ব্যাংকিং নীতির সংস্কার জরুরি
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:৩০
ব্যাংকের বাইরে যে অর্থপ্রবাহ আছে, যে আর্থিক লেনদেন আছে তাকে ‘কালো টাকা’, ‘অপরিশোধিত অর্থ’, ‘মাট্রেস ম্যানি’, ‘ছায়া অর্থনীতি’, ‘মহাজনি কারবার’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। আধুনিক অর্থনৈতিক কাঠামোর নিরন্তর প্রচেষ্টা সবধরনের আর্থিক লেনদেন ও ব্যবসায়িক-বাণিজ্যিক কার্যক্রম যেন ব্যাংকের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতির কাঠামোর বাইরের কোনো দেশ নয়। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে চেষ্টা করছে শতভাগ লেনদেন ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাই সব আয়ের, সব শ্রেণীর মানুষকে ব্যাংকিং খাতের আওতায় আনতে শাখা-উপশাখা, এজেন্ট, বুথ, মোবাইল ব্যাংকিং, বিনামূল্যে ব্যাংকিং সেবাসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
দেশের কোনো কোনো ব্যাংকে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশী বিনিয়োগকারী রয়েছে। বর্তমানে ৬২ ব্যাংক কার্যক্রমে রয়েছে। এই ব্যাংকগুলোর ১১ হাজার ৩০০টি শাখা রয়েছে। এগুলোতে দুই লাখ ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
ব্যাংকিং খাত সীমাহীন দুর্নীতির আখড়া হিসেবে তকমা পেয়েছে। যদিও বেসরকারি খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়মতান্তিক প্রতিষ্ঠান দেশের ব্যাংকিং খাত। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান করে এবং এর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হচ্ছে। এর বাইরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান। তবে দুর্নীতি শুধু ব্যাংকিং খাতে হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। সব খাতের সব স্তরে দুর্নীতি ও অনিয়মের সাইক্লোন বয়ে গেছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে কারণ ব্যাংকিং খাত হচ্ছে অর্থনীতির প্রাণ। অর্থনীতি ভেঙে পড়লে পুরো রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে। অর্থনীতির ‘ব্লাড’ বলা হয় মুদ্রাকে, সেই মুদ্রার গতিপথ দেশের ব্যাংকিং খাত।
২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে মোট দেশজ আয় (জিডিপি) ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়ে আকার দাঁড়াবে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। এই প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, মানুষের আয় বাড়াতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, বৈদেশিক মুদ্রার আয় বৃদ্ধি করতে হবে। সবগুলো কাজই ব্যাংকের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। অর্থনীতির এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে পুঁজির জোগান হিসেবে ব্যাংকিং খাত থেকে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এই ঋণের স্থিতি ছিল ২১ লাখ ১৫ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই ঋণ বাড়বে ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান বাড়বে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ আর সরকারি খাতে ঋণ বাড়বে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।
মুদ্রানীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নের গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব বাজেটেও ব্যাংকিং খাতের অবদান বড় হচ্ছে। সরকারের ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নের বড় উৎস এখন ব্যাংকিং খাত। চলতি অর্থবছরের সাত লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি বাজেটের এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকাই জোগান দেবে দেশের ব্যাংকিং খাত। প্রতি বছরই ঘাটতি পূরণে ব্যাংকগুলো অর্থের জোগান দিয়ে আসছে।
অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাতের মূল অবদান হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো চ্যানেল হিসেবে কাজ করে। এক দিকে মানুষের আমানত সংগ্রহ করে, অন্য দিকে সংগৃহীত আমানতের অর্থ বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করে। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ১৮ লাখ ৯১ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে ১৬ লাখ ১৯ হাজার ৭০৫ কোটি ঋণ বিতরণ করেছে। এই বিনিয়োগই সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। বিনিয়োগের ফলে নতুন শিল্প ও ব্যবসায় সৃষ্টি হয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, উৎপাদন বাড়ে। আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে লেনদেন বৃদ্ধি পায়। জাতীয় এবং রফতানি আয় বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতির যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এতেই মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে সহায়তা করে, যেটি আধুনিক রাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাম্য। তবে হতাশার দিক হলো বিগত দীর্ঘ সময়ে নানা ধরনের অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাত ব্ল্যাক হোলে (কৃষ্ণগহ্বর) পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি-বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ব্যাংক খাত বিধ্বস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে। ব্যাংকগুলো যে ঋণ দিয়েছে তার মধ্যে ছয় লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি এবং খেলাপিযোগ্য ঋণ। শ্বেতপত্রে এই ঋণকে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত পরিসংখ্যানে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, তথ্য গোপন করে এবং নানা কৌশলে বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
অর্থনীতির বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে ব্যাংকিং খাত। তবে তত্ত্বীয় ব্যাংকিং নীতি এবং উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর ব্যাংক ব্যবস্থার সাথে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অনেক ‘মিচম্যাচ’ রয়ে গেছে। এই ‘মিচম্যাচ’ বা ভুলনীতি ব্যাংকগুলোকে একধরনের ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। যেই ঝুঁকি পুরো অর্থনীতির ওপর পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণত ব্যাংকের কাজ স্বল্পমেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে স্বল্পমেয়াদে ঋণ বিতরণ করা। চলতি মূলধন, কাঁচামাল ক্রয়, বেতনভাতা পরিশোধ, ওয়ার্ক অর্ডার, ফাইন্যান্স বা এ ধরনের স্বল্পমেয়াদে ঋণ বিতরণ করা। কিন্তু ব্যাংকগুলো কারখানা স্থাপন, মূলধনী যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মতো কাজে দীর্ঘমেয়াদে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ করছে। এটি আসলে করার কথা পুঁজিবাজারকে এবং ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংককে। স্বল্পমেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ বিতরণ করতে গিয়ে প্রথম দিন থেকেই ব্যাংক তারল্য সংগ্রহের বড় চাপের মধ্যে পড়ে যায়।
মাসিক, ত্রৈমাসিক, বাৎসরিক ভিত্তিতে আমানত সংগ্রহ করে ঋণ দিচ্ছে ২০-২৫ বছর পর্যন্ত। বিতরণকৃত ঋণের টাকা আদায় করতে সময় লাগলেও আমানতকারীর সমুদয় অর্থ ফেরত দিতে হচ্ছে স্বল্পসময়ের মধ্যে। তারল্য ব্যবস্থাপনায় সবসময় চাপের মধ্যে থাকায় অর্থনীতির ছোটখাটো চাপ সহ্য করতে পারছে না দেশের ব্যাংক খাত। রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে দেশের পরিস্থিতি সামান্য টালমাটাল হলেই ব্যাংকগুলো সবার আগে ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেয়। কারণ অর্থনৈতিক অচল অবস্থা সৃষ্টি হলে নতুন করে আমানত আসবে না কিন্তু আগের জমাকৃত আমানত ফেরত নেয়ার প্রবণতা বাড়বে।
ঋণ ও আমানতের মেয়াদের মিচম্যাচের এই প্রবণতা ব্যাংকগুলোকে কতটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে তা সম্প্রতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। অন্তত ১০টি ব্যাংক তাদের আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। কারণ ওই ব্যাংকগুলোতে আমানতাকারীদের সব অর্থই দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করেছে। যদিও ওই ঋণ বিতরণে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। অনিয়ম হয়নি এমন ব্যাংকের পক্ষেও একযোগে বা স্বল্প নোটিশে অধিকাংশ পরিমাণ আমানতকারীর অর্থ ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। ঋণের দীর্ঘমেয়াদের কারণে সঙ্কটে পড়লেও ব্যাংক অর্থ ফেরত আনতে পারে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সহযোগী ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার নিতে বাধ্য হয়। ভবিষ্যতের ব্যাংকিং খাতকে আন্তর্জাতিক মানের করতে ও শক্তিশালী করতে নীতিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। বিদ্যমান নীতিমালা যেহেতু অর্থলোপাটের বিরুদ্ধে কার্যকর হয়নি সেটিও যুগোপযোগী করতে হবে। তরুণদের প্রত্যাশাকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বপ্নময় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় সেই প্রত্যয়ের প্রতিফলন ঘটাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে। নীতি, কাঠামো, কৌশল সব ক্ষেত্রেই অবশ্যম্ভাবী সংস্কার যত দ্রুত করা সম্ভব ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
লেখক : হেড অব কমিউনিকেশন ডিভিশন, এনআরবিসি ব্যাংক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা