২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

উগ্র জাতীয়তাবাদের বিজয়

-

ভারতের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে ওই সব লোকের মধ্যে চরম নৈরাশ্যের প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে, যারা সেকুলার গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের মতাদর্শের ওপর সিল মেরেছে এবং এক অজানা শত্র“ থেকে নিরাপত্তা অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঝুলি ভোট দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, জনগণ মোদিকে নিজেদের ‘মুক্তিদাতা’ মনে করছে এবং অজানা শত্র“দের বিনাশ করার জন্য তার হাত আরো শক্তিশালী করতে চাচ্ছে। শত্র“কে তার ঘরে ঢুকে মারার প্রচারও বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেলো। নির্বাচনের সময় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও এয়ার স্ট্রাইকের মতো শব্দের গর্জন শোনা গেছে। এসব আবেগময় ও চিত্তাকর্ষক বিষয় থেকে সরে গিয়ে যদি জনগণের মৌলিক সমস্যা অর্থাৎ বেকারত্ব, ঊর্ধ্বমূল্য, দুর্নীতি ও আইনহীনতার প্রতি মনোযোগ দেয়া হতো, তাহলে জনগণের কাছে তারা উপেক্ষিত হতো, মনে হয়। ধারণা করা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারই উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীর ছায়াতলে নিরাপত্তা অনুভব করছে।

বেদনাদায়ক কথা হচ্ছে, যে সেকুলার পার্টিগুলো নিজেদের মতাদর্শ থেকে সরে গিয়ে ওই উগ্র অ্যাজেন্ডার অনুসরণ করার চেষ্টা করেছে, তারাও লজ্জাজনকভাবে হেরে গেছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদের মোকাবেলায় উদার হিন্দুত্ববাদের পথ তাদের জন্য ধ্বংসাত্মক প্রমাণ হয়েছে। ষাট বছর পর্যন্ত ভারতে কারো সাথে জোট করা ছাড়াই ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস পার্টি এ নির্বাচনে ‘পাদটীকা’য় পৌঁছে গেছে। দলটির ব্যর্থতার পরিমাপ এ কথায় অনুমান করা যায় যে, গত ডিসেম্বরে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া সত্ত্বেও পার্লামেন্ট নির্বাচনে এবার তাদের ভরাডুবি হয়েছে।

উত্তরপ্রদেশের মতো বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে তারা মাত্র একটি আসনে জয়লাভ করতে পেরেছে। রায়বেরেলিতে ইউপিএ-র চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী জয়লাভ করলেও আমেথিতে কংগ্রেসপ্রধান রাহুল গান্ধী নির্বাচনে হেরে গেছেন। এখানে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে দলের জেনারেল সেক্রেটারি বানানো ও জোরকদমে নির্বাচনী প্রচার চালানোর কোনো ফায়দা তারা নিতে পারেননি। উত্তরপ্রদেশ থেকে সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, ওখানে এবার ছয়জন মুসলমান প্রার্থী নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছেন। এ বিজয় এ কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যে, গত লোকসভায় উত্তরপ্রদেশ থেকে একজন মুসলমানও বিজয় লাভ করতে পারেননি। ১৮ শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত, দেশের এই সবচেয়ে বড় প্রদেশ থেকে গত লোকসভায় কোনো মুসলমান প্রতিনিধিই ছিলেন না। এ অবস্থা বিশ্লেষণ করে বিজেপির অমিতভাষী প্রধান, অমিত শাহ বলেছিলেন, আমরা মুসলমানদের ভোটকে অকার্যকর করে দিয়েছি।

তবে এবার এ ষড়যন্ত্র সফল হতে পারেনি, বরং ১৭তম লোকসভায় মুসলমান প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তরপ্রদেশ ছাড়া পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্য থেকেও দীর্ঘ দিন পর মুসলমান প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। তন্মধ্যে একজন হচ্ছেন মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গাবাদ আসন থেকে বিজয়ী সাইয়েদ ইমতিয়াজ জলীল, যিনি মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের টিকিটে বিজয় লাভ করেছেন। এর আগে মহারাষ্ট্র থেকে ২০০৪ সালে আবদুর রহমান আনতুলে মুম্বাইয়ের কোলাবা আসন থেকে জয়লাভ করে লোকসভায় গিয়েছিলেন। প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের প্রতিনিধির সংখ্যা এক থেকে বেড়ে দুই হলো। মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের প্রধান, ব্যারিস্টার আসাদুদ্দীন ওয়াইসি তার ঐতিহ্যবাহী লোকসভার আসনে হায়দরাবাদ থেকে জয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন। যদি কিষাণগঞ্জ (বিহার) থেকে মজলিসের প্রার্থী আখতারুল ঈমান বিজয়ী হতেন, তাহলে লোকসভায় তাদের সদস্য সংখ্যা তিন হয়ে যেত। কিষাণগঞ্জ থেকে কংগ্রেসের মুহাম্মদ জাভেদ জয়লাভ করেছেন এবং এটাই একমাত্র আসন, যা ইউপিএ বিহারে জয়লাভ করেছে। এক সময় লালু প্রসাদ যাদবের ‘এমওয়াই’ অর্থাৎ মুসলমান ও যাদব ঐক্যের কথা বলে জয়ের নিশানাবাহী রাষ্ট্রীয় জনতা দলের অবস্থা এতটাই করুণ হয়ে গেছে যে, এবার বিহার থেকে তাদের একজন প্রার্থীও জয়লাভ করেননি।

লালু কারাগারে যাওয়ার পর এ পার্টি তার অস্তিত্বের জন্য লড়ছে। সাম্প্রতিক ব্যর্থতার পেছনে লালু প্রসাদের পুত্র ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবের অপরিণামদর্শিতার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এ ধরনের অপরিণামদর্শিতা ও আকাশকুসুম স্বপ্নের কথা উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব প্রকাশ করেছেন। তিনি বিএসপির সাথে জোট করে এতটাই নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বিগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি নির্বাচনে দৌড়ঝাঁপ করাকে প্রয়োজন মনে করেননি। ফলাফল হলো, তিনি শুধু নিজের ও তার পিতা মুলায়েম সিং যাদবের আসন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি, তার স্ত্রী ডিম্পল যাদবও নির্বাচনে হেরে গেছেন। উদ্বেগজনক কথা হচ্ছে, ‘যাদবদের ঘাঁটি’ বলে স্বীকৃত অধিকাংশ আসনেই জয়লাভ করেছে বিজেপি।

উত্তরপ্রদেশে যাদব-মুসলমান জোট সমাজবাদী পার্টিকে দুইবার ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তা এবার পুরোপুরি ভেঙে গেছে। যাদবরা যেখানে সমাজবাদী পার্টিকে ছেড়ে দিয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, সেখানেই অপর দিকে মুসলমানরা সর্বাত্মক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সমাজবাদী পার্টির সাথে সম্পর্ক বহাল রেখেছেন। ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনগুলোতে সমাজবাদীর মুসলিম প্রার্থীরা নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছেন। ড. শফিকুর রহমান বারক (সাম্ভাল), মুহাম্মদ আজম খাঁ (রামপুর) ও ড. এসটি হাসান (মুরাদাবাদ) মুসলিম ভোটের শক্তিতে বিজয়ী প্রার্থী। যাদবরা সমাজবাদী পার্টি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন, ওইভাবে দলিতরা বহুজন সমাজ পার্টিকে এবারো প্রায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। বহুজন সমাজ পার্টির টিকিটে যে মুসলমান প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে আমরোহা থেকে কুনওয়ার দানিশ আলী, গাজীপুর থেকে আফজাল আনসারী ও সাহারানপুর থেকে হাজী ফজলুর রহমান রয়েছেন। বহুজন সমাজ পার্টি দশটি আসনে এবং সমাজবাদী পার্টি পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেছে।

উল্লেখ্য, সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির জোটের ব্যাপারে জনগণ বেশ আশা রেখেছিল। ধারণা করা হয়েছিল, এ জোট ইউপির অধিকাংশ আসনে জিতে যাবে। কিন্তু ফলাফল প্রমাণ করল, এ জোট শুধুই আকাশকুসুম স্বপ্নের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল এবং ভূপৃষ্ঠে তাদের অস্তিত্ব নামকাওয়াস্তে ছিল। এ কারণেই এখানে বেশির ভাগ আসনে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপি। উদ্বেগজনক হচ্ছে, দলিতদের জন্য সংরক্ষিত আসনেও বিএসপির পরিবর্তে বিজেপি জয়লাভ করেছে। এবারের নির্বাচনের বিশেষ দিক হচ্ছে, উদার হিন্দুত্বের পথে চলা সেকুলার পার্টিগুলো মুসলমানদের অচ্ছুৎ বানিয়ে রেখেছিল। এর অনুমান এর দ্বারা করা যেতে পারে যে, ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো সেকুলার পার্টির নির্বাচনী ইশতেহারে মুসলমানদের জন্য কোনো বিষয়ই ছিল না। এমনকি কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি ও রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মতো পার্টিগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে মুসলমানদের জন্য কোনো ওয়াদা করেনি। অথচ নির্বাচনী ওয়াদার বাস্তবতা সবাই জানেন।

ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য এ ওয়াদাগুলো করা হয়। অথচ এবার মুসলমানদের আকৃষ্ট করারও কোনো চেষ্টা করা হয়নি। আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, দুই বছর আগে কংগ্রেসপ্রধান সোনিয়া গান্ধী মুম্বাইয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বিজেপি কংগ্রেসকে মুসলমানদের পার্টি বলে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। আর এ কারণে হিন্দু ভোট কংগ্রেস থেকে দূরে সরে গেছে।’ এরপর কংগ্রেস নিজেদের মুসলমানদের থেকে দূরে রাখা শুরু করে, যাতে তারা বিজেপির প্রোপাগান্ডাকে ‘ব্যর্থ’ করতে পারে। কংগ্রেস এবারের নির্বাচনেও তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছিল। তারা নির্বাচনে এমন কোনো কাজ করেনি, যা দিয়ে তাদের প্রতি মুসলমান ঘেঁষার অভিযোগ আরোপ করা যেতে পারে।

কংগ্রেস সেকুলারিজমের মৌলিক বিশ্বাস থেকে সরে গিয়ে ‘উদার’ হিন্দুত্বের পথিক হয়েছে। ভূপাল থেকে বিজেপির টিকিটে মালেগাঁও বোমা বিস্ফোরণের প্রধান আসামি, সাধ্বী প্রজ্ঞা ঠাকুরকে এক সূক্ষ্ম পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ময়দানে নামানো হয়েছিল। তারা নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে নাথুরাম গডসেকে দেশপ্রেমিক আখ্যায়িত করে নিজেদের অ্যাজেন্ডা স্পষ্ট করে দিয়েছিল। সাধ্বী প্রজ্ঞার বিপরীতে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দিগি¦জয় সিং ছিলেন প্রার্থী। দিগি¦জয় সিং সাধ্বী প্রজ্ঞাকে সেকুলার গণতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরাজিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবর্তে নিজেই সাধু-সন্তর আশ্রয় গ্রহণ করেন। আর তিনি ‘উদার হিন্দুত্বের পথের যাত্রী’ হয়ে তাদেরই আশ্রিত হয়ে গেলেন।

এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচন প্রমাণ করে দিয়েছে যে, কংগ্রেসকে যদি নিজের মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করতে হয়, তাহলে তাকে জওয়াহের লাল নেহরু ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের দর্শনে ফিরে যেতে হবে এবং ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হওয়ার বিপদ থেকে জনগণকে সতর্ক করার জন্য জোরদার অভিযান চালাতে হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, বিজেপি ভারতের রাজনীতিকে বড় চতুরতার সাথে হিন্দুদের স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে সেকুলার গণতান্ত্রিক সংবিধানের রক্ষাকর্তার শপথগ্রহণ সত্ত্বেও তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক অভিহিত করতে সফলতা অর্জন করেছেন। হিন্দু জনগণ অনুভব করছে যে, তাদের ভাগ্য ও দেশ- উভয়ই মোদির হাতে ‘অন্যদের চেয়ে বেশি নিরাপদ’। বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, উগ্র জাতীয়তাবাদের দর্শন এগিয়ে যাচ্ছে, আর গান্ধীর সেকুলারিজম দর্শন পিছে পড়ে যাচ্ছে। যে শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সেকুলারিজমের দর্শনের ওপর কাজ করা উচিত, তারা উগ্র জাতীয়তাবাদের দর্শনের অনুসরণ করছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত শুধু গান্ধীর নীতির ওপর চলেই উন্নতি ও সফলতা অর্জন করতে পারে। বহুত্বের মাঝে ঐক্যের দর্শনই ভারতের মূল প্রাণ, যাকে নবজীবন দেয়ার জন্য কার্যকর সংগ্রামের প্রয়োজন।

লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস ২৬ মে,  ২০১৯ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব


আরো সংবাদ



premium cement