২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭ ফাল্গুন ১৪৩১, ২০ শাবান ১৪৪৬
`

বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ও উন্নয়ন

- ছবি : নয়া দিগন্ত

যেকোনো দেশে ব্যক্তি বা বেসরকারি বিনিয়োগই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগ, বেসরকারি ব্যবসা-শিল্প বিশেষ অবদান রাখছে। যে দেশ যত ব্যবসাবান্ধব, সেই দেশের অর্থনীতি তত সমৃদ্ধ। দেশের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণের ও সক্ষমতা তৈরি করতে না পারলে, পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমাতে না পারলে এলডিসি উত্তরণকালে অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। দেশে বেকারত্বের হারও বেড়ে যাবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এখনো স্বস্তি নেই। এ ছাড়া ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়ও বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারের জোর চেষ্টা থাকলেও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি, বরং কমছে। চাহিদা কমে সংকুচিত হয়ে আসছে জনসাধারণের ভোগ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গ্রহণ করা হয়েছে কঠোর মুদ্রানীতি। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো হলেও কমানো হয়েছে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বর ২০২৪ শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আগামী জুনে অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে সরকারি-বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির নতুন এই লক্ষ্যমাত্রার ফলে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। বিনিয়োগের পরিবেশের কথা বলতে গেলে অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা মনে করেন রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত নতুন করে বিনিয়োগে যাওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, কেউ যেতে চাইছেন না। বিশেষ করে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এখন দ্বিধাগ্রস্ত। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (প্রথম ৬ মাসে, জুলাই-ডিসেম্বর) উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৬৭.১১ শতাংশ; অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছে ২.২৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬.৯৮ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের অর্থছাড় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, এ সময় বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ৩.৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪.০৬ বিলিয়ন ডলার। এ দিকে দেশের বিদ্যমান উদ্যোক্তাতারা বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছেন না। অনেকের বড় ধরনের ব্যাংক ঋণ রয়েছে, সুদহার বাড়ার সাথে সাথে তার মধ্যে উদ্বেগও বাড়ছে। সরকার স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। এ কারণে এখন নতুন বিনিয়োগের চিন্তা কেউ করছে না। যে ক’জন উদ্যোক্তা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন, তারাও এখন ভয়ে আছেন। ফলে উৎপাদন ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি সঙ্কুচিত হয়েছে অন্তত ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। ব্যবসার পরিস্থিতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগের চেয়ে খারাপ। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও তার পরিবেশ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের জোর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে গার্মেন্ট খাতে উৎপাদন খরচ ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ব্যাংক সুদের হারও বেড়ে গিয়ে ১৪-১৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা শিল্প কারখানাগুলোর জন্য অর্থনৈতিক চাপ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তো রয়েছে, যার ফলে পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প খাতে খরচ আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। রাজনৈতিক পালাবদল কোন দিকে যায়, তা দেখার জন্য বিনিয়োগকারীরা এখন অপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দ্রুত সমাধান করা না হলে বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ হারাতে পারে। এতে দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকা ও নীতিগত অনিশ্চয়তার থাকলে বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা উৎসাহ পাবেন না।

সম্প্রতি বেপজার এক সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়, এ পর্যন্ত বেপজার ইপিজেডগুলোতে ৩৮টি দেশ থেকে বিনিয়োগ এসেছে। সবচেয়ে বেশি এসেছে চীন থেকে। চীনের মোট ১০৮টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে ইপিজেডে। এরপর বিনিয়োগ করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ৬১টি, জাপানের ২৯টি, ভারতের ১৯টি, যুক্তরাজ্যের ১৯টি, যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি ও শ্রীলঙ্কার ৭টি প্রতিষ্ঠান।

বর্তমানে আটটি ইপিজেড ও বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চলে মোট ৪৪৯ শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। এর মধ্যে শতভাগ বিদেশী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ২৫৮টি, যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ৪৯টি ও শতভাগ দেশীয় প্রতিষ্ঠান ১৪২টি। ইপিজেডগুলোতে বৈশ্বিক ও দেশের অভ্যন্তরীণ নানা কারণে গত ছয় মাসে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২২ শতাংশ কমে গেছে। বিনিয়োগ যেকোনো দেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নতির একটি বড় বিষয়। দেশের অর্থনীতি নানা রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। শিল্প, ব্যবসা, বিনিয়োগ সব কিছুই যেন তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঘোষিত মুদ্রানীতি আর্থিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা মুদ্রানীতিতে তুলে ধরা হয়। এবারের ঘোষিত নীতিতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে ঋণ নেয়ার সুযোগ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে (রিজার্ভ মানি) মুদ্রার সরবরাহ বাড়াবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ হলেও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য শুধু মুদ্রানীতির ওপর নির্ভর করলে হবে না। বিনিয়োগ সহজে পাওয়া ও আদায়ের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা থাকতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা জোরালো করতে হবে। পুরনো ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উদ্যোক্তাদের নিয়ে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে তুলতে হবে।

অর্থপাচার বন্ধ করতে হবে। শিল্প খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরো বেগবান করতে হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিরাট ক্ষেত্র হলো গ্রামীণ অর্থনীতির খাত। ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। একজন ব্যবসায়ী একাধারে বিনিয়োগকারী, ঝুঁকি গ্রহণকারী, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী এবং সর্বোপরি দেশের দ্রব্য ও সেবা সরবরাহকারী। দেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে আসে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না, এমনকি বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। বেকারদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে দরকার বিনিয়োগ, এ জন্য দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

যে খাতে অতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, সেটি হচ্ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। এ খাতের স্বাভাবিক অবস্থার সাথে জড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার বিষয়টি। কাজেই এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যা দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের পরিবেশ নিরাপদ করবে।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
ইমেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement