৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ২৯ রজব ১৪৪৬
`

সংস্কারের লক্ষ্য হোক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা

-

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকে পূর্ণতা দানের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংস্কার কমিশনগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বেশ কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম, মূলনীতি, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বর্তমান সংবিধানে থাকা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর স্থলে ‘জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ গঠন এর কথা বলা হয়েছে। ‘জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সমীচীন এবং যুক্তিযুক্ত। আগে থেকেই আমরা এ বিষয়টি সামনে এনেছিলাম। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘বৈষম্যহীন’ সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ফসল। সুতরাং রাষ্ট্র ও সরকার কতটা কার্যকর গণতান্ত্রিক হলো, কতটা বৈষম্যহীন হলো এটিই মুখ্য। শুধু নাম নয়। বিশ্বের যেসব রাষ্ট্র এ ধরনের বাহারি নাম ধারণ করেছে তাদের অবস্থা কী তা পর্যালোচনা হওয়া উচিত। বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত দেশ উত্তর কোরিয়া। এর অফিসিয়াল নাম ‘ডেমোক্র্যাটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া (উচজক)। কিন্তু দেশটিতে একনায়কতন্ত্র বিরাজমান। একইভাবে লাওস নামক দেশটি ‘লাউস পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক (খচউজ) নামে অভিহিত। কিন্তু দেশটি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের। অপরদিকে বিশ্বের অন্যতম সর্বাধুনিক জাতিরাষ্ট্র জাপান এর রাষ্ট্রপ্রধান সম্র্রাট। কিন্তু এর অফিসিয়াল নাম ‘গভর্নমেন্ট অব জাপান’। শিক্ষা, সভ্যতা, শিল্প-বাণিজ্য, অর্থনীতি তথা সর্বক্ষেত্রে বিশ্বের রোলমডেল। সুতরাং নামের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রকে বৈষম্যহীন রূপদান। বিদ্যমান সংবিধানের চার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ মূলনীতি হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি নিরপেক্ষ আচরণের নাম। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মীয় ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ। আগে সমাজতন্ত্র মূলনীতিতে থাকলেও দেশ সমাজতান্ত্রিক ছিল না। সুতরাং ন্যায়ভিত্তিক, জনবান্ধব, মানবিক, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই আসল। মূলনীতিতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, চার বছর মেয়াদের সংসদ। মালদ্বীপ ব্যতীত সার্ক দেশগুলোতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবে ইলেকটোরাল কলেজ বা নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটের মাধ্যমে। একই ব্যক্তি দু’বারের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না বলে সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো সুচিন্তিত ও গণতন্ত্র উন্নয়নে সহায়ক।

প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। চারটি প্রদেশে বিভক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করা হলে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ হবে। আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা ও সুষ্ঠু ধারার শাসনের জন্য বিকেন্দ্রীকরণ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। আয়তনে ছোট হলেও বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছতে হলে প্রদেশে বিভক্ত করা যেতেই পারে। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, সীমান্তসহ বৈদেশিক যোগাযোগ, সাহায্য-সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে শাসন-প্রশাসন প্রাদেশিক সরকারের কাছে ছেড়ে দেয়া হলে ঢাকাকেন্দ্রিক মানুষের চাপ হ্রাস পাবে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়া ঢাকা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। একই সাথে ১-২ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকেন্দ্রীকরণ হবে প্রাদেশিক কাঠামোতে। তৈরি হবে নেতৃত্ব। বলা বাহুল্য, আমেরিকায় অধিকাংশ প্রেসিডেন্ট রাজ্য সরকারের গভর্নরের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছেন।

বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগের প্রাণ হলো সিভিল সার্ভিস, যা উপসচিব হতে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত বিন্যস্ত। দেখা যায়, একজন বিসিএস পাস করে সিভিল প্রশাসনে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন। এক মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের পর তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন না। কাজে স্থবিরতা নেমে আসে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য যেমন চিকিৎসা পেশা থেকে নিয়োগ দেয়া হয়, আইন মন্ত্রণালয়ের জন্য যেমন আইন বিষয়ের ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়, তেমনি অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প মন্ত্রণালয়ের জন্য পেশাভিত্তিক প্রশাসনব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক। বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের ক্যাডার সার্ভিস হিসেবে অভিহিত। ‘ক্যাডার’ শব্দটি সম্মানের নয়। সরকারি কর্মকর্তারা সেবা বা সার্ভিস প্রদানে নিয়োজিত তাই একে সার্ভিস হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। বর্তমান সংস্কার উদ্যোগে অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়কেও সম্পৃক্ত করা উচিত। বর্তমানে শিল্প মন্ত্রণালয় রয়েছে তা শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান তদারকি এবং শিল্প-সংক্রান্ত পলিসি প্রণয়নের মধ্যে এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। আমাদের দরকার এমন মন্ত্রণালয় যা ব্যাপক শিল্পায়নের উন্নয়নে দায়িত্ব পালন করবে। শিল্প উন্নয়নের জন্য জাপানে Ministry of Economy, Trade and Industry (METI) রয়েছে। বাংলাদেশ এর আদলে শিল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় গঠন করতে পারে। স্বৈ^রাচারী শাসকের কবল থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া বাংলাদেশে এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা যাতে কেন্দ্রীভূত হতে না পারে সে জন্য রাষ্ট্রের তিনটি এবং নির্বাহী বিভাগের দু’টি পদ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংস্কার উদ্যোগ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থার পুরোটাই সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার হতে হবে রাজনৈতিক, শিল্প-বাণিজ্য, সামাজিক, শাসন-প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক, ভূমিবন্দোবস্তÍ, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই। সরকারের কাছে মানুষের বিশাল প্রত্যাশা।

বিগত সময়ে অপশাসনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছিল বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে। জনবান্ধব পলিসি গ্রহণের জন্য উপযুক্ত সময় এখনই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি আইনি এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো করে দেবে, যার আদলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার পরিচালিত হবে এবং সমন্বয়ে গড়ে তোলা হবে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ। জন-আকাক্সক্ষা পূরণে সুপারিশমালা যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হোক, তাই কাম্য।

লেখক : প্রাক্তন পরিচালক, এফবিসিসিআই
e-mail : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
টাঙ্গাইল বার সমিতির নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্যানেল জয়ী দেশের সবচেয়ে ‘ধনী’ এলাকা ঢাকার পল্টন চাঁদ দেখা যায়নি, ১৪ ফেব্রুয়ারি শবে বরাত ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিকল্পনা মার্কিন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর’ দারিদ্র্য বেশি বরিশাল বিভাগে তামাবিল স্থলবন্দরে দুদকের অভিযান : মাসে ৩ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি বাণিজ্য মেলায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ২৬ কুষ্টিয়ায় বিজিবির অভিযানে ৩৩ লাখ টাকার আতশবাজি আটক ছাত্ররা কেন দল গঠন করবে, জানালেন প্রধান উপদেষ্টা রংপুরে সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ গ্রেফতার সাংবাদিক সন্তানদের বৃত্তি প্রদান সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ : উপদেষ্টা নাহিদ

সকল