২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ মাঘ ১৪৩১, ২৮ রজব ১৪৪৬
`

ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণ ও কিছু মানুষের স্বপ্নভঙ্গ

-

আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২০ জানুয়ারি, ২০২৫-এ দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। তিনি আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়া এবং ক্ষমতায় আসা অনেকটাই রূপকথার মতো। তিনি দ্বিতীয় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, যিনি প্রথমে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হয়েও হাল ছাড়েননি এবং তৃতীয় দফায় পুনরায় নির্বাচিত হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেন। সাধারণত আমেরিকার ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি তার দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে পরাজিত হলে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান এবং অবসর জীবন যাপন করেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হয়েও অবসরে যাননি; বরং তিনি গত চার বছর তার বিরুদ্ধে আনীত নানা অভিযোগ ও মামলা মোকাবেলাসহ রাজনীতিতে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত হন। সে দেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এবার তিনি গতবারের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হলেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ক্ষমতায় ফিরে আসা নিয়ে সারা বিশ্বেই গত কয়েক মাস যাবৎ নানা জল্পনা-কল্পনা চলছিল; বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বর্তমান সরকারকে ধরা হয় আমেরিকার ‘ডেমোক্র্যাট’ দলের পছন্দের সরকার হিসেবে, যার মূল কারণ ডক্টর ইউনূসের সাথে সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটন ও বারাক ওবামার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সাবেক স্বৈরাচারী সরকারের অনুগত লোকেদের আশা ছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির ‘কথিত বন্ধু’ ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যাবে এবং সেই সুযোগে বাংলাদেশে ভারতের অনুগত আওয়ামী লীগের সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এ কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর আওয়ামী লীগাররা গোপালগঞ্জে ‘খিচুড়ি ভোজের’ আয়োজন করে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশনায় আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের কর্মীরা ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের’ ছবি নিয়ে ঢাকার রাজপথে বিজয়মিছিল করার পরিকল্পনা করে। তাদের আশা ছিল, আওয়ামী ও ছাত্রলীগের এই মিছিলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বাধা দেবে এবং সে সুযোগে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবিকে পদদলিত করে তা ট্রাম্পের দফতরে পাঠাবে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ট্রাম্পের’ বিরাগ সৃষ্টি করা যাতে তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতের সহায়তায় এই সরকারকে হটিয়ে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেন।

সমস্যা হলো, এই নির্বোধ রাজনীতিকরা বিশ্বরাজনীতির খোঁজখবর খুব একটা রাখেন না বা রাখলেও তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বোঝেন না। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার গত মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ভারত সফরকালে এক ভাষণে নরেন্দ্র মোদির ‘চা-ওয়ালা’ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়টিকে উল্লেখ করে তাকে সম্মান জানিয়েছিলেন এবং তাকে ব্যক্তিগত বন্ধু মর্মে অভিহিত করেছিলেন। এটি মূলত ছিল ট্রাম্পের রাজনৈতিক উচ্চারণ। বিশ্বরাজনীতিতে বন্ধুত্বের কোনো স্থান নেই; এখানে সব সম্পর্কই নির্ধারিত হয় কে কাকে কতটুকু সুবিধা দিচ্ছে বা কার কাছে কে কতটুকু সুবিধা পাচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে। সে কারণেই আমেরিকান প্রেসিডেন্টের ‘কথিত বন্ধু’ নরেন্দ্র মোদি আমেরিকার সহযোগী ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধরত রাশিয়া থেকে লাখ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করে তা অন্যত্র বিক্রি করে লাভবান হয়েছে এবং রাশিয়াকে তার অতিপ্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করেছে ও সমর্থন জুগিয়েছে। এমনকি এই যুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনী রাশিয়ার পক্ষে সরাসরি যুদ্ধও করেছে (বা এখনো করছে), যা ভারতীয় গণমাধ্যমেই প্রচারিত হয়েছে। ভারত রাশিয়া থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসহ নানা মূল্যবান যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করেছে। এখানে ভারত যা করেছে, তা তার নিজের সুবিধার জন্যই করেছে, তথাকথিত বন্ধুত্বের কোনো স্থান এখানে ছিল না।

২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন তার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল, ‘Make America Great Again’, অর্থাৎ তিনি আমেরিকার পূর্বগৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য সচেষ্ট থাকবেন। তার ওই সময়কালে তিনি আমেরিকাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তার সময়কালে আমেরিকা নতুন কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। তিনি মূলত ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক দিকগুলোর দিকে নজর দিয়েছিলেন অধিক পরিমাণে। অন্য দেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নানা শুল্ক আরোপ এবং আমেরিকায় পণ্য উৎপাদনের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা ছিল তার অন্যতম মূল লক্ষ্য।

এবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পর যে খুব ভিন্ন কিছু হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। শপথ গ্রহণের পরপরই তিনি ৭৯টি প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডিন্যান্সে স্বাক্ষর করেছেন, যার সব ক’টিই আমেরিকার আভ্যন্তরীণ বিষয় সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি সেটি হলো মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় অনুপ্রবেশ রোধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ। তিনি ইতোমধ্যে মেক্সিকো সীমান্তে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করেছেন এবং সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি আমেরিকায় অবস্থানরত সব অবৈধ অধিবাসীকে সে দেশ থেকে বের করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এবার পৃথিবী ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ‘ডিপোর্টেশন’ কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করবে। তিনি আমেরিকার সংবিধান লঙ্ঘন করেই আগামী ৩০ দিন পরে জন্ম নেয়া শিশুদেরকে আমেরিকার নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণাতেও স্বাক্ষর করেছেন। তার আরো একটি উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও কানাডার উৎপাদিত পণ্যে ২৫ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ। যদিও এই সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি; কিন্তু এর প্রভাব ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদী ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের আরো কার্যক্রম দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ও ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের পতিত স্বৈরাচারের সমর্থকরা খুব আশাবাদী ছিল যে, যেহেতু ডক্টর ইউনূসের সরকার এতদিন ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন পেয়ে আসছিল, আমেরিকায় রিপাবলিকান দলের রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইউনূস সাহেবের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি বড় ধাক্কা খাবে। বিশেষত যখন নরেন্দ্র মোদি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বন্ধু। এই মানুষগুলো প্রথম ধাক্কাটা খায় যখন তারা দেখে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। এ ছাড়া আমেরিকার অবৈধ অধিবাসীদের বড় একটি অংশ ভারতীয়। এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি তার ঘোষণা মতো অবৈধ অধিবাসীদের সে দেশ থেকে বের করে দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেন, তাহলে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খাবে ভারত ও মেক্সিকো; কারণ আমেরিকায় অবৈধভাবে বসবাসকারীদের অধিকাংশই ভারতীয় ও মেক্সিকান।

ট্রাম্পের জয়লাভের সময়েই আমেরিকায় অবৈধভাবে প্রবেশকালে প্রায় ৩৫ হাজার অভিবাসন-প্রত্যাশীকে আটক করে সে দেশের সরকার (যার একটা বড় অংশ ভারতীয়); এদেরকে যে স্বল্পতম সময়েই আমেরিকা থেকে বহিষ্কার করা হবে তা বলাই বাহুল্য। ভারতের বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটগুলো বস্তুত আমেরিকার চাকরির বাজারে নিয়োগের জন্যই গ্র্যাজ্যুয়েট তৈরি করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সে প্রতিষ্ঠানগুলোও লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়তে পারে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে নরেন্দ্র মোদি কি তার দেশের নাগরিকদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করবেন নাকি বাংলাদেশের পতিত স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেবেন? জবাবটা খুব পরিষ্কার।

সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা সম্ভবত খেতে যাচ্ছে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের পতিত স্বৈরাচার ও তার সঙ্গী-সাথীরা। ভারতের বাংলাদেশবিদ্বেষী কিছু রাজনৈতিক নেতা ও মিডিয়া, যারা গত ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ও জনগণকে নানাভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে গেছে। তারা এই ব্যর্থতার পর কী ইস্যু নিয়ে মাঠে নামবে তাও এখন দেখার বিষয়। বাংলাদেশের অন্যতম কূটনীতি বিশেষজ্ঞ রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবিরের মতে, আমেরিকার মতো দেশ সহসা তাদের বৈদেশিক নীতি পরিবর্তন করে না। তার মতে, আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ-আমেরিকা সম্পর্কে তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না, কারণ বাংলাদেশে এখনো আমেরিকার স্বার্থ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া আরো একটি বড় কারণ হলো, এই মুহূর্তে বঙ্গোপসাগর অঞ্চল খুবই অস্থিতিশীল ও স্পর্শকাতর অবস্থায় রয়েছে; আমেরিকা এ সময়ে এমন কিছু করবে না যা এই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতাকে আরো সঙ্কটের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশের সরকারকে সবসময় আমেরিকার রাজনীতির গতি-প্রকৃতির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, কারণ এ দেশের পতিত স্বৈরাচার বা তার পৃষ্ঠপোষকরা যেকোনো সময় যেকোনো নতুন ষড়যন্ত্রের জাল ছড়াতে পারে।

তবে এখন পর্যন্ত যেসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্টের কার্যভার গ্রহণকে কেন্দ্র করে যেসব মানুষ বা গোষ্ঠী রাজনৈতিক পুনর্বাসনের স্বপ্ন দেখছিল, তাদের সে স্বপ্ন সম্ভবত স্বপ্নই থেকে যাবে।

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মচারী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement