২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৫ শাবান ১৪৪৬
`

বিডিআর গণহত্যা : জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ

বিডিআর গণহত্যা - ছবি : সংগৃহীত

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে যাওয়া বিডিআর হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ধ্বংসাত্মক ঘটনা, যা জাতির মানসিকতায় এক অমোচনীয় দাগ রেখে যায়। প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই, এটা কোনো বিদ্রোহ ছিল না, ছিল একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বিডিআর সদস্যদের কিছু অসন্তুষ্টিকে পুঁজি করে একটি গণহত্যার পরিকল্পনা করা হয়, যা পুরো দেশ এবং অঞ্চলকে হতবাক করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৯ জন সিনিয়র কর্মকর্তার নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তি আক্রমণ ছিল না, বরং সীমান্ত রক্ষাকারী এই প্যারামিলিটারি বাহিনীর নেতৃত্ব কাঠামো ধ্বংসের একটি পরিকল্পিত ঘৃণ্য চক্রান্ত ছিল এটা।

বিডিআর গণহত্যা : এক নজিরবিহীন সঙ্কট
৩৬ ঘণ্টার মধ্যে বিডিআরের পুরো নেতৃত্বকে নির্মূল করা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। ঘটনার প্রথম থেকেই সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের টার্গেট করা হয়, যা নির্দেশ করে যে এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যেই এই হামলা চালানো হয়েছিল। সন্ত্রাসীরা শুধু হত্যা করেই থেমে থাকেনি; তারা সেনাকর্মকর্তাদের লাশ গুম করার চেষ্টা করেছে, যা ঘটনার পরিকল্পিত প্রকৃতিকে আরো স্পষ্ট করে।

এই নৃশংসতার পরপরই বিভিন্ন তত্ত্ব উঠে আসে, যা এই ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। সরকারিভাবে প্রচারিত ব্যাখ্যা অনুসারে, হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ ছিল বেতন, সুযোগ-সুবিধা এবং কাজের পরিবেশ সম্পর্কিত অসন্তোষ। তবে এটি অনেকের কাছেই যথেষ্ট যৌক্তিক মনে হয়নি। কারণ ইতিহাসে কোনো সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনীর বিদ্রোহ শুধুমাত্র আর্থিক কারণে এতটা সহিংস এবং সুসংগঠিতভাবে সংঘটিত হয়নি।

এই গণহত্যায় ভারতীয় সংযোগের সন্দেহ আরো দৃঢ় হয় কিছু নির্দিষ্ট কারণে। ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব শুধু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেই নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও পড়তে পারে। যদি এটি নিশ্চিত হয় যে এই হত্যাকাণ্ড বহিঃশক্তির দ্বারা উসকে দেয়া হয়েছিল, তবে এটি ভবিষ্যতে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির জন্য একটি বিপজ্জনক নজির হয়ে থাকবে। সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থায় বাইরের শক্তির সরাসরি হস্তক্ষেপ স্বাভাবিক হয়ে উঠলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিবেশ আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে।

পতিত স্বৈরাচারী সরকার নিজেদের ও তাদের বিদেশী প্রভুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য দায়সারাভাবে তদন্ত নামের প্রহসন করে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছে। এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং সঠিক বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ষড়যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং বাংলাদেশ তার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে পারে।

ভারতের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ : একটি দৃষ্টিভঙ্গি
বিডিআর অসন্তোষ এবং হত্যাকাণ্ড শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ওপর নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ভারতের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সন্দেহ সৃষ্টি হয়, যা কেবল দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উত্তেজনা বৃদ্ধি করে না, বরং আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। একটি অস্থিতিশীল বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হতে পারে, যা ভারত, মিয়ানমার এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য নতুন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এবং এর আশপাশের অঞ্চলের অস্থির প্রকৃতি বিবেচনায় নিলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত সহিংসতা এবং বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত, যেখানে রোহিঙ্গা সঙ্কট নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অন্য দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম রাজ্যেও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং জাতিগত সংঘর্ষের ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশের অস্থিরতা এসব অঞ্চলে নতুন মাত্রায় প্রভাব ফেলতে পারে, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে এবং বাইরের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা উন্মোচিত করেছে। সেটি ঘটে থাকলে কোনো দেশ তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না, কারণ পরবর্তী সময়ে অন্য রাষ্ট্র বা শক্তিশালী পক্ষ সামরিক কিংবা রাজনৈতিক উপায়ে হস্তক্ষেপের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারে।

পিলখানা হত্যায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস আরো বৃদ্ধি পায়, যা ভবিষ্যতের কূটনৈতিক আলোচনায় প্রভাব ফেলতে পারে। এটি শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রেই সত্য। এ ধরনের ঘটনা আরো বৃদ্ধি পেলে আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা, গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে, যা পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

সার্বভৌমত্ব রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে এই হত্যাকাণ্ড শুধু বিডিআর বা বাংলাদেশের নিরাপত্তার দুর্বলতাই নয়, বরং বৃহত্তর ভূরাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারতের সম্ভাব্য জড়িত থাকার ধারণা বাংলাদেশের সাথে এই দুই প্রতিবেশী দেশের জটিল এবং প্রায়ই বিতর্কিত সম্পর্কের মধ্যে প্রোথিত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের প্রধান সহযোগিতার ভূমিকা থাকলেও, সীমান্ত বিরোধ, পানি বণ্টন এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের মতো বিষয় নিয়ে সম্পর্কের টানাপড়েন রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, বিডিআর ম্যাসাকার ভারতের একটি সম্ভাব্য প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা দুর্বল করার লক্ষ্যে ঘটানো হয়েছে।

কয়েকটি কারণ সন্দেহ উসকে দেয়
প্রথমত, বিডিআর ভারতের সাথে সম্পর্কিত উত্তেজনা পরিচালনার প্রথম সারিতে ছিল। সীমান্তের সরল প্রকৃতি, পাশাপাশি অবৈধ অভিবাসন, চোরাচালান এবং আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের মতো সমস্যাগুলো প্রায়ই বিডিআর এবং ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিডিআরের নেতৃত্ব ধ্বংস একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা বাংলাদেশের সীমান্ত প্রতিরক্ষা ক্ষমতাকে দুর্বল করে তুলেছে এবং এর ফলে ভারতকে সীমান্ত এলাকায় বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের সুযোগ দেয়।

দ্বিতীয়ত, এই হত্যাকাণ্ডের সময়টি প্রশ্ন তুলেছে। হত্যাকাণ্ডটি তখনই ঘটেছিল যখন বাংলাদেশে সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনের পর একটি নির্বাচিত সরকার এসেছে। নতুন নির্বাচিত সরকার গণতান্ত্রিক নিয়মাবলি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়ায় ছিল এবং ঘটনাটি এই নাজুক স্থিতিশীলতা ধ্বংসের হুমকি দিয়েছিল। এ ঘটনার পরে যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, তা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিঃশক্তির প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দেয়। অনেক বাংলাদেশী বিশ্বাস করেন যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে, যা হত্যাকাণ্ডটিকে বাংলাদেশের নতুন সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের এবং তাদের ভারতীয় স্বার্থের সাথে সংযুক্ত রাখার একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভারতের জড়িত থাকার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না, বরং এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ভারতের কৌশলগত স্বার্থ থাকতে পারে। বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ও স্বাধীন নীতির ওপর তাদের অসন্তোষ নতুন নয়।

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারত এ ঘটনার মাধ্যমে একাধিক কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে।

১. জাতিসঙ্ঘের মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর ঈর্ষণীয় অংশগ্রহণ : বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করে আসছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছে। এটি ভারতের জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক চাপ তৈরি করেছে। ভারত নিজেও শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে, তবে বাংলাদেশের সেনাদের দক্ষতা ও আনুগত্যের কারণে জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন মিশনে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তৃত হোক এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হোক এটা ভারত চায় না।

২. পদুয়া ও রৌমারী ঘটনার প্রতিশোধ : ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অনেক সময়ই সঙ্ঘাত দেখা গেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পদুয়া ও রৌমারী সংঘর্ষ। পদুয়া সংঘর্ষ ২০০১ সালে ঘটে, যেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআর সদস্যরা ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

বাংলাদেশের সেনারা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই সংঘর্ষে লড়াই করে এবং বিএসএফের ক্ষতি সাধন করে, যা ভারতের জন্য অপমানজনক পরাজয় হিসেবে দেখা হয়। ভারত এই ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিল।

৩. বিডিআরের সক্ষমতা হ্রাস ও সীমান্ত দুর্বল করা : বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ফলে বাহিনীর কাঠামোতে বিশাল পরিবর্তন আসে এবং এটি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নামে পুনর্গঠিত হয়। বিডিআরের সক্ষমতা ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জন্য বড় বাধা ছিল।

এই হত্যাকাণ্ডের ফলে বিডিআর কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়। ভারত সীমান্তে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে এবং কৌশলগত সুবিধা নেয়ার সুযোগ পায়। সীমান্তবর্তী এলাকায় বাংলাদেশ দুর্বল হলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আরো সহজে অপারেশন পরিচালনা করতে পারে, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।

৪. সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা বন্ধ করা ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা : বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একটি বড় ধাক্কা দেয়া হয়, যা পরোক্ষভাবে সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।

ভারত চায়নি যে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী আরো শক্তিশালী হয়ে উঠুক, কারণ এটি ভবিষ্যতে ভারতের কৌশলগত পরিকল্পনায় বাধা হতে পারে। এ ঘটনার ফলে সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দুর্বল করে।

পরবর্তী ঘটনা : নিরাপত্তা প্রভাব
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী পরিস্থিতি দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এক গভীর সঙ্কট সৃষ্টি করে। হত্যাকাণ্ডের পরপরই অসংখ্য বিডিআর সদস্য নিজেদের শৃঙ্খলাবদ্ধ দায়িত্ব পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায়, যা শুধু বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাই নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। পালিয়ে যাওয়া বিডিআর সদস্যদের একটি বড় অংশ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সাথে নিয়ে যায়, যা সীমান্তবর্তী অঞ্চলসহ দেশের নিরাপত্তায় নতুন হুমকি সৃষ্টি করে। বিডিআরের সক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় অবৈধ অনুপ্রবেশ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়ে। তা ছাড়া, রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় শক্তির স্বার্থ জড়িত থাকায় এই দুর্বলতা ভিন্ন ভিন্ন মহলে কৌশলগত সুবিধা তৈরি করতে পারে। সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তাহীনতা কেবল বাংলাদেশকেই নয়, পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।

এই সঙ্কট দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও নিরাপত্তা নীতির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। বিডিআরের পুনর্গঠন এবং এর কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করা একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যাতে সীমান্ত নিরাপত্তা পুনরায় শক্তিশালী হয় এবং বাহিনীকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম করে তোলা যায়। একই সাথে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সীমান্তবর্তী অপরাধ দমন, অস্ত্র চোরাচালান রোধ এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিহত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

সতর্কতা এবং ঐক্যের প্রয়োজন
বাংলাদেশ বর্তমানে এমন এক সঙ্কটের মুখোমুখি যা শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, বাইরের প্রভাবেও জটিল হয়ে উঠেছে। বিডিআর হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করেছে যে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি সুপরিকল্পিত ঘটনা হতে পারে, যার সম্ভাব্য উদ্দেশ্য ছিল দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করা এবং সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে অবিশ্বাসের বীজ বপন করা। তাই ঘটনাটি হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই, বরং এর প্রতিটি দিক খুঁটিয়ে দেখা দরকার।

বিডিআর সদস্যদের অসন্তোষের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল এবং কারা এর পেছনে ছিল, তা নির্ধারণ করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি শুধু বাহ্যিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বোঝা যাবে না, বরং গভীর ও বিশদ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে হবে। যদিও অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ এবং বিডিআর সদস্যদের দাবি-দাওয়া আমলে নেয়া জরুরি, তবুও ভারতের সম্ভাব্য সম্পৃক্ততার বিষয়টি উপেক্ষা করা হবে কৌশলগত ভুল। ইতিহাস এবং ভৌগোলিক বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে এটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে, এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে ভারত সবসময়ই একটি শক্তিশালী প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশকে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিডিআরের পুনর্গঠন এবং এর ওপর জনগণের আস্থার পুনরুদ্ধার এখন জরুরি। এটি করার জন্য শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত যথেষ্ট নয়; বরং সামগ্রিকভাবে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

সেই সাথে বলা দরকার, কেবল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করাই যথেষ্ট নয়, বরং কূটনৈতিকভাবে দূরদর্শী নীতি গ্রহণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে জটিল এবং বহুস্তরীয়, যেখানে পারস্পরিক সহযোগিতার পাশাপাশি আস্থার অভাব এবং কিছু পুরনো বিরোধও রয়েছে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে বাংলাদেশকে ভারতের সাথে সুপরিকল্পিত ও কৌশলগত সংলাপে প্রবেশ করতে হবে, যাতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে সুসংহত ও টেকসই সমাধান খোঁজা যায়। এটি শুধু সামরিক বা প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা খাতে আরো গভীর সমঝোতা তৈরি করার দিকেও নজর দিতে হবে।

এমন সঙ্কটের মুহূর্তে জাতীয় ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। জনগণ, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং কূটনৈতিক মহলকে এখন একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ষড়যন্ত্র ও অস্থিতিশীলতার প্রচেষ্টা প্রতিহত করা যায়। বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার জন্য ধৈর্য, কৌশল এবং দৃঢ় সঙ্কল্পের সাথে এগিয়ে যেতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement