জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বিচারিক নজির পুনর্বিবেচনা
- এহসান এ সিদ্দিক
- ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:০১
৫ আগস্ট ২০২৪-এ পতন হওয়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছয়জন বিরোধী রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, যাকে অনেকে বিচারিক হত্যার নির্লজ্জ মামলা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এসব ফাঁসি, একজন স্বৈরাচারী সরকার প্রধানের নির্দেশে পরিচালিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তদানীন্তন আপিল বিভাগের সম্পৃক্ততায় সংঘটিত হয়েছিল। এ রাজনৈতিক ফাঁসির প্রথমটি ছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড।
মোল্লার মামলাটি অসাধারণ ছিল, কারণ তাকে তার মৃত্যুদণ্ডের আপিল করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তার মৃত্যুদণ্ড ত্বরান্বিত করতে, আপিল বিভাগ শুধু আন্তর্জাতিক আইনি মান উপেক্ষা করেনি বরং জেরা-পরীক্ষার নিয়মও পরিবর্তন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রসিকিউশনের সাক্ষী মোমেনা বেগমের ট্রাইব্যুনালে দেয়া বিবৃতি তদন্ত কর্মকর্তার আগের বিবৃতির সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সাক্ষ্যের মধ্যে যখন গুরুতর অসঙ্গতি দেখা দেয়, তখন আপিল বিভাগ রায় দেয় যে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া আগের বিবৃতিগুলো অগ্রহণযোগ্য ছিল। এ ধরনের বিচারিক আচরণ একটি উদ্বেগজনক প্রশ্ন উত্থাপন করে যে ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পরে, এসব মৃত্যুদণ্ডকে কি বৈধ বিচারপ্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করা উচিত, নাকি সেটি আইনের শাসন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুতি ছিল বলে দেখা হবে? ৫ আগস্টের পরের বিচার বিভাগ কি এগুলো বাধ্যতামূলক আইনি নজির হিসেবে দেখবে?
এ রাজনৈতিক বিচারের সময় ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও প্রসিকিউটরদের আচরণ বিচারিক প্রক্রিয়া এবং ন্যায়বিচারকে উপহাসের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত স্কাইপ কেলেঙ্কারিটি প্রকাশ করেছে যে, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: নিজামুল হক এবং প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম কিভাবে তাদের ব্যক্তিগত আচরণ আদালত কক্ষে সমন্বয় করার কথা বলেছেন। এতে তাদের মধ্যকার সে আলোচনা রয়েছে, যেখানে তারা পরের দিন খোলা আদালতে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারের বিভ্রম সৃষ্টি করতে কিভাবে যুক্তি উপস্থাপন করবেন সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রক্রিয়াটি নিরপেক্ষ ছিল মর্মে মিডিয়া এবং জনসাধারণকে প্রতারিত করতে পারফরম্যান্সটি করার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে, এটি একটি ‘রাজনৈতিক শো ট্রায়াল’ ছাড়া আর কিছু ছিল না, যা পূর্বনির্ধারিত ফল অর্জনে সাজানো হয়েছিল।
তদন্তকারীরাও ন্যায়বিচারের বিকৃতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সাক্ষ্য দেয়ার আগে সাক্ষীদের একটি সেফ হাউজে রাখা হয়েছিল এবং ‘প্রশিক্ষিত’ করা হয়েছিল। যদি একজন সাক্ষীর প্রশিক্ষণ অপর্যাপ্ত হয়, তাহলে তাদের ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির করা হয়নি, যা উপস্থাপিত প্রমাণের সত্যতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহের জন্ম দেয়। বিচারক, প্রসিকিউটর ও তদন্তকারীরা যখন একজন প্রতিরক্ষা সাক্ষীকে অপহরণের ষড়যন্ত্র করেন; তখন অবিচারের সবচেয়ে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।
আবদুল কাদের মোল্লার মামলাটি দেখায় যে কিভাবে একটি রাষ্ট্র-অনুমোদিত ‘বিচারিক হত্যা’ হিসেবে গভীরভাবে বিবেচিত ঘটনা ঘটাতে রাষ্ট্রের তিনটি শাখা, নির্বাহী, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ পরস্পরকে সহযোগিতা করেছিল। শাহবাগের বিক্ষোভের পরে নির্বাহী বিভাগ তার অভিপ্রায় স্পষ্ট করে, যেখানে জনতা মোল্লার মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছিল মর্মে দেখানো হয়। প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে আদালতকে ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার’ আহ্বান জানান। এটি বিচার বিভাগের ওপর অজাতিত চাপ সৃষ্টি করে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে সম্পূর্ণ অসঙ্গিতিপূর্ণ। আইন সভা নির্বাহী প্রভাবে আইনটি সংশোধন করে, সরকারকে মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা মৃত্যুদণ্ডে উন্নীত করতে আপিলের অনুমতি দেয়। অবশেষে, বিচার বিভাগ সাক্ষ্যপ্রমাণে উল্লেখযোগ্য অসঙ্গতি উপেক্ষা করে, ক্রস-পরীক্ষার মান শিথিল করে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। পদ্ধতিগত সুরক্ষা ব্যবস্থার এ বিলুপ্তি মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। সেই সাথে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করেছে, যা নিরপেক্ষ সালিসের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সহায়ক হিসাবে বিচার বিভাগের ভূমিকা প্রকাশ করেছে।
৫ আগস্ট, ২০২৪-এর ঘটনার পর, সরকার উৎখাত করা হয়, সংসদ ভেঙে দেয়া হয় এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ উল্লেখযোগ্য পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যায়। আবদুল কাদের মোল্লা এবং অন্য পাঁচজন বিরোধী রাজনীতিককে ফাঁসি দেয়ার ষড়যন্ত্রের সময়ের রাষ্ট্রীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পুরোপুরি বদলে যায়। তার পরও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অনেক মামলা নতুন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলা, যাকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেন এবং ৫ আগস্টের আগের আপিল বিভাগ তা বহাল রাখেন।
এখন আইনজীবীরা সরকারের ধারাবাহিকতা গ্রহণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে, যার মধ্যে এ অনুমান রয়েছে যে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের পরিবর্তন নির্বিশেষে তার নীতিতে যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। তবে, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে, এই অনুমান মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। বিপ্লবের দ্বারা পুনর্গঠিত বর্তমান আপিল বিভাগ, অতীতের বিচারিক পক্ষপাত প্রত্যাখ্যান করার আন্দোলনের মূলে থাকা মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। বিচারব্যবস্থা আজ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিচার বিভাগের সরাসরি উত্তরসূরি নয় বরং এর অনুশীলন থেকে আমূলভাবে পরিবর্তিত একটি বিভাগ।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, আইনজীবী হিসাবে আমাদের কি ৫ অগাস্ট-এর আগের বিচার বিভাগ দ্বারা মৃত্যুদণ্ড আরোপ এবং বহাল রেখে দেয়া রায়কে বৈধ বিচারিক নজির হিসাবে বিবেচনা করা উচিত? জোরালোভাবে এর আবশ্যকীয় উত্তর হওয়া উচিত ‘না’। অন্যথায় ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের ঘটনাগুলোর বৈপ্লবিক তাৎপর্যকে অস্বীকার করা হবে। এ বিপ্লব ছিল অতীতের বিচার ব্যবস্থার একটি স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান, যা রাজনৈতিক বিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে সহায়তা করেছিল, বিচার বিভাগকে দমনের রাষ্ট্রীয় উপকরণে পরিণত করেছিল। মৃত্যুদণ্ডগুলো নিয়মিত বিচারিক কার্যাবলীর ফল নয় বরং বিচারিক ক্ষমতার অপব্যবহারের ফল ছিল।
এ ধরনের মামলার আপিল বা পর্যালোচনা পর্যায়ে আইনজীবীদের জন্য উপলব্ধ উপাদানসমূহ অনুমান করে যে পূর্ববর্তী শাসনের বিচারিক প্রক্রিয়াগুলোর প্রেক্ষাপটে বিচার বিভাগ ন্যায্যতা ও নিরপেক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়নি। তাই এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র অর্থবহ উপায় হলো বিপ্লবের দ্বারা সংঘটিত স্বচ্ছ পরিবর্তনকে স্বীকার করা এবং ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের বিপ্লবের আলোকে অতীতের শাস্তি ও দণ্ড পুনর্বিবেচনায় বর্তমান বিচার বিভাগকে আমন্ত্রণ জানানো। এই পদ্ধতির নজির ২৩ এপ্রিল, ১৯৭৫ তারিখে দেয়া মেসার্স হাজি আজম বনাম সিঙ্গেলটন বিন্দা অ্যান্ড কোং লিমিটেডের মামলার রায়ে পাওয়া যায়। সেই ক্ষেত্রে, হাইকোর্ট ব্যাখ্যা করে স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কার্যনির্বাহী কর্মের বৈধতা প্রত্যাখ্যান করার জন্য ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণা। বিচার বিভাগ ১৯৭১-কে ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে একটি বিচ্ছিন্নতা হিসাবে বিবেচনা করে এবং মনে করে যে পাকিস্তানের যেকোনো আইন, চুক্তি বা নির্বাহী সিদ্ধান্ত শুধু নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র দ্বারা স্পষ্টভাবে গৃহীত হলে তা বাংলাদেশের জন্য বাধ্যবাধকতা হিসাবে গণ্য হবে। এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং এর স্বাধীনতার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কাঠামো যাচাই ও প্রত্যাখ্যান করার অধিকার পুনর্নিশ্চিত করেছে।
একইভাবে, ২০২৪ সালের বিপ্লব একটি বিচ্ছেদ বিন্দুকে চিহ্নিত করে। আইনজীবীদের বিগত শাসনামলের বিচার বিভাগের সাথে ধারাবাহিকতা না ধরে এটিএম আজহারুল ইসলামের মতো মামলার যুক্তি বিবেচনা করা উচিত। বিজ্ঞ আইনজীবী সম্প্রদায়কে অবশ্যই অতীতের অনুশীলনগুলোর একটি বিচার বিভাগীয় পুনঃপরীক্ষার পক্ষে ওকালতি করতে হবে, এই স্বীকৃতি দিয়ে যে আজকের বিচার বিভাগটি ক্ষমতাচ্যুত শাসনের সেবাকারী থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। শুধু এ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে আইনজীবীরা সত্যিকার অর্থে অতীতের অন্যায়ের মোকাবেলা করতে পারেন এবং বিপ্লবের নীতিগুলো সমুন্নত রাখতে পারেন, যা বাংলাদেশকে একটি নতুন অবয়ব দিয়েছে।
বিগত শাসনামল থেকে বিচারিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা অবিচ্ছিন্ন ধরে নেয়ার অর্থ হবে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পরিবর্তনকে মৌলিকভাবে দুর্বল করা। বিপ্লবটি কেবল একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন ছিল না বরং আগের বিচার বিভাগের পদ্ধতিগত পক্ষপাত ও অপব্যবহারের সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান ছিল। বর্তমান বিচারব্যবস্থা, এ অভ্যুত্থানের পরে পুনর্গঠিত এবং ন্যায্যতা, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচারে নিহিত একটি নতুন বাংলাদেশের মূল্যবোধ ও আকাক্সক্ষাকে মূর্ত করে। ক্ষমতাচ্যুত শাসনব্যবস্থার অন্যায্য বিচারিক ক্রিয়াকলাপগুলোকে বর্তমান বিচারব্যবস্থার সমতুল্য হিসাবে বিবেচনা করা কেবল বিপ্লবের গভীর তাৎপর্য উপেক্ষা করবে না বরং এটি যে অন্যায়-অবিচারগুলো ভেঙে দিতে চেয়েছিল তা স্থায়ী হওয়ার ঝুঁকিও বহন করবে। আইনজীবী ও আইনি সম্প্রদায়ের এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে স্বীকৃতি দেয়া অপরিহার্য এ কারণে যে, অতীতের বিচারিক অনুশীলনগুলো এমন একটি ব্যবস্থার অবশেষ হিসাবে বিবেচনা করা দরকার যা আজকের নীতির সাথে আর সারিবদ্ধ নয়। এই লেন্সের মাধ্যমে অতীতের অন্যায়ের উত্তরাধিকার পুনঃপরীক্ষা ও সমাধানের মাধ্যমে বিচার বিভাগ সত্যিকার অর্থে বিপ্লবের আদর্শ সমুন্নত রাখতে এবং সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তার ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের
নিবন্ধিত কৌঁসুলি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা