১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩ ফাল্গুন ১৪৩১, ১৬ শাবান ১৪৪৬
`

নির্বাচনের আগে বিএনপির সংস্কার প্রয়োজন

-

[ শেষ পর্ব ]

গত লেখায় আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম যে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি আদৌ আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা ছিল কি না। এর আগে আরেকটি লেখায় আমরা যুক্তি দিয়েছিলাম, ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের ডিএনএতে প্রোথিত। যদিও আমি বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করার অবস্থানে নেই, তবে কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য এবং সহিংস কর্মকাণ্ড আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান দলের নেতাকর্মীদের অন্যায় এবং অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ভুল করলে জনগণ ৫ আগস্টের মতো আবারও তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে পারে।’ বিএনপি নেতা কি তার দলের নেতাকর্মীদের অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার এবং অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় না দেয়ার আহ্বানে আন্তরিক? আমার এ বিষয়ে বেশ কিছুটা সংশয় রয়েছে। আমার মনে হয় তিনি হয় নির্দোষ অথবা মাঠের বাস্তবতার সংস্পর্শে পুরোপুরি নেই এবং ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞানের কিছুটা অভাবও থাকতে পারে। আমি এখানে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করব।

৬ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলো জানায়, বেলা ৩টার দিকে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেনের উপর প্রতিদ্বন্দ্বী একটি গ্রুপ হামলা চালিয়ে তার অন্তত পাঁচজন সমর্থককে গুরুতর আহত করে। ইকবাল আমার প্রথম কাজিন এবং বয়সের দিক থেকে আমার কাছ থেকে একটু জুনিয়র, আমরা আমাদের ইন্টারমিডিয়েট বা উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় আনন্দ মোহন কলেজে একসাথে পড়েছিলাম। ইকবাল গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে গৌরীপুর থেকে সংসদীয় আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেও দৃশ্যত আরো একজন উচ্চাকাক্সক্ষী প্রতিদ্বন্দ্বী এলাকা থেকে মনোনয়নের জন্য বিএনপি নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। তিনি তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য তার পেশিশক্তি এবং কালো টাকা ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে। তার চাঁদাবাজি ও সাবেক আ’লীগ সদস্যদের বিএনপিতে নিয়োগের খবর এলাকায় ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছে। এটি বিশ্বাস করা কঠিন, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এসব জবরদস্তি সম্পর্কে সচেতন হবেন না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন না হলে তা হবে বিরাট ভুল।

ইকবাল ঘটনাটি পুলিশের ডিআইজি, ময়মনসিংহ বিভাগের এসপি, ময়মনসিংহের ডিসির কাছে রিপোর্ট করেছেন, কিন্তু সাড়া পাননি। তিনি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে জানিয়েও কোনো সাড়া পাননি। ভারপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন তার দলের নেতাকর্মীদের অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার এবং অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন গত ১৯ জানুয়ারি এবং তার দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য ৬ জানুয়ারি অনুপ্রবেশকারীর হামলার শিকার হন। তার মানে কি এই হামলার বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন না? তিনি যদি এই ঘটনার কথা না জানতেন, তবে কেন তিনি ওই ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না সে প্রশ্ন অবশ্যই জাগে। আমার মনে হয় এ ঘটনা বিএনপির অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খল অবস্থার ইঙ্গিত দেয়।

বিএনপি নেতা যে সম্ভাব্য ‘অনুপ্রবেশকারীর’ কথা উল্লেøখ করছেন, তারা কারা? এই লোকেরা কারা হতে পারে তা বোঝানোর জন্য আমার কাছে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নেই, তবে ইকবালের এলাকার কিছু সাবেক আওয়ামী লীগ সমর্থক যারা দলে দলে বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন তাদের সম্পর্কে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। বাংলাদেশের ওপর তাদের হারানো নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতীয় নীলনকশার খবরও রয়েছে। বাংলাদেশের উপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণের ধরন স্মরণ করলে, কেউ কেবল হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের কথাই স্মরণ করে না, ইতিহাসের অনেকগুলো পর্বও স্মরণ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের প্রথম শত বছর (১৭৫৭-১৮৫৭) এ ধরনের শাসন বিকাশের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এই সময়কালে, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ঔপনিবেশিক কর্মকর্তারা এবং হিন্দুত্ববাদী উচ্চবর্ণের বাঙালিরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের নীতি গড়ে তোলে, যা মুসলিম সুলতান ও নবাবদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শতাব্দী প্রাচীন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপন করে।

ঔপনিবেশিক প্রশাসন যখন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে এলাকার সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে মুসলমানদের করুণ অবস্থা বুঝতে পেরেছিল, তখন এটি ১৯০৫ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ ও আসামকে বিভক্ত করে, মুসলিমদের কিছু অধিকার নিশ্চিত করে একটি নতুন প্রদেশ তৈরি করে। তবে, হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদীরা প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং সরকার ১৯১১ সালে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। একই হিন্দুত্ববাদী উপাদানগুলো নির্লজ্জভাবে তাদের ‘মাদার বেঙ্গল’ ১৯৪৬ সালে বিভক্ত করেছিল যখন ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক প্রশাসন ভারতকে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ঐতিহাসিক স্মৃতিগুলো স্বাভাবিকভাবেই দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। নিম্নবিত্ত ভারতীয়রা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে আচরণ ভোগ করছে, তারা সেরকম আচরণ পেতে চায় না। আমাদের শেষ নিবন্ধে আমরা বলেছিলাম, ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রাম ছিল বাঙালি মুসলিম পরিচয়ের ধারাবাহিকতায় একটি ‘সাময়িক বিপর্যয়’। নতুন করে বাক-স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ায় অনেক বুদ্ধিজীবী এখন বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করছেন। সম্প্রতি একজন লেখক ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেছেন, ‘১৯৭১ সালের পর আমরা কতবার স্বাধীন হয়েছি তা দেখতে আমাদের হিসাব করতে হবে।’ আরেক লেখক বলেছেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাসিত সরকারের ভারতের সাথে বিতর্কিত চুক্তি এবং পরে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যে ২৫ বছরের ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে তা বাংলাদেশে নয়াদিল্লির আধিপত্যকে সহজতর করেছিল।

বিএনপি ও আ’লীগ উভয়েরই মনে রাখা উচিত, ১৯৭১ সালে তাদের ‘আসল পাপ’ ছিল একান্ত নিজস্ব শক্তির ওপর নির্ভর না করে ভারতের সহায়তায় দেশ স্বাধীন করা। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনী বিদ্রোহের পর যে পরিস্থিতিতে দলের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন তা বিএনপির ভুলে যাওয়া উচিত নয়। নতুন নেতৃত্ব কিভাবে বাংলাদেশের ভারত প্রভাবিত ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের একটি নতুন সংজ্ঞা দিয়েছিল তা তাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্রপতি জিয়ার উপর সাম্প্রতিক একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘দেশের স্বাধীনতা, উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রে জিয়ার অবদান বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে তার স্থান নিশ্চিত করেছে। তার জীবন বাংলাদেশের জনগণের জন্য আশা, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির চিরন্তন প্রতীক। তাই আগামী ছয় মাসের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের তফসিল দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে বিএনপির উচিত বাংলাদেশপন্থী অবস্থান গ্রহণ করা, যেমনটি তার প্রতিষ্ঠাতা দেখিয়েছেন। অর্থাৎ নতুন জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির উচিত নিজেদের সংস্কার করা।’

আমি মনে করি না, বিএনপির সংস্কার খুব কঠিন কাজ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে বাংলার জনগণ যে আচরণ পেয়েছিল তার একটি সরাসরি দৃষ্টিভঙ্গি, তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত বাংলার রেনেসাঁর বিকাশ, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯১১ সালে এর রদ, আর তারপর ১৯৪৬-৪৭ বাংলার দ্বিতীয় বিভাজন এই সব ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো সম্পর্কে বিএনপিকে তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৌলিক দর্শন কর্মীদের শেখাতে হবে। আমি যদি ২০২৪ সালের ছাত্র বিপ্লবের মূল চেতনা বুঝে থাকি, তবে আমাকে বলতেই হবে যে ছাত্ররা বাঙালি মুসলমানের আবেগ খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। বিএনপিকে তার মূল দর্শনের প্রতি পূর্ণ অঙ্গীকার পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। আমি আমার চাচাতো ভাই ইকবালের মতো নিশ্চিত; বিএনপির মধ্যে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল নেতা আছেন যারা বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হবেন।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী স্কলার


আরো সংবাদ



premium cement