বইমেলা প্রবর্তনের ইতিহাস-ঐতিহ্য
- ড. আবদুল আলীম তালুকদার
- ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০:৫৭
আধুনিক বিশ্বে পণ্য বেচাকেনা, বিপণন ও পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য জাঁকজমকের সাথে নানা নামে নানা রকমের মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। আর পৃথিবীব্যাপী যত রকম মেলা অনুষ্ঠিত হয় তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ মেলা হলো বইমেলা। কারণ এখানে লেখক-পাঠকদের মহামিলন ঘটে, ভাব ও মতবিনিময় হয়, জ্ঞানের বিস্তার, মেধার পরিশীলন ঘটে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ মেলার আয়োজন করা হয়। এসব মেলায় লাখো বইপ্রেমী আবালবৃদ্ধবনিতা ভিড় করেন। বইমেলা বইপ্রিয় মানুষের প্রাণে দোলা দেয়, তাদের মনের খোরাক জোগায়, অনুরণিত করে তাদের মন-মনন। তেমনিভাবে ‘অমর একুশে বইমেলা’- আমাদের প্রাণের মেলা। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য জীবনদানকারী শহীদদের স্মৃতি অমøান করে রাখার জন্যই এই মেলার আয়োজন করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে লেখক-পাঠক, শিশু-বৃদ্ধ- সবার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ফেব্রুয়ারিজুড়ে চলা অমর একুশে বইমেলা। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের উৎসর্গ করে এ বছর অমর একুশে বইমেলার থিম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বছরের বইমেলার প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’।
একটি জাতির মেধা ও মননের আঁতুড়ঘর হলো তার বইয়ের জগত বা লাইব্রেরি। একই সাথে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তথা জাতির সব মেধার সংগ্রহশালাও হলো লাইব্রেরি। সময়ের প্রয়োজনে এই সংগ্রহশালাকে মেলার মধ্য দিয়ে প্রদর্শন বা প্রচার করা হয়ে থাকে। পৃথিবীতে বই সংগ্রহের রীতিটা বেশ পুরনো। ধারণা করা হয়, দার্শনিক সক্রেটিসের সমসাময়িককালেও বই সংগ্রহের রীতিটা চালু ছিল। প্রাচীন চৈনিক সভ্যতায়ও বই পড়া ও সংগ্রহের রেওয়াজ ছিল।
বইমেলার প্রথম সূচনা ঘটে ইউরোপে। ত্রয়োদশ শতকে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের ডাডলি মেট্রোপলিটন বরোতে অবস্থিত বাজার শহর স্টোরব্রিজের মেলায় বইয়ের সমাবেশ ঘটানো হয়েছিল। ওই মেলায় অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি বইয়ের স্টল ছিল। তার নাম ছিল ‘বুক সেলার্স রো’।
খ্রিষ্টীয় ১৫ শতকে জোহানস গুটেনবার্গ প্রথম মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কার করেন। বলা হয়, সেই সময় থেকেই বইমেলার সূচনা হয় জার্মানিতে, যা ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা নামে সুপরিচিত। মাত্র পাঁচ দিনের বইমেলা। প্রথম তিন দিন ব্যবসায়ীদের জন্য। পরের দু’দিন সবার জন্য উন্মুক্ত। অনেকের মতে, জার্মানির লিপজিগ শহরে প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। তবে ১৮০২ সালে ম্যাথু কেরির উদ্যোগে প্রথম পূর্ণাঙ্গ বইমেলার আসর বসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। ১৮৭৫ সালে প্রায় ১০০ জন প্রকাশক মিলে নিউইয়র্কের ক্লিনটন শহরে আয়োজন করে বৃহৎ এক বইমেলার। ১৯৪৯ সালে শুরু হয় জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে বৃহৎ বইমেলা যা পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বইমেলায় রূপ নেয়। সেখান থেকেই আধুনিক বইমেলার শুভযাত্রা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে দেশে বইমেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৭৬ সালে প্রবর্তিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বইমেলা ১৯৮৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে। আমাদের বাংলাদেশে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে। বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি)। এটি ছিল মূলত শিশু গ্রন্থমেলা। আয়োজন করেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদদীন। অনুমান করা হয়, এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা।
পরে ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন তিনি। ওই বইমেলায় তিনি এক অবিশ্বাস্য মজার কাণ্ড করেছিলেন। পাঠকদের আকৃষ্ট করার জন্য মেলার ভেতরে একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে দিয়েছিলেন, ‘আমি বই পড়ি না’। ওই ঘটনাটি সে সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং পাঠকদের হৃদয়ে দাগ কাটে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমিতে অমর একুশের অনুষ্ঠানে কোনো বইমেলা হয়নি। সেবার একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসে কিছু বই বিক্রি করেন। ওই সময় বর্ণমিছিলের প্রকাশক তাজুল ইসলামসহ আরো সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্বদিকের দেয়াল ঘেঁষে বই সাজিয়ে বসেন। আবার একই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তধারার প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় চটের ছালা বিছিয়ে তার উপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রাথমিক উপাদান ছিল এই বইগুলো।
১৯৭২-৭৬ সাল পর্যন্ত এভাবেই বইমেলা চলতে থাকে। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মেলা উপলক্ষে ১৫ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমির প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স কর্তৃপক্ষের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো কেউ কেউ বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির উদ্যোগ নেয়।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক বিশিষ্ট কবি ও ফোকলোরবিদ ড. আশরাফ সিদ্দিকীর সক্রিয় ভ‚মিকায় বাংলা একাডেমিকে মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করা হয়। বাংলা একাডেমির সক্রিয়তার ফলেই সেই বইমেলা আজকের এই গৌরবময় অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৯ সালে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। ওই সময় ৭ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৮১ সালে বইমেলার মেয়াদ ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন করা হয়। এর পর প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২ সালে মেলার মেয়াদ আবার ২১ দিনে বৃদ্ধি করা হয়। তখন মেলার প্রধান উদ্যোক্তা বাংলা একাডেমি আর সহযোগিতায় ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।
১৯৮৩ সালে কবি মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করলেও সে সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সে বছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। বাংলা একাডেমি চত্বরে স্থান সঙ্কুুলান না হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমি চত্বর ছাড়াও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স¤প্রসারিত করা হয়।
বর্তমানে বাংলা একাডেমি এক মাসব্যাপী একুশে বইমেলা আয়োজনের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছে। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই দীর্ঘ এক মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় না বলেই আমরা জানি। এ দিক থেকে দেখতে গেলে এটি পৃথিবীর দীর্ঘদিনব্যাপী আয়োজিত একটি বইমেলা।
বইমেলা শুধু এক মাসের একটি কর্মযজ্ঞ নয়; বরং বইমেলার সময় পাঠক ও দর্শনার্থী মহলে যে আগ্রহ, আকাক্সক্ষা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের উন্মেষ ঘটে, তা যেন তাদের সারা বছরের চিন্তা, দর্শন ও কর্মে প্রতিফলিত হয়- সেটিই প্রত্যাশা। পাশাপাশি বইমেলায় প্রকাশিত বই যেন সারা বছর প্রচার, প্রসার ও বিক্রি হয় এবং প্রকাশিত বইগুলো পাঠকমহলের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারে এটিও মুখ্য বিষয়।
বইমেলার সূচনা হয়েছিল একটি জ্ঞানভিত্তিক আলোকিত সমাজ গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা ও জন-আকাক্সক্ষা থেকে। বইয়ের কোনো বিকল্প নেই জ্ঞান অনুশীলনে, জীবনবোধ অর্জনে। যেকোনো আদর্শে আলোকিত আদর্শিক মানুষ গড়ে তোলায় এ মেলার গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের চেতনা বইমেলার সর্বত্র প্রতিফলিত হোক, বই হোক আমাদের সবার নিত্যসঙ্গী- এই প্রত্যাশা নিরন্তর।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা