২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ২১ শাবান ১৪৪৬
`

বাংলাদেশে তিস্তা ব্যারাজের সুফল

-

বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি, সেচ, জলজসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হতে পারে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের একটি বৃহৎ অংশের মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে। এর সম্ভাব্য প্রধান সুফলগুলো নিয়ে আজকের আলোচনা।

তিস্তা ব্যারাজে সেচসুবিধা

উত্তরাঞ্চলের সেচসুবিধা প্রসার : রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের কৃষিজমি তিস্তা ব্যারাজের সেচসুবিধার আওতায় আসবে। বিশেষত খরাপ্রবণ এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় সেচনির্ভর ফসল উৎপাদন বাড়বে। ধান, গম, ভুট্টা ও ডাল-জাতীয় ফসলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। সেচসুবিধা নিশ্চিত হলে বছরে অন্তত দু’-তিনটি ফসল ফলানো সম্ভব হবে।

উত্তরাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকাগুলোতে কৃষিকাজ অনেকাংশে বৃষ্টিনির্ভর। তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সেই নির্ভরশীলতা দূর করবে।
বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি : সেচসুবিধার মাধ্যমে বোরো ধানের ব্যাপক উৎপাদন হবে। এটি বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সেচের অভাবে যেসব জমি পতিত থাকে সেগুলো চাষের আওতায় আসবে।

সেচসুবিধার কারণে কৃষকরা তাদের জমিতে একাধিক ফসল ফলানোর সুযোগ পাবেন। এর ফলে তাদের আয় বাড়বে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নত হবে। গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

পানি সংরক্ষণ ও সুষম বিতরণ : তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে পানির সংরক্ষণ, সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে, যা কৃষি উৎপাদন আরো টেকসই করবে।

প্রভাব

তিস্তা ব্যারাজের সেচসুবিধা পেলে উত্তরাঞ্চল খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেশের শীর্ষস্থানীয় অঞ্চলে পরিণত হবে। কৃষি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে স্থানীয় বাজারে পণ্য সরবরাহ বাড়বে এবং কৃষিপণ্য রফতানির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা : সেচের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য, শাকসবজি ও ফল উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে। খাদ্যশস্যের বৈচিত্র্যের ফলে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা : উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও সরবরাহ শুধু স্থানীয় পর্যায়ে নয়; বরং জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে বাজারের চাহিদা পূরণ ও মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে।

তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ

পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ : তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণ এবং তা সঠিকভাবে নিষ্কাশনের মাধ্যমে বন্যার তীব্রতা কমানো যাবে। নদীর তীরবর্তী এলাকা, যেমন নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের মতো অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।

তিস্তা ব্যারাজ সিস্টেম পানির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই এলাকাগুলোর কৃষি ও বসতবাড়ি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
জীবনযাত্রার নিরাপত্তা : বন্যা নিয়ন্ত্রণের সুবিধা গ্রামীণ এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা নিরাপদ ও স্থিতিশীল করবে। বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে।

কৃষিজমির সুরক্ষা : বর্ষায় অতিরিক্ত পানিতে জমি প্লাবিত হয়ে ফসল ধ্বংসের ঝুঁকি তৈরি করে। তিস্তা ব্যারাজ এই সমস্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে এবং কৃষকদের জমির সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।

মাটির ক্ষয়রোধ : বন্যার ফলে নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটি ক্ষয় হয়, যা কৃষি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তিস্তা ব্যারাজ মাটির ক্ষয় রোধে সাহায্য করবে, ফলে কৃষিজমির উর্বরতা বজায় থাকবে।

আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে কৃষকের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নতি ঘটবে। কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। কৃষকদের জন্য উন্নত প্রযুক্তি এবং সেচ উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। এতে কৃষকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং তারা অধিক লাভবান হবেন।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি : তিস্তা ব্যারাজের কারণে কৃষি, সেচ, মৎস্য চাষ ও পানিনির্ভর প্রকল্পে কাজের সুযোগ বাড়বে, বিশেষত কৃষক, শ্রমিক ও সেচব্যবস্থাপনায় যুক্ত পেশাজীবীদের মধ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। মৎস্যচাষে তিস্তা ব্যারাজের জলসেচ ও পানি নিয়ন্ত্রণের ফলে স্থানীয় জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি হবে, যা নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

মৎস্যচাষের বিকাশ : তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে পানি নিয়ন্ত্রণ এবং জলাশয়ের উন্নয়ন মৎস্যচাষের জন্য উপকারী হয়ে উঠবে। মৎস্যচাষে জড়িত মানুষের আয় বাড়বে এবং স্থানীয় বাজারে মাছের সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি হবে।
পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের সুরক্ষা : তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে পানি ব্যবস্থাপনার উন্নতি হবে, যা কৃষি ও জলজ সম্পদের সঠিক ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেবে। এটি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা ও মাটির সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, যা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক।

সামাজিক উন্নয়ন ও শিক্ষা : আঞ্চলিক উন্নয়ন ঘটানোর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য মৌলিক সেবা উন্নত হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামীণ অঞ্চলের জনগণের জীবিকা উন্নত হবে। সমাজে নতুন আশার সঞ্চার হবে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থানীয় বাজারের প্রসার : সেচসুবিধা বৃদ্ধির কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি বাড়বে। স্থানীয় বাজারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে। স্থানীয় পণ্য বিক্রয়, পরিবহন এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের বিকাশ ঘটবে।

জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা

তিস্তা ব্যারাজের জলস্তরের নিয়ন্ত্রণ এবং নদীর পানির প্রবাহের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যারাজের বাঁধে পানির উচ্চতা এবং প্রবাহের পরিবর্তন দ্বারা একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে পরিমিত পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতে পারে, যা দেশের বিদ্যুৎচাহিদা মেটাতে সহায়ক হতে পারে।

জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের সুবিধা : জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম। এটি পরিবেশের উপর কম প্রভাব ফেলে, কারণ এতে কার্বন নিঃসরণের সমস্যা নেই।

স্থিতিশীলতা : জলবিদ্যুৎ একটি স্থিতিশীল এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানির উৎস, যা দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সুবিধাজনক।

অর্থনৈতিক উপকারিতা : বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কৃষি ও শিল্প খাতে আরো উন্নতি হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে শিল্প স্থাপনের সুযোগ তৈরি হবে।

যোগাযোগ ও পর্যটনে ভূমিকা

তিস্তা ব্যারাজের চারপাশের প্রকৃতি, জলাশয় ও নদী ব্যবস্থাপনা এর পর্যটন আকর্ষণ বাড়িয়ে ফেলবে। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এই স্থানটি দেখতে আসবে, বিশেষ করে প্রকৃতিপ্রেমী, পরিবেশবিদ ও নদীভ্রমণপ্রিয় পর্যটকরা এখানে আসবে।

স্থানীয় জনগণের জন্য আয়ের সুযোগ সৃষ্টি : তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় পর্যটকদের আগমন স্থানীয় ব্যবসায়ী, গাইড, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য পর্যটনসংশ্লিষ্ট শিল্পে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। পর্যটন খাতের বিকাশের ফলে স্থানীয় মানুষের আয় বাড়বে। ছোট হোটেল, রেস্তোরাঁ ও পর্যটনকেন্দ্রের মাধ্যমে স্থায়ী আয় সৃষ্টি হবে।

অবকাঠামোর উন্নতি : তিস্তা ব্যারাজ অঞ্চলে পর্যটন বৃদ্ধির ফলে যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নতি ঘটবে। রাস্তা-ঘাট, সেতু, যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়ার মাধ্যমে এই এলাকার লোকজন এবং পর্যটকদের যাতায়াত সহজ হবে। স্বাস্থ্যসেবা, পানীয় জল, বাজারব্যবস্থা ও অন্যান্য সেবা খাতের অবকাঠামোর উন্নয়ন হবে।

বাজার সম্প্রসারণ ও ব্যবসায়িক সুযোগ : পর্যটন খাতের প্রসারে স্থানীয় শিল্প ও ব্যবসায়িক সুযোগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হবে। পর্যটকদের জন্য হস্তশিল্প, স্থানীয় খাবার ও অন্যান্য দ্রব্য বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা নতুন আয় তৈরিতে সক্ষম হবে। পর্যটন খাতের বিস্তার দেশের, বিশেষত স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সতর্কতা ও পরিবেশ সংরক্ষণ : তিস্তা ব্যারাজ আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হয়ে উঠলে সেখানে পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টি সামনে আসবে। পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পর্যটন খাতের মধ্যে ভারসাম্য রাখা জরুরি।

বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিগত সরকারগুলো তিস্তা ব্যারাজের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা টালবাহানা করেছে। এমনকি ভারতের অন্যায্য ও আন্তর্জাতিক আইন অমান্যের জন্য কোনো সরকার কড়া প্রতিবাদ বা ভারতকে বিচারের কাঠগড়ায় নিতে পারেনি। এখন সময় এসেছে এ বিষয়ে অবিলম্বে কার্যকর ও বাস্তব কর্মসূচি হাতে নেয়ার।

লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি,
নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি
e-mail : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
ভাষা শহীদদের প্রতি বাংলাদেশ আইন সমিতির শ্রদ্ধা এটিএম আজহারের মুক্তির দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে গণঅবস্থান করবে জামায়াত ভারত কি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে রাজি হবে? বন্দী শিরি বিবাসের পরিবর্তে ‘গাজার এক নারীর’ লাশ দিয়েছে হামাস, দাবি নেতানিয়াহুর কালীগঞ্জে ইয়াবা ও গাজাসহ আটক ২ ভালুকায় ভেকুতে দুর্বৃত্তদের আগুন ক্লাসরুম মাতাবে প্রীতম ও ব্যান্ড লালন সীতাকুণ্ডে হত্যার পর সমুদ্রে ফেলে দেয়া জেলের লাশ উদ্ধার বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে : হামিদুর রহমান আযাদ দামুড়হুদা সীমান্ত থেকে প্রায় ৩৪ লাখ টাকার রুপা উদ্ধার চিরিরবন্দরে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় এক ব্যক্তি নিহত

সকল