ডা চালানো, সাইবার কমান্ডারদের মাধ্যমে শক্তিশালী সাইবার হামলা পরিচালনা করতে দক্ষিণ কোরিয়ার পরিকল্পনা নিয়ে বিবিসি অনলাইনে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে সাইবার ইউনিট গঠন করেছে দেশটি। সাইবার আর্মি বড় করে তোলা হচ্ছে এবং সাইবার অস্ত্র তৈরি হচ্ছে। জাপানও নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ম্যালওয়্যার ঘরানার সাইবার অস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৭ সালে বেশ কিছু অটোমোবাইল কোম্পানির নকশা চুরি করতে সাইবার অপারেশন চালায় ভিয়েতনামের হ্যাকাররা।

ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আক্রমণের জন্য ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল একত্রে তৈরি করে ‘স্টাক্সনেট’ সফটওয়্যারের মতো শক্তিশালী সাইবার অস্ত্র, মাইক্রোসফট উইন্ডোজের মাধ্যমে যেটি বানানো হয়েছিল ছড়িয়ে শিল্পায়ন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। ইন্টারনেট সংযোগহীন কম্পিউটারকে ভাইরাস আক্রান্ত করতে পারে না, এমন ধারণাই বদলে যায় ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু কর্মসূচির ওপর স্টাক্সনেট ভাইরাসের হানায়। সাইবার হামলা কিভাবে বাস্তব জগতের কোনো স্থাপনাকে অকেজো করে দিতে পারে তার সাম্প্রতিক উদাহরণ এটি। পরে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টিরও বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, ড্রোন হ্যাক করে অক্ষত নামিয়ে আনা, সৌদি তেলক্ষেত্রে ভয়াবহ হামলা, তুরস্কের বিদ্যুৎ গ্রিড বন্ধ করে দেয়ায় সাফল্য পায় ইরানে ২০১০ সালে গঠিত সাইবার ডিফেন্স কমান্ড।

হোয়াটস অ্যাপে সাইবার অস্ত্রের ডিলার হিসেবে পরিচিত ইসরাইলি নিরাপত্তাবিষয়ক সংস্থা এনএসও গ্রুপের খুব দক্ষ ও অগ্রসর হ্যাকারদের তৈরি করা সফটওয়্যার ‘পেগাসাস’ দিয়ে সাইবার হামলার ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফিন্যান্সিয়াল টাইম। ‘পেগাসাস’ মোবাইল ডিভাইস থেকে তথ্য (কথোপকথন, ছবি, লোকেশন) সংগ্রহ করতে পারে এবং মাইক্রোফোন ও ক্যামেরার তথ্য নিতে পারে। বিভিন্ন দেশকে গোপনে সাইবার অস্ত্র সরবরাহকারী এনএসও অ্যাপলের দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা বলয় ভেঙে ফেলেছিল। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সাইবার হামলার ফলে প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কে যে ভাইরাস ছড়িয়েছিল, সেটা সম্পূর্ণ দূর করতে ১৪ মাস লেগে গিয়েছিল।

সাইবার হামলার শিকার হয়েছে ক্রেডিট রিপোর্টিং এজেন্সি ইকুইফ্যাক্স ডাটা ব্রিচ, উবার ডাটা ব্রিচ, ওয়ানাক্রাই র‌্যা নসমওয়্যার, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ), ইন্টারনেট কোম্পানি ইয়াহু ও ডিপ রুট অ্যানালিটিকস ডাটা ব্রিচ। যুগের পর যুগ ধরে পশ্চিমাদের ডিজাইন করা অস্ত্রের ব্লুপ্রিন্ট হ্যাক করে নিয়ে আসতে যেন চীনের জুড়ি নেই। গুগল, মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের, ভারতের প্রতিরক্ষা খাত, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নথিতে হানা দিয়েছে চীন। সাইবার হামলা চালিয়ে ভারতের ৬৮ লাখ নথি চুরি করে চীনের হ্যাকাররা। ভারতের নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাইবার ইউনিটে কর্মরত বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০১১ সালে প্যারিসে জি২০ সম্মেলন সম্পর্কিত সব ফাইল হাতিয়ে নিতে চালানো হামলায় এক লাখের বেশি কম্পিউটার আক্রান্ত হয়, ফ্রান্স সরকারও এই হামলার কথা স্বীকার করে।

অস্ত্র কর্মসূচির জন্য তহবিল জোগাড় করতে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে উত্তর কোরিয়ার সাইবার হামলার অভিযোগ উঠেছে জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনে। এতে ৩৫টি সাইবার হামলার মাধ্যমে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কথা উঠে এসেছে। প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালায় উত্তর কোরিয়ার বেপরোয়া সাইবার বাহিনী ব্যুরো ১২১ ও ইউনিট ১৮০ এর হ্যাকাররা। ২০১৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর হামলা, ২০১৪ সালে সনি হ্যাক, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি এবং ভয়াবহ ভাইরাস ওয়ানাক্রাইয়ের পেছনে ছিল অন্তত চার হাজার হ্যাকারের দেশ উত্তর কোরিয়া।

২০০৭ সালে এস্তোনিয়ার ওপর ভয়াবহ সাইবার হামলা চালায় রাশিয়া। ২০০৮ সালে আক্রান্ত হয় জর্জিয়া। ২০১৫ সালে ফ্রান্সের ১২টি টিভি চ্যানেল কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেয় রুশ হ্যাকাররা। মার্কিন নির্বাচনেও হস্তক্ষেপ করে রাশিয়ান হ্যাকাররা। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে রীতিমতো দৌড়ের ওপর রাখে ইনফরমেশন ট্রুপস নামে পরিচিত সাইবার যুদ্ধে নিয়োজিত রাশিয়ার সেনারা। সরকারি হ্যাকার ছাড়াও ভাড়ায় বিদেশী হ্যাকারের বিশাল বাহিনী আছে তাদের। ২০১৩ সালে জার্মান সাইবার ইউনিটের কথা প্রথম প্রকাশ পায়, সাইবার ডিফেন্স স্টেশনের জন্য হ্যাকার নিয়োগ দেয় দেশটি। ২০১৩ সাল থেকে চতুর্থ সামরিক বাহিনী হিসেবে সাইবার বাহিনী গড়ে তুলছে ফ্রান্স। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্স সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি চর্চা করছে এবং নিজেদের সাইবার আর্মির পরিসীমা দিন দিন বড় করছে। সুইডেন ইউরোপের অন্যতম নিরাপদ সাইবার স্পেসের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠছে।

২০১৩ সালের জুন মাসে স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যের ওপর ভিত্তি গার্ডিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন নজরদারি নিয়ে রিপোর্ট ছাপলে বিশ্ববাসী প্রথমবারের মতো জানতে পারে প্রত্যেক নাগরিকের ফোনকল, ই-মেইল এমনকি ওয়েবক্যামে ঘাপটি মেরে বসে আছে সিআইএ ও এনএসএ’র গোয়েন্দারা। ‘ফেজ জিরো’ ও ‘ফেজ-থ্রি’এর স্টিলথ ইমপ্লান্টস মাধ্যমে শত্রুর কম্পিউটারে স্থায়ীভাবে ঢুকতে, শত্রুর কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ বা স্থায়ী দখল নিতে বা ধ্বংস করতে সক্ষম। ডিজিটাল রণকৌশলের মাধ্যমে প্রতিদিন কোটি কোটি ফোনকল রেকর্ড করছে আমেরিকা। জাপান বা জার্মানির সরকারপ্রধানরাও এই আড়িপাতা থেকে রক্ষা পাননি। প্রতিটি রাষ্ট্রের পানি সরবরাহের অবকাঠামো ও পাওয়ার গ্রিডও এনএসএ’র হাতের মুঠোয়। তারা যেকোনো মুহূর্তেই অন্ধকার করে দিতে পারবে গোটা দেশকে। কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা, হ্যাকার বাহিনী এবং সরকারের শীর্ষ মহলের সাথে কাজে সমন্বয় করে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার কমান্ড।

পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, যদি কখনো যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া পরস্পরের সাথে যুদ্ধে জড়ায় তাহলে দেখা যাবে হ্যাকিং ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যদি কেউ সাইবার স্পেসে সঠিকভাবে পরিচালনার দক্ষতা দেখাতে না পারেন তবে কোনোভাবেই আকাশ, জল কিংবা স্থলে তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে পারবেন না। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি বাধেই তবে সেখানে বিভিন্ন ডাটার বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে। কারণ, এখন স্থলপথের যুদ্ধের অন্যতম কৌশলগত অস্ত্র বলা যায় সাইবার স্পেসের ডাটা।


আরো সংবাদ



premium cement