২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭ মাঘ ১৪৩১, ২০ রজব ১৪৪৬
`

ভারতের আধিপত্যবাদ কোন পর্যায়ে

-

পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ক্ষমতা ত্যাগ করে পালানোর পর থেকে ভারত তাকে আশ্রয় দেয়াসহ নানা রকমের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের প্রতি ভারতের লোক দেখানো সমর্থনের পেছনে মূলত ছিল বাংলাদেশের সম্পদ ও কলকারখানা দখল ও করায়ত্ত করার লিপ্সা। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের যেসব ক্ষতি সাধন করেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতার নামে যুদ্ধ চলাকালীন মাত্র ৯ মাসে এবং পরবর্তী সময়ে এর চেয়েও অনেক বেশি সম্পদ চুরি ও লুণ্ঠন করেছে ভারত।

বাংলাদেশের প্রতি ভারত অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন, আগ্রাসী মনোভাব ও আধিপত্যবাদী আচরণ অব্যাহত রেখেছে। উজানে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি বন্ধ করে রাখে। আবার বর্ষা মৌসুমে পানি ছেড়ে দিয়ে ডুবিয়ে মারে বাংলাদেশের জনগণকে। সব নদী শুকিয়ে গেছে, নদী আর নদী নেই, এখন খালে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে ভারত কখনোই প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করেনি, বরং তারা সবসময় চেয়েছে ‘তুলার পরিবর্তে বাঁশের ব্যবহার’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের বিরুদ্ধে আধিপত্যের থাবা তারা বিস্তার করেই যাচ্ছে।

বিল, ঝিল, হাওর-বাঁওড় সব বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পানির অভাবে। একই কারণে বাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, বগুড়া, দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গাসহ অনেক জেলায় ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ মাত্রাতিরিক্ত দেখা যাচ্ছে। মানুষ স্বাভাবিক খাবার পানিটুকুও পান করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রায় ৬০টি জেলার ২৭১টি উপজেলায় প্রায় আট থেকে ১০ কোটি মানুষ আর্সেনিক ভুক্তভোগী। নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে কৃষি সেচ, ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট হচ্ছে। শিল্প-বাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ধারাবাহিকভাবে। উত্তরাঞ্চলের পদ্মা, যমুনা, তিস্তা নদী এখন প্রায় সারা বছরই শুকিয়ে থাকে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ১০টি জেলা খরা মৌসুমে মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। অপরপক্ষে বর্ষা মৌসুমে প্রায় প্রতি বছর বন্যায় ব্যাপকভাবে ফসল, গবাদিপশু ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে কৃষকরা ক্রমান্বয়ে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। দেশের পশ্চিম সীমান্তে ১৯ মাইল উজানে ফারাক্কা নামক স্থানে ১৯৬১ সালে ভারত বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। ১৯৭৪ সাল থেকে ফিডার ক্যানেল পরীক্ষা করার কাজ শুরু করলেও তাদের পরীক্ষা আজো পর্যন্ত সমাপ্ত হচ্ছে না। বরং পরীক্ষার নামে প্রতি বছর বর্ষাকালে ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারা হচ্ছে। আসল কথা ভারতের নীতি হচ্ছে- ‘সালিস মানি, কিন্তু বটগাছ আমার।’

পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে এখন ধু-ধু মরু প্রান্তর। কোথাও কোথাও খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ এসেছে- যা শিশুদের বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সরকারই ভারতের সাথে নানা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এগুলো শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বর্তমানে বহু নদীতে প্রমত্ত পানি প্রবাহের পরিবর্তে দেখা দিয়েছে শুকনা মাঠ, সেগুলো গরু-ছাগল, মহিষ-ভেড়ার বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে নৌপথের দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিলোমিটার থাকলেও বর্তমানে তা ছয় হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

কারণে অকারণে বিভিন্ন সময় সীমান্তের গ্রামগুলো থেকে যখন তখন খামখেয়ালিপনার মাধ্যমে আমাদের নাগরিকদের বিএসএফ ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং বছরের পর বছর জেলে বন্দী করে রাখছে। প্রতিনিয়ত তারা সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের কারণে অকারণে হত্যা করছে। ফেলানীকে হত্যা করার পর তাকে নির্মমভাবে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এক কিশোরীর এমন লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু আজো এর বিচার করা হয়নি।

১৯৭১ সালে ভারতের চালবাজি রাজনৈতিক দলগুলো আঁচ করতে পারেনি তা নয়। অনেক দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তাই ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে বিব্রতবোধ করেছিল। ৫৩ বছর আগে রাজনৈতিক দলের যে উপলব্ধি ছিল, আজ ৫৩ বছর পরে এসে বাংলাদেশের জনগণ সেটা টের পাচ্ছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেসব সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের প্রায় সবাই ভারতের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে। তবে ভারত সবচেয়ে বেশি সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার আমলে। পতিত স্বৈরাচারী সরকারের একজন মন্ত্রীর ভাষ্যমতে, এ আমলটা নাকি ‘ভারতের সাথে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল’। তাই ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে শেখ হাসিনা অন্য কোথাও জায়গা না পেয়ে ভারতের কোলে আশ্রয় নিয়েছে।

বাংলাদেশ বিগত ষোল বছরে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক সুবিধার নামে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতকে রেল-ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।

আগস্ট বিপ্লবে ছাত্র এবং জনতার সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটানোর মতো বিজয় সম্ভব হলেও ভারতীয় আধিপত্যবাদের মূলোৎপাটন করা এখনো সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব¡ ও জাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ সৃষ্টি না করে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারতের বিরামবিহীন আধিপত্যবাদ এবং গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগ্রত হতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ গবেষক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement