১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ মাঘ ১৪৩১, ১৪ রজব ১৪৪৬
`

বিচার বিভাগ সংস্কারে কিছু প্রস্তাব

-

সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে প্রথম পরিচ্ছেদে বিচার বিভাগ-সম্পর্কিত বিধানাবলি সন্নিবেশিত করা হয়েছে, যার ৯৪(১) দফায় আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট’ গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

বিচারক নিয়োগ-সংক্রান্ত দফা ৯৫-তে উল্লেখ আছে ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’ এই বিধান সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব, ক্রমিক অনুসারে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন, যার ফলে সিনিয়রিটি ভঙ্গ করার অতীত অসন্তোষ-বিতর্কের অবসান ঘটবে। অন্যান্য বিচারক নিয়োগদান সম্পর্কে আমাদের প্রস্তাব, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগদানে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যার প্রধান থাকবেন প্রধান বিচারপতি এবং সদস্য হবেন আপিল বিভাগের একজন বা দু’জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি। এ প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি হলো বেঞ্চ ও বার উভয়ের সমন্বয়েই বিচার বিভাগ, দু’টি অবিচ্ছেদ্য, একটিকে বাদ দিলে আর একটি অচল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদে বারকে উপেক্ষা করা হয়েছে।

বিশেষ করে বিচারক নিয়োগে বারের সুপারিশ অপরিহার্য। কারণ, আইনজীবীদের মধ্য থেকে কারা বিচারপতি হিসেবে যোগ্য এবং নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম সে বিষয়ে বারের সুপারিশ হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর। বারের পক্ষ থেকে সভাপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের সুপারিশ নিয়োগ দানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। প্রস্তাবিত কমিটি নিয়োগ দান বিষয়ে বিধিমালা প্রণয়ন করে পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ সম্পন্ন করতে পারে।
৯৫ দফার (২) উপ-ধারার (ক) এবং (খ) তে অন্যূন ১০ বছরের স্থলে ২০ বছর করার প্রস্তাব করছি, কেননা হাইকোর্ট বিভাগে ১০ বছর তালিকাভুক্ত হলেও এক দিনের জন্যও স্বাধীনভাবে কোনো মামলা পরিচালনা করতে দেখা যায়নি এমন আইনজীবীও ইতঃপূর্বে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন। বিচারকদের পদের মেয়াদ সম্পর্কিত দফা ৯৬(১)-এ সাতষট্টির পরিবর্তে সত্তর করার প্রস্তাব করছি।

দফা-৯৬(৩)-এ উল্লিখিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বারের প্রতিনিধি হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট বারের সিটিং সভাপতির নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করছি।

স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিটি গঠন করেছে; কিন্তু বিচার বিভাগ সম্পর্কিত কোনো সংস্কারই ফলপ্রসূ হবে না, যতক্ষণ না আইনবীজী সমাজ দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে সরে আসবে, আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ না করবে। নব্বইয়ের পর থেকে আইনজীবীরা দেশের বৃহৎ দুটো রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দু’টি দলের কর্মকাণ্ডে, বিশেষ করে নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় উচ্চ আদালতসহ সব আদালতে উপযোগী পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। বাস্তবতা এমন হয়ে উঠেছিল যে, রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে কোনো বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়নি। ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অতীতের মতো ঐকমত্যের ভিত্তিতে আইনজীবীদের কোনো অবদান রাখা সম্ভব হয়নি। যার ফলে বিচারকরাও রাজনৈতিক চাপ-প্রভাবমুক্ত থেকে ন্যায়ভিত্তিক রায় বা আদেশ দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

পরিশেষে প্রধান বিচারপতির সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলি, আইনজীবী বা রাজনৈতিক দলগুলো যদি এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নেয় তাহলে বিচার বিভাগের মর্যাদা পুনরুদ্ধার, ন্যায় ও আইনভিত্তিক আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা এবং আদালত অঙ্গনে পেশার উপযোগী পরিবেশ রক্ষার্থে উচ্চতর আদালতসহ সব অধস্তন আদালত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ আপনারই নেয়া উচিত।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement