ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন
- রেজাউল করিম খোকন
- ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:১৮
মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট হঠাৎ বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অনেকেই ক্ষুব্ধ। কোনো আলোচনা ছাড়াই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া অবিবেচনাপ্রসূত। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সঙ্কটে পড়বে ব্যবসায়-বাণিজ্য। দুই বছরের বেশি সময় ধরে যেখানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, সেখানে এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ২০২৩ সালে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পর্যবেক্ষণে জানা যায়, দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ আয়কর দেন না। জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে দুই লাখ ১৩ হাজার কোম্পানি নিবন্ধিত হলেও আয়কর দেয় মাত্র ৪৫ হাজার। বিভিন্ন খাতে কর ফাঁকির কারণে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার আয়কর থেকে বঞ্চিত। অন্তর্র্বর্তী সরকার করের আওতা না বাড়িয়ে কিংবা কর ফাঁকি রোধ করার ব্যবস্থা না করে সরল রাস্তার সমাধান হিসেবে ভ্যাট বাড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে নিশ্চিত করেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ আরো বাড়বে। এতে তৈরী পোশাক, এসি রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, নন-এসি হোটেলসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে। অর্থ উপদেষ্টা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেয়া হয়েছে। বাস্তবতা হলো, যেসব পণ্যের ওপর কর কমানো বা শূন্য করা হয়েছে, সে সব পণ্যের দামও তো তেমন কমেনি। সম্প্রতি ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সব ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। সরকারের রাজস্ব আদায়ের বড় মাধ্যম হচ্ছে ভ্যাট। বর্তমানে ভ্যাট নিবন্ধন নেয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সোয়া পাঁচ লাখ। এর মধ্যে গড়ে সাড়ে তিন লাখ প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দেয়। এর বাইরে এখনো লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যকর উদ্যোগ কম। এমনকি ভ্যাট আদায় বাড়াতে প্রয়োজন অনুযায়ী ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসও (ইএফডি) বসাতে পারেনি সংস্থাটি। এ দিকে রাজস্ব আদায়ে অর্থবছরের শুরু থেকে ঘাটতি চলছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশকে দেয়া ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। তখন চলমান ঋণ কর্মসূচির আকার আরো ৭৫ কোটি ডলার বাড়ানোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ। এই অর্থ দিতেও সম্মত হয় আইএমএফ। এ জন্য কর আদায় ও নীতি গ্রহণকারী সংস্থাকে আলাদা করাসহ রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মতো কিছু কঠোর শর্ত দিয়েছে। সেই শর্ত পূরণেই ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়ানো ছাড়া এ মুহূর্তে সরকারের কাছে বিকল্প নেই। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হতো। তবে সেটি কঠিন হওয়ায় ভ্যাট বাড়ানোর সহজ পথে হেঁটেছে সরকার।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় ব্যবসায়ীদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে ভ্যাটের হার বাড়ানোর সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে পারে এনবিআর। এমন বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলা উচিত ছিল।
আগে এক সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। সেটি কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার পর ভ্যাট আদায় বেড়েছিল। কারণ, ভ্যাট কম হলে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। রেস্তোরাঁ, পোশাক, হোটেল ছাড়াও অন্য যেসব খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো উৎপাদন পর্যায়ে বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যুপেপার ইত্যাদি। আকাশপথে ভ্রমণে খরচও বেড়ে যেতে পারে। কারণ, আবগারি শুল্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বানানোর সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার কর দিতে হতে পারে। বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারে কর দিতে হয়। নতুন প্রস্তাব অনুসারে, বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা পেরোলে পণ্য ও সেবা বেচাকেনায় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসতে পারে।
আর্থসামাজিক প্রভাবগুলো গভীরভাবে মূল্যায়ন করে সংশ্লিষ্ট খাতের অংশীজনদের সাথে যথাযথ পরামর্শের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণে উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। অর্থ বছরের মাঝামাঝি সময় হঠাৎ করে এভাবে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কিছুটা বিস্ময়কর। সরকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয় ও বিতর্ক নিয়ে যতটা জড়িয়ে গেছে এবং অগ্রাধিকার দিচ্ছে, অর্থনৈতিক সংস্কারে ততটা দিচ্ছে না। সে কারণে অর্থনীতিতে সমন্বিত উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একদিকে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ অন্যদিকে এনবিআরও ভ্যাট বাড়াচ্ছে। অথচ সমন্বয় থাকলে কিছু ক্ষেত্রে উল্টো কর হ্রাসের কথা ছিল। এই বাস্তবতায় বলতে হয়, বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির মতো জটিল সমস্যা সমাধানে শক্তিশালী অর্থনৈতিক নেতৃত্ব চোখে পড়ছে না। এই বাস্তবতায় আশঙ্কা জাগছে, অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়গুলো ধামাচাপা পড়ে যায় কি না।
কর সংস্কারের কথা ধারাবাহিকভাবে বলে হচ্ছে কিন্তু কিভাবে তা করা হবে, সেটিই মূল কথা। যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে কঠিন পথে হাঁটতে হবে। শুধু পরোক্ষ কর বাড়ানোর মতো সহজ পথে হাঁটলে গভীর সমস্যার সমাধান হবে না। তাই প্রয়োজন করের আওতা বাড়ানো, কর খাতে দুর্নীতি রোধ করা এবং কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। গভীর সংস্কারের লক্ষ্যে যে পরিবেশ থাকা দরকার, অর্থাৎ আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক শক্তিসহ সব অংশীজনের যেভাবে অংশগ্রহণ দরকার, সেই বাস্তবতার ক্ষেত্রে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পাঁচ মাস কেটে গেছে। এখনো সব কিছুতে এক ধরনের অস্থিরতা ও অনিরাপদ বোধ জেঁকে বসে আছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে আমরা নতুন বছর শুরু করেছি। আমাদের প্রত্যাশা, শিগগিরই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্থিতিশীলতা আসবে। টিসিবির ট্রাকের পেছনের নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষের লাইন দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝতে এই চিত্রই যথেষ্ট। আশা করছি, দেশের নীতি-নির্ধারকরা অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে অর্থনীতি ফিরে আসুক, এটিই প্রত্যাশা। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকার প্রশাসনকে উল্টো পিরামিড বানিয়ে যেভাবে ব্যয় বাড়িয়ে চলেছে, তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এখন তারা আগের সরকারের সেই নীতিই অনুসরণ করে চলেছেন। প্রশাসনের ব্যয় কমিয়ে ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে সরকার ঘাটতি মেটাতে পারে। ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা হোক।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা