২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩ মাঘ ১৪৩১, ২৫ রজব ১৪৪৬
`

রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সমন্বয়কদের দূরত্ব

- ছবি : সংগৃহীত

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ায় তার সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের কবল থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পেয়েছে। অভ্যুত্থানকারী নেতাদের অনুরোধে নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য এক মাস স্থায়ী হয়। কিন্তু তার পর থেকে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। এতে জনগণ শঙ্কিত। প্রধান উপদেষ্টা তার মাসপূর্তি ভাষণে নির্বাচন সম্পর্কে কিছু না বলায় এবং ছাত্র সমন্বয়কদের তারুণ্যনির্ভর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণে প্রধান উপদেষ্টা অনেকের সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত হন, যা জনগণকে আবারো হতাশ করে।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অনুসারীরা শেখ মুজিবের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে মুজিববাদী ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র) গঠন করেন।

তরুণদের ব্যাপক সমর্থন পাওয়ায় সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে সভাপতি ও ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রবকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে শেখ মুজিব জনগণকে তিন বছর কিছু দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেও জাসদ যাতে দল গুছিয়ে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াতে না পারে; সে জন্য তড়িঘড়ি করে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কারচুপি করে জাসদের অনেক প্রার্থীকে পরাজিত করা হলেও দু’জন নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন।

১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেল দিয়েও জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে জিততে পারেনি। ভোট গণনায় তাদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় অস্ত্রের মুখে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হয়েছিল। জাসদকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে আওয়ামী লীগ সরকার রক্ষীবাহিনী দিয়ে দমনের চেষ্টা করে। এভাবে জাসদকে হঠকারী রাজনীতির দিকে ঠেলে দেয়া হয়। যার ফল কোনো দলের জন্য শুভ হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সফল নায়করাও তারুণ্যনির্ভর রাজনৈতিক দল গঠন করবে এটি স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় জাসদের উত্থান ঠেকিয়ে দিতে পেরেছিল। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় নেই। ফলে দলটি সন্দেহ করছে যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা অন্তর্বর্তী সরকারের সহায়তায় রাজনৈতিক দল গঠন করবে এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবে। এটি সম্ভব করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের পথনকশা ঘোষণায় কালক্ষেপণ করছেন বলেও বিএনপির সন্দেহ।

সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসন অবসানে রাজনৈতিক দলগুলো সফল হতে পারেনি। সবশেষ রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কহীন ছাত্রছাত্রীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ১ জুলাই থেকে যে আন্দোলনের সূচনা করেন সেটিই সরকারবিরোধী জনতাকে পথ দেখিয়েছিল। ফলে ছাত্র-জনতা ৫ সপ্তাহ আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ নেতাদের ৫৩ বছরের রাজনৈতিক অর্জন ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে যেভাবে তাদের করুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পেরেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ আন্দোলন করে শেখ হাসিনাকে যদি ক্ষমতাচ্যুত করতে পারত তবুও তাদের এ করুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারত কি না তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় থেকেই যায়। তার প্রমাণ তাদের আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত জেনারেল এরশাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন।

আগামী নির্বাচনে জনগণ কোন দলকে ক্ষমতায় বসাতে চায় সেই ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো। কিন্তু এটাও সত্য যে, সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী হচ্ছে আমলাতন্ত্র ও কতিপয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।

দ্রুত নির্বাচন চাইলে সব রাজনৈতিক দল মিলে গোলটেবিল বৈঠকে বসে সংস্কারের সর্বসম্মত সুপারিশমালা প্রস্তুত করতে পারেন। সব দল মিলে সে সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টা সমীপে উপস্থাপন করতে পারেন।

জুলাই-আগস্টের পাঁচ সপ্তাহের আন্দোলন যে প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দলের গতানুগতিক রাজনীতিকে আরো কঠিন করে দিয়েছে তা প্রবীণ নেতারা অনুধাবন করতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। প্রবীণ নেতাদের রাজনীতির সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তারা কেউ দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না ও কেউ থামতে চান না বা থামতে জানেন না।

শেখ হাসিনা ও ১৪ দলের প্রবীণ নেতারা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও থামতে না চাওয়ায় আজ তাদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে। জনরোষ থেকে বাঁচতে বৃদ্ধ বয়সেও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। প্রবীণ অনেক নেতাকে গ্রেফতার হয়ে লাঠি ভর দিয়ে কারাগারে যাওয়ার দৃশ্য দেখে তাদের অন্ধ ভক্তরাও লজ্জা পাচ্ছেন। তরুণ প্রজন্মের আধুনিক চিন্তাধারার সাথে প্রবীণদের গতানুগতিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার সমন্বয় করতে না পারায় ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনকারী মুসলিম লীগ বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু ভারতের কংগ্রেস ঠিকই টিকে আছে। তেমনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত হওয়ায ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তার পরও কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এখনো শিগগির ক্ষমতায় ফেরার দিবাস্বপ্ন দেখে চলেছে। দিবাস্বপ্ন দেখার মতো পরিবেশ তাদের বন্ধু ভারত তৈরি করে দিয়েছে।

