১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২৯ পৌষ ১৪৩১, ১২ রজব ১৪৪৬
`

হাওরাঞ্চলের উন্নয়নে সমন্বিত হাওর নীতিমালা

টাঙ্গুয়ার হাওর - ছবি : সংগৃহীত

আমাদের দেশের প্রাণ-প্রকৃতিতে হাওরের অবদান অপরিসীম। হাওরাঞ্চল দেশের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। হাওরের উৎপাদিত ধান দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে ৪১৪টি হাওর বিদ্যমান। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪২৩টির মতো হাওর রয়েছে। যার মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা উল্লেখযোগ্য। কিশোরগঞ্জ জেলা হাওর-অধ্যুষিত অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। এ জেলার ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন ও নিকলী উপজেলা পুরোপুরি হাওরাঞ্চলে অবস্থিত। এছাড়া করিমগঞ্জ, বাজিতপুর, ভৈরব ও কুলিয়ারচর উপজেলার অংশবিশেষ হাওর এলাকায় অবস্থিত।

হাওরাঞ্চলের পলিমাটি মিশ্রিত উর্বর ভূমিতে সাধারণত বোরো ধানের ভালো ফলন হয়ে থাকে। এখানকার হাওর-বিলের মিঠা পানিতে অন্তত ১৫০ প্রজাতির দেশী মাছ পাওয়া যায়। এই হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে প্রধানত ধান, গবাদিপশু, হাঁস ও মাছের ওপর। ফলে হাওরের ওপর দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও জাতীয় অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের খাদ্যচাহিদার অন্তত ২০ শতাংশ হাওরাঞ্চলের কৃষক ও জেলেরা পূরণ করে থাকেন। প্রাকৃতিক মাছের প্রধানত উৎস নদ-নদী ও হাওর। স্বল্প খরচে পণ্য পরিবহনেও নৌপথের ভূমিকা এখনো অনেক।
আমাদের দেশে বর্তমানে বহমান নদ-নদীর সংখ্যা এক হাজার আটটি। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক নদীর সংখ্যা ৫৭টি, এর মধ্যে ৫৪ নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতে। বাংলা সাহিত্যে এ নদ-নদী এবং নৌযান অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। গল্প, কবিতা, চলচ্চিত্র ও গানের মাধ্যমে আবহমান বাংলার নদ-নদীর, হাওর, বিলের বিচিত্রতা, বিশাল জলরাশির কারণে সৃষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতি একই সাথে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চিত্র ফুটে উঠেছে। ভাটিয়ালি সুরের গানে মানুষের আবেগ অনুভূতির জায়গা দখল করে রেখেছে। এক কথায়, বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

হাল আমলে প্রাকৃতিক সম্পদ হাওর ও নদ-নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বিঘ্ন ঘটছে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৪ নদীর অনেকগুলোতে ভারত বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টিতে ভারতে বন্যা দেখা দিলে কোনো প্রকার পূর্ব সতর্কতা ছাড়া পানি ছেড়ে দেয়। এতে বাংলাদেশের বিশেষ করে ভাটি অঞ্চল প্লাবিত হয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। তাছাড়া উন্নয়ন ও আধুনিকতার নামে নির্বিচারে হাওর ভরাট করা হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে হাওরে বাঁধ, রাস্তা ও সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এতে পানিপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাওর ও মৎস্যসম্পদ।

বৃহত্তর সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে যে বিশাল হাওর এলাকা গঠিত; সেখানে উন্নয়নের নামে হাওরকে ছিন্ন ভিন্ন করে মহাসড়ক, সেতু বানানো হয়েছে। পতিত স্বৈরাচারের আমলে হাওর উন্নয়নের নামে অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন উপজেলার সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ওই সড়কের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২৯ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন স্বৈরশাসক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন।

ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের আগে এর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক এবং হাওরের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, মৎস্যসম্পদের ঝুঁকির বিষয়ে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। এ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে যতটা না সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে; তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলা সদর থেকে করিমগঞ্জ উপজেলার মরিচখালী পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণে পাঁচ হাজার ৬৫১ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে এ প্রকল্প ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। প্রকল্পটির মাধ্যমে মিঠামইন উপজেলা সদর থেকে মিঠামইন সেনানিবাসকে সংযুক্ত করে করিমগঞ্জ উপজেলা পর্যন্ত হাওরের ওপর দিয়ে ১৫ দশমিক ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক নির্মাণ এবং নাকভাঙা মোড় থেকে মরিচখালী বাজার পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণের মাধ্যমে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলাসহ এর আশপাশের হাওর এলাকার সাথে কিশোরগঞ্জ জেলা সদর এবং ঢাকা, সিলেট ও অন্যান্য জেলায় সরাসরি ও নিরবচ্ছিন্ন সব আবহাওয়া উপযোগী (অল ওয়েদার) চলাচলে সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা। যদিও সড়কের কারণে স্বাভাবিক পানি প্রবাহের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। বর্ষাকালে বন্যার পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে যায়। হাওরের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাওরের নিজস্ব প্রজাতির মাছ, হিজল গাছ, কড়চ, বিভিন্ন প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদ ধ্বংস হচ্ছে। এ অবস্থা শুধু কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর না, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানের জলাশয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে সেতু, পার্ক, কফিশপ, বিভিন্ন স্থাপনা- এমনকি শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।

হাওরাঞ্চলের এসব অবকাঠামো ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। এখানে গড়ে উঠা বিভিন্ন অবকাঠামো ও বর্ষাকালে বিশাল জলরাশির আকর্ষণে কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে এবং টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রতিনিয়ত পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আগত পর্যটকরা ভ্রমণের সময় নদী, হাওরে ও খালের যত্রতত্র অপচনশীল প্লাস্টিক ব্যাগ, চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল ইত্যাদি ফেলে দেন। এতে স্বাভাবিকভাবে মাছের বিচরণ ও বংশবিস্তারের ক্ষেত্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পানির নিচে জন্ম হওয়া উদ্ভিদ। পর্যটক নীতিমালা না থাকায় এবং পর্যটকদের সাধারণ জ্ঞানের অভাবে কিংবা উদাসীনতায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

হাওরাঞ্চল আমাদের অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদ ব্যবহারে পরিবেশগতভাবে সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। তাই প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরিচালিত সমীক্ষার ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তাতে পরিবেশের কম ক্ষতি হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
শুল্ক হার বাড়ায় মিনিমাম প্রভাব পড়বে জুলাই বিপ্লবে নিহত মাহবুবের পরিবারের পাশে তারেক রহমান সীমান্ত সম্ভারে ৮ মিনিটে দিন-দুপুরে ১৫৯ ভরি স্বর্ণ চুরি সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব : নজরুল ইসলাম খান পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ কেরানীগঞ্জ কারাগারের অস্থায়ী আদালতে চলবে আমানতকারীদের স্বার্থে পর্ষদ সভায় ভূমিকা রাখছেন না স্বতন্ত্র পরিচালকরা এক নারীর শরীরে এইচএমপিভি শনাক্ত সুস্থ আছেন রুগ্ণ প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে নেয়ার এক্সিট পলিসি চান ব্যবসায়ীরা নিউজিল্যান্ড ও আফগানিস্তান দল ঘোষণা পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী আহত তেল মারা বন্ধ করেন : সরকারি কর্মচারীদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

সকল