২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭ ফাল্গুন ১৪৩১, ২০ শাবান ১৪৪৬
`

বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য ও ভারতীয় মিডিয়ার অপপ্রচার

- ছবি : নয়া দিগন্ত

সকালে মোবাইল ফোনে একটি পত্রিকার অনলাইন নিউজ দেখে ভীষণ অবাক হলাম। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি লিখেছে, তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান করার ভার আমি প্রধানমন্ত্রী মোদির ওপর ছেড়ে দিলাম।’

ভাবলাম, এটা কিভাবে সম্ভব! আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পক্ষে এমন বক্তব্য কিভাবে প্রকাশ্যে দেয়া সম্ভব। বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান করার ভার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দেয়ার তিনি কে? ভাবলাম, ঠিক দেখছি তো?

খবরটার বিস্তারিত পড়ে বুঝলাম, আমেরিকা সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় সভা শেষে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পর্কে একজন ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই কথা বলেছেন। ভাবলাম, তিনি যেভাবে হুটহাট এটা ওটা বলে বসেন, তাতে এমন কথা বলতেও পারেন। যদি তিনি সেটি বলে থাকেন তবে তা খুবই আপত্তিকর, একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সমস্যা সমাধানের ভার ভিন্ন একটি দেশের সরকারপ্রধান তৃতীয় একটি দেশের সরকারপ্রধানকে দেবেন কোন অধিকারে!

ঘোর কাটল না। ঘটনাটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক আকারে সামনে এলো। কারণ এটি এমন একটা সময়ে ঘটছে যখন বাংলাদেশের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন এবং চুক্তি থাকা সত্তে¡ও তাকে প্রত্যর্পণের ব্যাপারে ভারত বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে সাড়া দিচ্ছে না। আরো কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা ঘাঁটলাম। দেখি, অন্তত গোটা দুই পত্রিকা লিখেছে, ট্রাম্প সাংবাদিককে বলছেন, ‘বাংলাদেশ ইস্যুটি আমি প্রধানমন্ত্রীর (মোদি) ওপর ছেড়ে দেবো।’ অন্য একটি পত্রিকাও একই ধরনের অর্থাৎ ‘ইস্যুটি মোদির ওপর ছেড়ে দেয়ার’ কথা লিখেছে।

ভাবলাম, ট্রাম্প আসলে কী বলেছেন তা, তার মুখ থেকে শুনলে কেমন হয়। খুঁজতে খুঁজতে ইউটিউবে যৌথ সংবাদ সম্মেলনটি পেয়ে গেলাম। কিন্তু খোঁজার পথে দেখলাম, কয়েকটি বিদেশী, বিশেষত প্রভাবশালী ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ইউটিউব চ্যানেলে ওই ঘটনা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন, মোদি বাংলাদেশ নিয়ে যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা লাভ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, India Today তাদের ইউটিউব চ্যানেলের শিরোনাম করেছে, ‘I’LL LEAVE BANGLADESH TO PM MODI’ Donald Trump. আরো এক কদম এগিয়ে, ‘I’LL LEAVE BANGLADESH TO PM MODI...’ TRUMP DECLARATION.
আর এসব ভিডিওর পরিপ্রেক্ষিতে যেসব মন্তব্য করা হচ্ছে সেগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সরকারবিরোধী।

এবার ট্রাম্প প্রকৃতপক্ষে কী বলেছেন সে প্রসঙ্গে আসা যাক। এটা ঠিক যে, ট্রাম্প বলেছেন, ‘I’LL leave Bangladesh to PM Modi’, কিন্তু তা দিয়ে তিনি যা বুঝিয়েছেন তা মোটেও India Today ev Hindustan Times-এর বয়ানের মতো নয়।

একজন সাংবাদিক (যিনি সম্ভবত ভারতীয় কারণ তিনি এমন ইংরেজি বলছিলেন যা আর একজন আবার ট্রাম্পকে ইংরেজিতে বলে দিচ্ছিলেন) বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ক্ষমতা পরিবর্তনে আমেরিকার ভেতরের কোনো শক্তির (deep state) ভূমিকা আছে কিনা তা ট্রাম্পের কাছে জানতে চান; বিশেষ করে যখন ‘জুনিয়র সরোস সম্প্রতি মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করেছেন’। উল্লেখ্য, হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত বিলিয়নিয়ার জর্জ সরোসের ছেলে, ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যালেক্স সরোস যিনি স¤প্রতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করেছেন। আরো উল্লেখ্য, ভারতীয় মিডিয়া জর্জ সরোসকে ভারতবিরোধী বলে প্রচার করে থাকে।

যাই হোক, এ প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প যা বলেছেন তা কিছুটা হাস্যকর শুনালেও তিনি মূলত বলতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের সা¤প্রতিক ক্ষমতা পরিবর্তনে আমেরিকার ভেতরের কোনো শক্তির ভূমিকা নেই। তিনি আরো বলতে চেয়েছেন, সরোস সম্পর্কে তিনি তেমন কিছু জানেন না। এজন্যে ট্রাম্প বাংলাদেশ বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ভার নরেন্দ্র মোদির ওপর ছেড়ে দেন। বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছেন সম্ভবত এ কারণে যে, প্রতিবেশী হওয়ায় বাংলাদেশের ব্যাপারে তিনি ট্রাম্পের চেয়ে বেশি জানেন। ট্রাম্প এও বলেছেন, এটি এমন একটি ব্যাপার যার ওপর নরেন্দ্র মোদি বহু বছর ধরে কাজ করছেন। এখানে এটি এমন একটি ব্যাপার বলতে তিনি হয়তো বাংলাদেশের ক্ষমতা পরিবর্তনের কথাই বুঝিয়েছেন। কারণ, এর আগের বাক্যে তিনি বাংলাদেশের সা¤প্রতিক ক্ষমতা পরিবর্তনে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে কথা বলছিলেন। তার মুখ থেকেই শোনা যাক। তিনি (ট্রাম্প) বলছেন, ‘Well there’s no role for our deep sate, I would say. This is something that the prime minister (Modi) has been working for a long time, and he’s been ‘worked’ on it for hundreds of years, frankly I haven been reading about it. I will leave Bangladesh to the Prime Minister Modi’.

ওই যে বলছিলাম, ট্রাম্পের উত্তর কিছুটা হাস্যকরও বটে। তিনি যখন বলছেন, মোদি না কি বিষয়টির উপর শত শত বছর ধরে কাজ করছেন, তখন না হেসে উপায় থাকে না। অনেকটা মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। আসলে মাথা যে কার খারাপ, বোঝা মুশকিল।

তবে ভারতীয় প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো যে ঠাণ্ডা মাথায় বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের থামারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং বাংলাদেশেরও কতিপয় ইংরেজি দৈনিক ভারতীয় সুরেই নিউজটি পরিবেশন করেছে যা অনিচ্ছাকৃত ভুল বলে ধরে নেয়ার অবকাশ নেই।

অন্যদিকে এসব অপপ্রচারের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত পদক্ষেপ মোটেই যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমও বিষয়টির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের বাইরে থেকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন সংঘবদ্ধ অপপ্রচার বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করাসহ, কূটনৈতিক সম্পর্ক, বৈদেশিক বিনিয়োগ, রফতানি ও কর্মসংস্থানের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি কোনো নির্দিষ্ট দেশে বা অঞ্চলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন জনমত গড়ে উঠতে পারে। কারণ, যারা প্রকৃত অবস্থা জানেন না তারা খুব সহজেই অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হন।

সংঘবদ্ধ অপপ্রচার বৈদেশিক বেসরকারি পর্যায় থেকে হলেও তা অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই; অপপ্রচারের ধরন অনুযায়ী তা মোকাবেলায় যথাসময়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক


আরো সংবাদ



premium cement