২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৬ শাবান ১৪৪৬
`

ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি

-

দেশে ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি এখন ভালোর দিকে। তবে ঋণ বিতরণে মন্দা চলছেই। তারপরও তারল্যসঙ্কট কাটছে না। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ব্যাংক খাত আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের আস্থা বৃদ্ধির কারণে ব্যাংক খাতের অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এ খাতের তারল্য আরো বাড়ানো যেত যদি পাচার ও দুর্বৃত্তায়ন রোধ করা যেত। যারা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ভয়াবহ ক্ষতি করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে তারা এখনো নানা জায়গা থেকে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে। এখনো অনেক ব্যাংক তারল্যসঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেও সুদের হার বেড়েছে।

ব্যাংকের নগদ টাকার সঙ্কট বাজারের ওপর প্রভাব ফেলে। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের জন্য ভোক্তাদের অস্থিরতার মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়। এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশে মূল্যস্ফীতি কমেছে, আরো কমবে। পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে আরো ভালো কিছুর প্রত্যাশা করছি।

পলিসি ঠিক থাকলে বাজার ঠিক থাকবে। ব্যাংকের রিজার্ভ সম্পর্কে বলেন, আমাদের রিজার্ভের পতন এখন আর নেই। একটু একটু করে বাড়ছে। আইএমএফের টাকা না এলেও নিজস্ব সক্ষমতায় আমরা রিজার্ভ বাড়াতে পারছি।

তিনি আরো বলেন, আমাদের রেমিট্যান্স এবং রফতানির প্রবাহ ভালো। রমজানের জন্য নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। গভর্নর আরো বলেন, আমাদের দেশে যত সমস্যা এখন রয়েছে, সাধারণত একসাথে এত সমস্যা কোনো দেশেই দেখা যায় না। তিনি মনে করেন, রাজস্ব খাতের ব্যর্থতা এক বছরের সরকার কখনোই সমাধান করতে পারবে না। ব্যাংকের তারল্যসঙ্কটের অন্যতম কারণ অবৈধ উপার্জন ও অর্থপাচার।

বিগত সরকারের আমলে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ও সুবিধাভোগী ব্যক্তি অবৈধভাবে উপার্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে নির্দেশনা দেন ব্যাংক-ডাকাতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার। যারা ব্যাংক ডাকাতির সাথে জড়িত, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। ব্যাংকের চুরি হওয়া টাকা উদ্ধারে এস আলম গ্রুপের সব সম্পদ জব্দ করার কথা জানা গেছে। ব্যাংকের টাকা যারা লুটপাট করেছে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে তাদের পাচার করা অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করতে হবে।

স্বৈরাচারী পতিত সরকারের আমলে ব্যাংক-ডাকাত তথা অর্থপাচারকারীরা যে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, নানা অনুসন্ধানে ক্রমেই তা প্রকাশ পাচ্ছে। অর্থপাচারের সুবিধার্থে এদের অনেকে আন্তর্জাতিক চক্রের সাথেও জড়িত হয়েছে। নাম-পরিচয় গোপন রাখতে বদলে ফেলেছে জাতীয়তাও। ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করেছে।
বলা বাহুল্য, দেশের ব্যাংক খাতসহ সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবণতার জন্য অর্থপাচার অনেকাংশে দায়ী। সন্দেহ নেই, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও অর্থপাচার অন্যতম প্রতিবন্ধক। অর্থপাচারকারীদের ধরতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব হবে, সময়ই তা বলে দেবে। তবে এ কথা ঠিক, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা অসম্ভব নয়। অর্থপাচারকারীরা অধিকাংশই বেনামে ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা করেছে। নানা স্তরে এদেরও রয়েছে সহযোগী। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অর্থপাচার সম্পর্কে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, দেশের অর্থনীতিকে শুকিয়ে ফেলা হয়েছে। পাচার হওয়া টাকার প্রকৃত পরিমাণ কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি-বিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি বলেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে সার্বিকভাবে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার শাসনের ১৫ বছরে কেবল বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থা থেকেই ১৭ বিলিয়ন বা এক হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। তবে অন্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শেখ হাসিনার আমলে পাচার অর্থের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন বা তিন হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশার শেষ নেই। সম্ভবত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক খাত। দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে বিগত স্বৈরাচারী সরকার ব্যাংক লুটে মরিয়া হয়ে ওঠে। ব্যাংক থেকে অর্থ লুট করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, লুট করা অর্থ বিদেশে পাচারে তারা নানা কৌশল অবলম্বন করে এবং নতুন নতুন পদ্ধতি বের করে। কখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট হ্যাক করে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিদেশের ব্যাংকে পাচার করে, কখনো নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের কোষাগার খালি করে আমানতকারীদের পথে বসিয়ে দেয়। ফলে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থার ভাটা পড়ে। আমানতকারীদের অর্থের সুরক্ষায় সরকার জনগণের অর্থ ব্যাংকে কখনো মূলধন হিসেবে আবার কখনো তারল্য সহায়তা হিসেবে সরবরাহ করে। এ অবস্থায় যারা অর্থপাচারের পেছনে রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। ব্যাংকের নগদ টাকার স্বাভাবিক লেনদেন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের মতো এবারো মুদ্রানীতিতে সঙ্কোচনমুখী ধারাই অনুসরণ করেছে।

এ দিকে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণের চড়া সুদ অব্যাহত রাখার কৌশলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। এতে বিনিয়োগ সঙ্কুচিত হবে। ব্যবসার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি বজায় রাখার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত উদ্বেগজনক। বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মুদ্রানীতির কঠোর অবস্থানের ফলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের মতে, উচ্চ সুদের হার ঋণের গতি কমিয়ে দেবে; পাশাপাশি পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। ফলে পণ্যমূল্য বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হার আরো বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এ দিকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো হলেও কমানো হয়েছে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আগামী জুনে অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, সরকারি-বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির নতুন এই লক্ষ্যমাত্রার ফলে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। বিনিয়োগের পরিবেশের কথা বলতে গেলে অধিকাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত নতুন করে বিনিয়োগে যাওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, কেউ যেতে চাইছেন না। বিশেষ করে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এখন দ্বিধাগ্রস্ত। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (প্রথম ছয় মাসে, জুলাই-ডিসেম্বর) উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৬৭.১১ শতাংশ। অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছে ২.২৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬.৯৮ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের অর্থ ছাড় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম। দেশের বিদ্যমান উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছেন না। অনেকের বড় ধরনের ব্যাংক ঋণ রয়েছে, সুদহার বাড়ার সাথে সাথে তার মধ্যে উদ্বেগও বাড়ছে। সরকার স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। এ কারণে এখন নতুন বিনিয়োগের চিন্তা কেউ করছে না। যে ক’জন উদ্যোক্তা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন, তারাও এখন ভয়ে আছেন। ফলে উৎপাদন ও বাণিজ্যপ্রবৃদ্ধি সঙ্কুচিত হয়েছে অন্তত ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। ব্যবসার পরিস্থিতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগের চেয়ে খারাপ। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও তার পরিবেশ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের জোর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে গার্মেন্ট খাতে উৎপাদন খরচ ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ব্যাংক সুদের হারও বেড়ে গিয়ে ১৪-১৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা শিল্প-কারখানাগুলোর জন্য অর্থনৈতিক চাপ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তো রয়েছে, যার ফলে পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প খাতে খরচ আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।

লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement