১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৭ মাঘ ১৪৩১, ১০ শাবান ১৪৪৬
`

কঠোর শাসন : শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ

- ছবি : সংগৃহীত

অনেক বাবা-মা চান তাদের ছোট শিশু কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় বেড়ে উঠুক। কিন্তু গবেষণা বলছে, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা শিশুর দীর্ঘস্থায়ী মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে ঝুঁকিতে ফেলে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ ও ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের গবেষকদের মতে, তিন বছর বয়সে কঠোর অভিভাবকত্বের মুখোমুখি হওয়া শিশুরা তাদের অন্যান্য সমবয়সীদের তুলনায় ১ দশমিক ৫ গুণ বেশি মানসিক স্বাস্থ্যের ‘উচ্চ ঝুঁকি’তে থাকে। অভিভাবকের কঠোর আচরণ শিশুর ওপর শারীরিক-মানসিক উভয়ই হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ অভিভাবকরা শিশুদের উচ্চস্বরে নিয়মিত চিৎকার করেন, শারীরিক শাস্তি দেন, শিশুকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। তাদের এসব আচরণে শিশুদের আত্মসম্মানবোধ নষ্ট হয়। তাই শিশুর ওপর অভিভাবকের আচরণের প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত। অভিভাবকের কঠোর আচরণের প্রভাব মেয়ে সন্তানের উচ্চ-ঝুঁকির আশঙ্কা ছেলে সন্তানদের চেয়ে ১ দশমিক ৪ গুণ বেশি।

অনেক সময় বাবা-মা নিজেদের সন্তানকে অন্যদের সাথে তুলনা করেন, শিশুকে শাসন করতে বেত, লাঠি বা বেল্ট দিয়ে আঘাত করেন, থাপ্পড় মারেন; যা শিশুর সম্মানবোধের মানসিক ক্ষত সৃষ্টি করে। তাতে শিশুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কৃতিত্ব, নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা ও আগ্রহ নষ্ট হয়। শিশুর মনোস্তাত্তি¡ক গবেষণা অনুসারে, কঠোর মা-বাবার কর্তৃত্ববাদী আচরণ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন- ১. কঠোর শাসনের পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণœতার লক্ষণ দেখা যায়। প্রায়ই তারা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপে ভোগে। ২. মা-বাবার কর্তৃত্ববাদী আচরণ কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মসম্মান বা সসম্মান কমায়। ক্রমাগত সমালোচনা তাদের আত্মসম্মান নষ্ট করে, ফলে তারা হতাশার অনুভূতির দিকে পরিচালিত হয়। ৩. অভিভাবকদের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ কিশোরদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত করে। ৪. অভিভাবকের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ কিশোর-কিশোরীর সংবেদনশীল অভিব্যক্তির অভাব সৃষ্টি করে, যা তাদের মানসিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত করে। সংবেদনশীল নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা হ্রাসে তারা মানসিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারায়। ৫. অভিভাবকদের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণে কিশোরদের যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি বা বাস্তবতা মোকাবেলার দক্ষতার হ্রাস করে। ৬. কিশোররা কঠোর অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণের প্রতিক্রিয়ায় গোপন আচরণে জড়িত হতে পারে, মিথ্যা বলা বা লুকিয়ে থাকা এবং গোপন কার্যকলাপে যুক্ত হতে পারে। ৭. অভিভাবক-সন্তানের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। ৮. কঠোর মা-বাবার নিয়ন্ত্রণ কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিকাশে বাধা দেয়।

মা-বাবার, শিশুর ওপর শারীরিক শাস্তির বিরূপ প্রভাব পড়ে। কেকে উইমেনস অ্যান্ড চিলড্রেন হাসপাতালের (কেকেএইচ) সাইকোসোশ্যাল ট্রমা সাপোর্ট সার্ভিস এ প্রভাবগুলো ব্যাখ্যা করেছে। শারীরিক শাস্তির শিকার শিশুদের প্রাপ্তবয়স্কদের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি দেখা যায়। শারীরিক শাস্তি বা ‘কঠোর শারীরিক শাস্তি’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে, বাবা-মা তাদের শিশুকে ধাক্কা দেয়া, আঁকড়ে ধরা, চড় মারা বা আঘাত করা। অত্যাচার বা শারীরিক নির্যাতন না হলেও এ শাস্তিগুলো শিশুকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। যেমন- তারা বিষণ্ণতায় ভোগে, ব্যক্তিত্বের সমস্যায় ভোগে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা দেখা দেয়। সাইকোসোশ্যাল ট্রমা সাপোর্ট সার্ভিস, কেকে উইমেনস অ্যান্ড চিলড্রেনস হসপিটালের (কেকেএইচ) সিনিয়র প্রিন্সিপাল সাইকোলজিস্ট লিন সোহ বলেন, শিশুদের ওপর আঘাত করা, থাপ্পড় দেয়া বা মারধর করা হলে তা তার মানসিক স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। শারীরিক শাস্তির মাধ্যমে শিশুদের কাছে এই বার্তা যায় যে, সে মূল্যহীন, অকেজো, অপ্রীতিকর বা অবাঞ্ছিত এবং তার উপর শারীরিক বা মানসিক হুমকি আছে। আগ্রাসনের বার্তাটি শিশুদের কাছে প্রকৃত শারীরিক শাস্তির চেয়েও বেশি, পরবর্তী জীবনে একটি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

শারীরিক শাস্তি বিভিন্নভাবে শিশুদের বিকাশে প্রভাব ফেলে, যেমন- শিশু শাস্তিকে ভয় পেতে থাকে, তাই নিজেকে খারাপ আচরণ করা থেকে বিরত রাখার ক্ষমতা কম নিয়ে সে বড় হয়ে ওঠে। শিশুরা মনে করতে শুরু করে, বাবা-মা তাদের ভালোবাসেন না। এটি মা-বাবার সাথে একটি উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের দিকে নিয়ে যায়। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে একটি শিশু আত্মহত্যার কথাও ভাবতে পারে। তা ছাড়া কর্তৃত্ববাদী মা-বাবার আগ্রাসনে বেড়ে ওঠা শিশুদের সাধারণত পেশাগত জীবন তেমন সফল হয় না। সিদ্ধান্ত নেয়ার দুর্বল মানসিকতা এবং নেতৃত্বের দুর্বলতা এর অন্যতম কারণ। একই সাথে তাদের দুশ্চিন্তা, বিষণœতা ও মানসিক আঘাতের প্রভাব প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

দুঃখের বিষয় হলো- কঠোর অভিভাবকরা কখনো নিজেদের সন্তানদের ক্ষতি হচ্ছে তা দেখেন না; বরং তারা মনে করেন, তারা তাদের শিশুদের শৃঙ্খলা, সম্মান ও কঠোর পরিশ্রম শেখাচ্ছেন। কিন্তু এসব শিশু প্রথমে যা শিখে তা হলো কর্তৃত্ব এড়ানোর উপায়। তারা সেলফোন লুকিয়ে রাখতে, তারা কোথায় যাচ্ছে সে সম্পর্কে মিথ্যা বলা এবং ষড়যন্ত্র তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠে।

সুতরাং অভিভাবকদের উচিত ‘কর্তৃত্ববাদী’ থেকে ‘দায়িত্বশীল’ আচরণ করা। কর্তৃত্ববাদী থেকে দায়িত্বশীল বাবা-মাতে রূপান্তরিত হওয়া। যেমন- বয়ঃসন্ধিকালের আপনার শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বুজুন। এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মা-বাবার কঠোর শাসনে কিশোর-কিশোরীর মস্তিষ্ক সম্পূর্ণরূপে বিকশিত মস্তিষ্কের মতো কাজ করতে নাও পারে। সম্পূর্ণ বিকশিত মস্তিষ্ক যেমন- ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারা, কঠোর শাসনে বেড়ে ওঠা শিশু তা পারে না। অভিভাবকরা তাদের শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ বুঝতে পারলে, তাদের উত্তপ্ত তর্ক বা উগ্র আচরণ ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করবেন না। পরিবর্তে, অভিভাবকরা শিশুদের আবেগপ্রবণ ক্রিয়াকলাপের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি শান্তভাবে পরিচালনা করবেন। অভিভাবকদের উচিত কিশোরদের গোপনীয়তা ও স্বাধীনতায় সম্মান করা। কিশোর-কিশোরীরা স্বাভাবিকভাবে গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার বোধ কামনা করে, যা তার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার দিকে যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের সামাজিকবৃত্ত এবং বন্ধুদের সম্পর্কে জানা। স্বাভাবিকভাবে অভিভাবকরা জানতে চান যে, শিশুরা কার সাথে আড্ডা দেয়। কারণ বন্ধুরা তাদের উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। একটি ইতিবাচক সামাজিক পরিবেশকে উৎসাহিত করতে, অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের বন্ধুদের নিজেদের বাড়িতে স্বাগত জানানো। শিশুদের উৎসাহিত করা, যাতে তারা বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে মজা করে বা হোমওয়ার্ক করে এবং স্কুলে দেয়া কাজগুলো একসাথে করে। তাদের বন্ধুদের ভালোভাবে আপ্যায়ন করা উচিত; যা শিশুদের তার জগতের সামাজিক গুরুত্ব বাড়াবে।

অভিভাবকদের উচিত কিশোর সন্তানদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, সেই সময় নিজেকে শান্ত রাখা, ধৈর্য, মননশীলতা দেখানো এবং মুহূর্তের উত্তাপে এমন কিছু বলা এড়ানো, যা পরে অনুশোচনা সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ যদি কিশোর দেরিতে বাড়িতে আসে তাহলে চিৎকার না করা, পরিবর্তে তাকে বোঝানো যে, সে দেরিতে বাড়িতে আসলে অভিভাবকরা চিন্তিত থাকেন। অভিভাবকদের উচিত কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে কথা বলা। একটি দ্বিমুখী, খোলামেলা কথোপকথনের উষ্ণ, খোলা সুর বজায় রাখা। অভিভাবকের সন্তানের কথাগুলো হৃদয় দিয়ে শোনা উচিত। সক্রিয় হৃদয় দিয়ে কথা শোনা কিশোর-কিশোরীদের সাথে শক্তিশালী, বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে অপরিহার্য। অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে সময় মূল্যবান।

যখন কিশোর সন্তান উদ্বেগ নিয়ে অভিভাবকের কাছে আসে, তখন তাদের প্রতি অবিভক্ত মনোযোগ দেয়া উচিত। বিভ্রান্তি দূর করা, চোখের যোগাযোগ করা এবং তাদের যা বলার আছে তাতে প্রকৃত আগ্রহ দেখানো অভিভাবকের উচিত। সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়ে পড়া বা অযাচিত পরামর্শ দেয়া এড়িয়ে চলা উচিত। পরিবর্তে মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করা। কখনো কখনো সন্তানদের শোনা একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। সক্রিয় শ্রবণ শুধু অভিভাবক, তার সন্তানকে সম্মান দেখায় না; বরং উন্মুক্ত যোগাযোগ ও বিশ্বাসে উৎসাহিত করে। এটি অভিভাবকের সাথে সন্তানের গভীর সংযোগ, শক্তিশালী বন্ধন এবং একটি স্বাস্থ্যকর, দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের সৃষ্টি করে। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করা এবং একসাথে মজা করা। তাদের সাথে খেলা করা। মজা করার মাধ্যমে অভিভাবকের উচিত দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি তৈরি করা। কিশোর-কিশোরীর সাথে একটি শক্তিশালী, সহায়ক সম্পর্ক গড়ে তোলা। অভিভাবকের জেনে রাখা উচিত, ক্ষমা চাওয়া ও সাহায্য চাওয়ার কিছু ভালো দিক আছে। আমরা সবাই ভুল করি- এটি সন্তানের ভালো মানুষ হওয়ার অংশ। ভুলগুলো স্বীকার করা অভিভাবকের কর্তৃত্ব হ্রাস করে না; বরং এটি আসলে অভিভাবকের সন্তানদের কাছে আরো সম্মান পেতে সাহায্য করে।

লেখক : কবি, কথাসহিত্যিক ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement
রাজশাহীতে আ’লীগ ও যুবলীগের ৪ নেতাকর্মী গ্রেফতার বুড়িচংয়ে আওয়ামী লীগ নেতাসহ আটক ৩ বেনজীর আহমেদকে গ্রেফতারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির আদেশ হাছান মাহমুদের দুর্নীতি : পরিবারের ৭০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন আশুলিয়ায় দুই বাড়িতে আগুনে পুড়ল ৮ ঘর লেবাননে নতুন সরকার গঠনকে স্বাগত জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মালয়েশিয়ায় ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উজিরপুরে নিখোঁজ ট্রলারচালকের সন্ধানে মানববন্ধন কালিহাতীতে বাসচাপায় নিহত ২ বাংলাদেশে কানাডার উৎপাদন কারখানা স্থানান্তরের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার ডেভিল হান্টে রাঘববোয়াল-চুনোপুঁটি কেউ ছাড় পাবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

সকল