মোট ভোটারের ৩০-৩৫ শতাংশ হচ্ছে দলনিরেপক্ষ ও নবীন ভোটার। তাই নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে এ ভোটররা মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন। আগামী নির্বাচনে তাদের ভোটদানের অতীতের প্যাটার্ন যে পাল্টে যেতে পারে তা না ভেবে ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলগুলো ১৯৯১ সালের নির্বাচনপূর্ব আওয়ামী লীগের মতো ক্ষমতায় যাওয়ার কথা ভাবছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অর্থাৎ জনগণের সামনে তারা ছাড়া বিকল্প কোনো দল নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ওই ভোটারদের ভোটদানের প্যাটার্ন ছিল ক্ষমতা থেকে সদ্য বিদায়ী দলের শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মার্কায় ভোট দিয়ে তাদের পাঁচ বছরের অপশাসনের জবাব দেয়া। তারা প্রার্থী দেখে নয়; মার্কা দেখে ভোট দেয়ায় ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেগেটিভ ভোটে বিএনপি সহজ জয় পেয়েছিল।

আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী সবাই গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে লুটপাট, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, নিয়োগবাণিজ্য ও দুর্নীতিতে জড়িত থেকে শত থেকে হাজার কোটি কালো টাকার মালিক বনে গেছেন। তারা সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় গ্রেফতারের ভয়ে কেউ প্রার্থী হবেন বলে মনে হয় না। নির্বাচনের মাঠে নৌকা প্রতীক না থাকলেও ভোটের মাঠে নৌকার সমর্থকরা ঠিকই থাকবেন। আগামী নির্বাচনে তারা শেখ হাসিনার গোলাম কাদেরের জাপাসহ ১৫ বছর ধরে তাদের অনুগ্রহপ্রাপ্ত ছোট ছোট দলের সম্ভাবনাময় প্রার্থীকে ভোট দেবেন, এমন ধারণা অমূলক নয়। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলে দলনিরপেক্ষ ও নবীন ভোটাররা মার্কা দেখে নয়, প্রার্থী দেখে ভোট দেবেন, এর প্রবল সম্ভাবনাই বেশি। তাই অতীতের মতো তাদের বেশির ভাগ ভোট বর্তমানের প্রচলিত ধারার শক্তিশালী দলের পক্ষে যাবে কি না তাতে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। কারণ এদের দেড় যুগের নিষ্ক্রিয়তায় নবীন ভোটারদের মধ্যে তাদের সমর্থন তুলনামূলকভাবে কম।

আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের হাতে রয়েছে হাজার হাজার কোটি নগদ টাকা, যা দেশকে অস্থিতিশীল করতে ও নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। স্বৈরাচার ও তাদের দোসরদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার মতো কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত দেশ চার দিন কার্যত সরকারবিহীন থাকাকালীন ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ রাখা প্রয়োজন ছিল। ব্যাংকের প্রতিটি শাখার ম্যানেজার জানেন, ১৪ দলের নেতাদের নামে ও দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারীদের নামে কতটি হিসাব পরিচালিত হচ্ছে। ৯ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকের এমডিদের নির্দেশ দিতে পারত, তার ব্যাংকের প্রত্যেক শাখায় ১৪ দলের নেতাকর্মী ও দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের হিসাবে লেনদেন স্থগিত রাখার। সেসব হিসাবের তালিকা নিজ নিজ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানোর নির্দেশ দিতে পারত। যাচাই-বাছাইয়ের পর যেসব হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন ছিল না সেসব হিসাবের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়া যেত। কিন্তু সন্দেহজনক হিসাবের তথ্যানুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে তা কবে নাগাদ শেষ হবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না।

পরিশেষে বলা যায়, সব দল মিলে অন্তর্বর্তী সরকারকে যেভাবে দুর্বল করে ফেলছে তা দেখে স্বৈরাচারের দোসররা অলক্ষ্যে হাসছে। অতএব, কাণ্ডারিরা হুঁশিয়ার।


আরো সংবাদ



premium cement
নওগাঁয় পুকুর থেকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী যুবকের লাশ উদ্ধার ঢাবি ও সাত কলেজের ঘটনা নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার অপপ্রচার নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সিইসির বক্তব্যের সাথে একমত বিএনপি : দুদু আ’লীগ নেতা, পুলিশসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি গাছে আটকেপড়া বিড়ালকে উদ্ধার করল ফায়ার সার্ভিস বরিশালের টানা ৫ জয়, কঠিন সমীকরণে খুলনা সিরাজদিখানে নিখোঁজের ৭ দিনেও সন্ধান মেলেনি স্কুলছাত্র রোমানের ৪৪তম বিসিএসে ৯০০ প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষার সূচি প্রকাশ পাকিস্তানের হার, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সাতে বাংলাদেশ ‘বাবা বেঁচে নেই, তাই আমাকে আর কেউ চিপস, চকলেট কেনার টাকা দেয় না’ শহীদ জসিমের ছেলে সিয়াম গাজাবাসীকে মিসর-জর্ডানে সরিয়ে নেয়ার মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হামাসের

সকল