শিল্প খাত বিকাশে পরিবেশ চাই
- মো: মাঈন উদ্দীন
- ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:৪২
বিগত বছরগুলোতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো চালু হলেও নতুন শিল্প খাতে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। নানা কারণে পুরনো কারখানা যে হারে বন্ধ হয়েছে তার বিপরীতে নতুন শিল্প-কারখানা চালু হয়নি। করোনা মহামারীর কারণে দুই বছরের মতো অনেক কারখানা বন্ধ ছিল এবং অনেকে আবার স্বল্প সক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। এতে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহ পাচ্ছেন না দেশীয় বিনিয়োগকারীরা। বরং অনেকেই দেশের অর্থ বৈধ ও অবৈধ উপায়ে বিদেশে পাচার করে অন্য দেশে বিনিয়োগ করেছে। সাম্প্রতিক অনিশ্চয়তায় আশা পাচ্ছেন না বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও। এতে শিল্প খাতে কাক্সিক্ষত সম্প্রসারণ হচ্ছে না।
শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমতে থাকা অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো দিক নয়। কেননা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ জিডিপিতে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমে গেলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিবিএসের তথ্যানুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। পরের বছর ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পতনের ধারা অব্যাহত থাকায় এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সর্বশেষ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিল্পের প্রবৃদ্ধি গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন্ন স্তরে নেমে আসে। সে বছর প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার কিছু দিন পর থেকেই দেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেন। এতে শতাধিক কারখানায় হামলা হয়েছে। প্রায় দুই শতাধিক কারখানা তখন বন্ধ রাখতে হয়েছে। শ্রমিক নেতাদের ভাষ্যমতে, ‘এতে সব মিলিয়ে শিল্প খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে।’ শিল্পে কাঁচামাল সরবরাহ সঙ্কটের কারণে শিল্প-কারখানা বন্ধ, পতিত স্বৈরাচার সরকারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। কমেছে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিনিয়োগ এসেছে ১৪৭ কোটি ডলার। যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৬১ কোটি ডলার। বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। ফলে বেকারত্ব বাড়তে থাকে। দেশে বর্তমানে বেকার ২৬ লাখ ৬০ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২৪ সালের শুরুতে দেশে বেকার মানুষ কম থাকলেও বছর শেষে ধারাবাহিকভাবে এ সংখ্যা বেড়েছে। মূলত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের প্রভাবে বছরের শেষ সময়ে বেড়েছে বেকার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৭০ হাজার।
বিবিএসজরিপ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কৃষি, সেবা ও শিল্প সব খাতেই কমেছে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী। নারীর চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেশি বেড়েছে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটেছে, যার ফলে দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে এই কৃষি খাত ও কৃষক সমাজ। এখন এই কৃষক প্রজন্মই শিল্প-কারখানায় কাজ করে বাংলাদেশকে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশক ধরে বেসরকারি খাতের শিল্প তিন হাজার থেকে বেড়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে প্রায় ৮৮ লাখ কারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু কারখানার সংখ্যা বাড়লেও শিল্প-কারখানায় তেমন গুণগত উন্নয়ন হয়নি। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির অনেক সম্ভাবনা থাকলেও অতীতের সরকারগুলো দেশের শিল্প বিকাশের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও সেগুলো বাস্তবায়নে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও নানা অনিয়মের কারণে যতটুকু উন্নতি হওয়ার কথা তা না হয়ে বরং আনুপাতিকভাবে উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানার সংখ্যা বাড়ার পরিবর্তে কমেছে। ১৯৭৩ সালে মোট রফতানির মধ্যে ৫২ শতাংশ পাটজাত পণ্যের দখলে ছিল। এর পাশাপাশি তখন অল্প অল্প করে চা, চিনি, কাগজ ও চামড়া শিল্প খাতও জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তর সরকারের জাতীয়করণ-নীতি ও তার প্রায় এক দশক পর বেসরকারীকরণ-নীতি দেশের শিল্প খাতের উত্থান-পতনের অনেক ঘটনা ঘটে থাকে, যা পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে অগ্রগতির দিকে মোড় নেয়।
১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) কৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৯.৪ শতাংশ। আর শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে মাত্র ৬.৬ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ। স্বাধীনতার পর বিগত ৫৩ বছর সময়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলো পাল্টেছে, ক্রমে শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হয়েছে, যা অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো বদলে দিয়েছে। শিল্পায়নের সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় অতীতের পতিত সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করার কথা থাকলেও বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ ও দেশের বৃহত্তম স্বার্থে আপাতত পাঁচটি সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছে। সেই সাথে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আরো পাঁচটি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে আগামী আড়াই বছরে দুই লাখ ৩৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করতে চায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। বর্তমানে দেশে দেশী-বিদেশী মিলে মোট ১৯টি অর্থনৈতিক জোনে যেসব শিল্প-কারখানা আছে তাতে প্রায় ১২২টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখনো গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। শ্রমিকদের আবাসিক সঙ্কটের কারণে কারখানার উৎপাদন বিঘ্ন হচ্ছে।
বিগত সরকারের নানা লুটপাট, অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রভাব শিল্প খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দেশে একের পর এক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়েছে। বিনিয়োগে নেমে আসে স্থবিরতা। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৪২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় এসেছে। ঊর্ধ্বমুখী সুদহারে নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন না হওয়ায় কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। কয়েক মাসে ১০টির মতো টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়েছে। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৮৩টি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়াও সিমেন্ট, ইস্পাত ও কাগজ শিল্পের অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাজার অস্থিতিশীলতা, সুদহার বৃদ্ধি, ঋণপত্র খোলার (এলসি) অভাবে কাঁচামাল অপর্যাপ্ততা, শ্রমিক অসন্তোষ ও কারখানার উৎপাদন কার্যক্রমের অপ্রতুলতার কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার নতুন করে বিনিয়োগের সাহস পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে বিনিয়োগ। এতে দেখা যায় ২০২৪ সালের নভেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি বার্ষিক ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা অক্টোবর মাসে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। এটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম অর্ধাংশের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ৯ দশমিক ৮০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ১৪ শতাংশ কম।
সম্প্রতি সরকার শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে তাতে শিল্প খাত কঠিন সঙ্কটে পড়তে পারে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অর্থনীতির প্রতিটি খাতকেই প্রভাবিত করবে। আমাদের উৎপাদন খরচ, পরিচালন খরচ বিবেচনা করে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। গ্যাস উত্তোলনের জন্য যে ধরনের বিনিয়োগ দরকার ছিল, যে ধরনের এক্সপ্লোরেশন দরকার ছিল; সেগুলোর উদ্যোগ ইতঃপূর্বে নেয়া হয়নি। এর ফলে সব জায়গায়ই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মূল্যবৃদ্ধির পরও ব্যবসায়ীরা গ্যাসের সরবরাহ পাচ্ছেন না। সরবরাহে নতুন সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না, যাদের সংযোগ আছে তারাও পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে শিল্প-কারখানা ও তার উৎপাদনে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এর থেকে উত্তরণের জন্য মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। এতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অপচয় রোধ করতে হবে।
শিল্প বিকাশ, শিল্প খাতের উন্নয়নে আমাদের দেশে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, রয়েছে কাঁচামালও। বন্ধ জুটমিল, চিনিকলসহ যেসব কারখানা চালু করার সুযোগ রয়েছে তা অবিলম্বে চালুর ব্যবস্থা করতে হবে, প্রয়োজনে বিদেশী বিনিয়োগ এনে, জরুরি মেশিনারি আমদানি করে হলেও তা করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ সব শিল্পে গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের অনেক দক্ষ শ্রমিকও রয়েছে, রয়েছে অনেক অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান। প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও গাইডের অভাবে মেধাবীরা বিদেশে গিয়ে অন্য দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। আমাদের রয়েছে অনেক সৎ ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবসায়ী। তাদের ব্যবসায় করার পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
ইমেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা