১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১, ১৩ রজব ১৪৪৬
`

‘লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’

-

রাজনৈতিক দলই দেশ পরিচালনা করবে এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। তা সে ডান-বাম মধ্য যা-ই হোক। সমাজের উঁচু কাঠামোতে যাদের অবস্থান অন্তত তাদের মধ্যে এ বিষয়ে কারো কোনো মতভেদ নেই। উঁচু কাঠামো প্রসঙ্গ টানলাম এই জন্য যে, বৈষম্যের কলাকৌশল, নির্যাতন-শোষণে, অন্যায়-অত্যাচারে শেকড় পর্যায়ের লেজুড়দের চাঁদাবাজি পেশিশক্তি ইত্যাদি কারণে গ্রাম-ওয়ার্ড-ইউনিয়ন পর্যায়ের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে গরিব পুষ্টিহীন নাগরিক ভোটারদের অধিকার সংরক্ষণ না থাকায়, ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা না পাওয়ায়, তারা রাজনীতিকদের ওপর বীতশ্রদ্ধ। তাদের কাছে উচ্চতর কাঠামোর রাজনৈতিক নেতা উপনেতারা প্রশ্নবিদ্ধ। ধনীদের উপরে গরিবের অন্তর- আস্থা কাজ করে না। ঐকমত্যে উপরের কাঠামো ও নিচের প্রান্তিকদের বৈষম্য, নীরবে নিভৃতেই থেকে যায়। প্রান্তিক পর্যায়ের আমজনতা বিচার-আচারে, আইন-সালিসে, অসৎ দলবাজিদের ‘হাত বদল’-এর কাছে একেবারে অসহায়। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া রাজনৈতিক মুক্তি অকার্যকর। কেরোসিন তেলের মেশিন থেকে কখনোই সরিষার তেল বের করা যায় না।

এ জন্যই জুলাই-আগস্ট ’২৪-এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের ফসল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্ভব। মাঠে ও দেশে-বিদেশে অবস্থানরত কেন্দ্রীয় আদর্শিকরা দীর্ঘ দিনের সমস্যা ও পরিবর্তন ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার-মেরামতে কেউই ভিন্নমত পোষণ করছে না। বক্তব্য শুধু কতদিন থাকবে অন্তর্বর্তী সরকার, কতদিন লাগবে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করতে। এখানেই কারো কারো ‘মন মানে না, দেরি আর সয় না, গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি...’। পরিবর্তন আকাক্সক্ষীদের দেয়ালে গ্রাফিতিতে আছে ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ; যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তুমিই বাংলাদেশ’। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং তৎকর্তৃক গঠিত সংস্কার কমিশনকেও সতর্কভাবে বুঝতে হবে ‘শুন মহাজন আমরা অনেক জন’। ‘স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনব’। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাকালে স্বপ্ন পূরণ এবং জীবনে সফল হতে হলে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দেশে অন্য এক বক্তব্যে তিনি বলেন, সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সাথে চলতে থাকবে।

‘৩১ দফা ও জনসম্পৃক্তি’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘নির্যাতনের জবাব হিংসায় নয়, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তাদের জবাব দেয়া হবে।’ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘দলের দুষ্টুদের টাইট দিয়ে রাখতে হবে। মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। আপনাদেরও বুঝতে হবে কী করলে জনগণ আপনাকে আরো পছন্দ করবে।’ আন্তঃমতামত বিনিময়ে সমাজিক কাজে নিয়োজিত থাকার আহ্বান জানিয়ে গাছের চারা লাগানো, পরিবেশ রক্ষা, রাস্তাঘাট পলিথিন মুক্ত, খাল ও নদী পুনর্খনন ইত্যাদি করতে হবে বলেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘অনেক সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনারা কত দিনে নির্বাচন চান। আমি উত্তরে বলেছি, অন্যায় দুর্নীতি সংস্কারের পর আমরা নির্বাচন চাই। আমরা ক্ষমতার জন্য অস্থির নই। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জোর করে ক্ষমতায় আসেনি। সংস্কারকাজে জামায়াত সহযোগিতা করবে। সংস্কারের জন্য আমরা ধৈর্য ধরব।’ শান্তির আহ্বান জানিয়ে ভারতকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আপনারা শান্তিতে থাকুন, আমাদেরকেও শান্তিতে থাকতে দিন।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম চরমোনাই বলেছেন, দেশের মানুষ জান-মালের নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। দেশে নতুন উদ্যমে চাঁদাবাজি, ছিনতাই শুরু হয়েছে। ৫ আগস্টের আগে সাধারণ মানুষ আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের নিপীড়নে পতিত হয়ে বৈষম্যের শিকার হতো আর এখন বিএনপির স্থানীয় কিছু নেতার লোভ-লালসা পূরণে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় নির্যাতিত হচ্ছে।

পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তার পর্যবেক্ষণে বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ করতে না পারায় তাদের জবাবদিহিতায় আসা উচিত। এ পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দু-একজন নেত্রী প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, সংস্কার যা করেছে রাজনৈতিক দলই করেছে। তারাই সংস্কার করতে পারে।

এক সভায় রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সংগঠক আলমগীর নয়ন বলেছেন, বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন দেয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দিচ্ছে। আমরা বলতে চাই, আগে সংস্কার করতে হবে, বিচার করতে হবে, তার আগে কোনো নির্বাচন দেয়া যাবে না। বাম নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স লিখেন, গত ৫৩ বছরে আমরা দেশে যে বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছি, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। এখন এক দেশে দুই ধরনের অর্থনীতি চালু আছে। একটি হচ্ছে বড়লোকের অর্থনীতি আর অন্যটি বঞ্চিত মানুষের অর্থনীতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক একটি দৈনিক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বলেন, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার লোভে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার রুখতে চায়। তিনি বলেন, প্রতিটি বিপ্লব মূলত হয় একটি আমূল সংস্কারের স্বপ্নকে সামনে রেখে; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ স্বার্থে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার লোভে মানুষের আকাক্সক্ষাগুলো রুখে দেয়ার চেষ্টা করে, যে সংস্কার হলে তাদের ক্ষমতা কমে মানুষের অধিকার বাড়বে, তা তারা চায় না। আমরা আমাদের আইডিয়া নিয়ে জনগণের কাছে যাচ্ছি, মতবিনিময় করছি, তৃণমূল শক্তিশালী করছি। সাংগঠনিক শক্তি অর্জন হলেই আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করব। এ দিকে মার্চ ফর ইউনিটি থেকে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের দাবি জানানো হয়। একই সভায় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই নতুন সংবিধান হবে। নির্বাচনে যারা জয়ী হবেন, তারা সংবিধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। নতুন সংবিধান গঠন করবেন এবং আইনসভার সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে সবার সাথে আলোচনার মাধ্যমে সংশোধন করা যেতে পারে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি বলেন, জাতি একবারই স্বাধীন হয়। একাত্তরের সাথে চব্বিশের তুলনা চলে না।

নির্বাচন কমিশন প্রধান এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, সরকার বা আদালত নিষিদ্ধ না করলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে যেতে বাধা নেই।

এসব বিবিধ মত-পথ দৃষ্টিকোণ চলছে এবং আরো চলবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের কাছে আবারো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন, ‘দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার!’

২০২৪ জুলাই ৩৬-এর পূর্ববর্তী সব মামলা-হামলার প্রায় সবার খালাস এবং পরবর্তী সময়ে শত শত মামলা-হামলা চলছে। যা আমজনতার কাছে পূর্বাপর সব বিচারালয়-সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা প্রকাশ পাচ্ছে। এতে ক্রোধ ও প্রতিহিংসা প্রাধান্য ও আইনের শাসন প্রশ্নবোধক হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন দূর না করা পর্যন্ত অন্য খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করা কঠিন। যখন একজন ব্যক্তি সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করেন, জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, তখন তিনি সেই রাষ্ট্রের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয়ই যদি উভয়ের দায়িত্ব পালন করতে সচেষ্ট হয়, তা হলেই উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২৪ সালে ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছে তার মূল বক্তব্য বা দাবি ছিল সর্বক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্যদূরীকরণের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের মানুষের মধ্যে বিরল ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমেও জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ঐকমত্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। এবারের ছাত্র আন্দোলনে ঠিক তেমনি ঐক্য গড়ে উঠেছে। একে ধারণ ও বহন করে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন এবং বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে সচেষ্ট হতে হবে। এই সঙ্কটকালীন সময়ে বিভিন্ন মত ও পথের মধ্য থেকেই সমাধান খুঁজে ছাত্র-আমজনতার চাওয়া-পাওয়াকে প্রকৃত স্থান দিতে পারলে আমরা একটি টেকসই নতুন বাংলাদেশ খুঁজে পাবো। আল্লাহ সহায় হোন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা র্ডপ, গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী
ই-মেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement