পতিত একনায়কত্ব ফিরে আসার নজির কি আছে পৃথিবীতে
- খন্দকার হাসনাত করিম
- ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:০৪
বিন্দু ঘিরে যেমন বৃত্ত হয়, তেমনি কোনো দেশের শাসনবৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু হলো রাজনৈতিক দল। সেই মতে, গণতন্ত্র হলো রাজনৈতিক দলের কাছে নিবিড়ভাবে পরিবেষ্টিত একটি নিরাপদ আশ্রয় ও সুরক্ষা ব্যূহ। শাসন কাঠামো কার্যকরভাবে পরিচালনায় রাজনৈতিক দল অনিবার্য এবং অপরিহার্য। রাজনৈতিক দল ছাড়া প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র সুরক্ষার বিকল্প কোনো উপায় এখনো উদ্ভাবিত হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে বিকশিত হয় একটি জাতিরাষ্ট্রের ঐক্য ও শাসন পরিচালনার সম্মিলিত আকাক্সক্ষা। একইসাথে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক বৈধতা, নিশ্চিত হয় জাতীয় সংহতি ও স্থিতিশীলতা।
গণতন্ত্র হলো বহু মত ও পথে শোভিত বৃক্ষের একটি উদ্যান; আর স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের পরিণতি হলো একটি অনুর্বর, নিষ্ফলা ঊষর মরুভূমি। কারণ স্বৈরতন্ত্রে মতভিন্নতা সহ্য করা হয় না। একটি মাত্র শাসক দল হয়ে পড়ে ব্যক্তি স্বৈরাচারের আজ্ঞাবহ লুটেরা গোষ্ঠী; দেশ পরিচালিত হয় প্রাইভেট কোম্পানির মতো একচ্ছত্র নিয়মে, যেখানে প্রশ্ন করার কারো অধিকার থাকে না; প্রতিবাদ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস দেখালে হন গুম, খুন, নিখোঁজ, মিথ্যা মামলা, হয়রানির শিকার, যেটি হয়েছে বিগত ১৬ বছরে এই দেশে আওয়ামী প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে। এই স্বেচ্ছাচারী প্রাইভেট কোম্পানি দেশের মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে গত ১৬ বছরে ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। সেই লুটের দায়ভার বহন করতে হচ্ছে গর্ভের শিশুটিকে পর্যন্ত, যে এখনো পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়নি।
দেশ শাসনে, সংবিধান ও বিবিধ আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক দলের যে মুখ্য ভূমিকার কথা দিয়ে লেখাটা শুরু করেছি, সেই রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দল দেশ থেকে গণতন্ত্রকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিল। গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন করা দেশটিতে একদলীয় ‘বাকশাল’ চালু করা হয়েছিল। চালু করা হয়েছিল প্রথম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড (সিরাজ শিকদার হত্যার ঘটনা); দেশের ত্যাগী ও মেধাবী, দেশপ্রেমিক ২৮ হাজার জাসদ ও বামপন্থী নেতাকর্মীকে ঠাণ্ডা মাথায় রক্ষীবাহিনী দিয়ে খুন করা হয়েছিল। একটি রাজনৈতিক দলের পরিপূর্ণ একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনায় সংবিধানের কুখ্যাত চতুর্থ সংশোধনী এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ‘বাকশাল’ নামক ইতিহাসের নিকৃষ্টতম স্বৈরতন্ত্র। এই ৫ আগস্টের মতো তাই সেদিন ১৫ আগস্টের দেশপ্রেমিক বীর সিপাহি ও অফিসারদের একটি অংশ সিপাহি-জনতা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণশত্রু আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসী আধিপত্যবাদের অপশাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন। পতন হয়েছিল বাস্তিল দুর্গের। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতা ভারসাম্যে ধস নেমেছিল। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও গণচীনের স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তা পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। কাজেই ১৫ আগস্টের ঘটনাবলি যতই বিয়োগান্তক হোক না কেন, এ পরিবর্তনের রাজনৈতিক, পররাষ্ট্রনৈতিক ও গোটা সামাজিক তাৎপর্য ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
এ পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যখন ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫ প্রতিবিপ্লব ঘটায় আওয়ামীপন্থী কিছু উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তা, আর একদিকে যখন হঠকারী জাসদ তথাকথিত ‘সিপাহি-জনতা ভাই ভাই/অফিসারদের কল্লা চাই’ ধ্বনি তুলে গোটা প্রতিরক্ষা বাহিনী ধ্বংসের ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গৃহযুদ্ধের সর্বনাশা পথে নামে, ঠিক তখনই ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও দেশীয় একনায়কত্বের কবর রচিত হয়। বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে সিপাহি-জনতা মুক্তিযুদ্ধের বীর সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে অর্পণ করেন দেশ নেতৃত্বের শিরোপা। তিনি একদলীয় ‘বাকশাল’ বাতিল করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নবজন্ম প্রদান করেন। আদালত ফিরে পান বিচারের স্বাধীনতা। গণমাধ্যম ফিরে পায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। অথচ আজ আমরা ভুলে যেতে বসেছি শেখতন্ত্র অবসানের সেই ১৫ আগস্টের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। এমনই অতীত-ভোলা জাতি আমরা। যে চেতনায় সফল হয়েছে ২০২৪-এর দেশ কাঁপানো মহাবিদ্রোহ, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতা জাগরণের চেতনার সেটি হলো অনিবার্য ধারাবাহিকতা।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ২০২৪। এর মধ্যে সমাজ ও রাজনীতিতে দু’টি প্রজন্মের উত্থান ঘটেছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনা ও ৭ নভেম্বরের সুবিধা পেয়েছে জাতি। একদলীয় স্বৈরতন্ত্র বিদায় করে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে এসেছে। ভারতীয় করদ রাজ্যের অভিশাপ থেকে দেশ মুক্তি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার লোকসান ঘটিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশে রফতানিমুখী পোশাক শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে ১৯৭৫-এর রাষ্ট্র বিপ্লবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে পাকিস্তান, চীন ও সৌদি আরব।
সেই মুক্তির তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন কমবেশি ১৯৭৫ পরবর্তী প্রত্যেক শাসক ও শাসকমহল। পতিত মুজিব স্বৈরাচারের মন্ত্রিসভাকে নিয়ে ৮০ দিনের শাসন ধারা অব্যাহত রেখেছেন খন্দকার মোশতাক। প্রেসিডেন্ট জিয়া আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। তারপর ভারতীয় আধিপত্যবাদের আশীর্বাদে ক্ষমতার মসনদে আসীন হন জিয়ার নিযুক্ত সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ঠিক যেমন ইস্কান্দার মীর্জাকে খেদিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান। এরশাদ দুঃশাসনের বাকশালী ধারা অব্যাহত রাখেন। শেখ মুজিবেরটা ছিল সিভিল ডিক্টেটরশিপ; এরশাদেরটা ছিল মিলিটারি ডিক্টেটরশিপ তফাৎ কেবল এটুকু। বারবার নির্বাচিত বিএনপির বিরুদ্ধে শত্রুতার রণাঙ্গন খুলেছিলেন এরশাদ। কারণ তার পেছনে ছিল ভারত। এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে বিএনপি। অথচ সেই নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে হটিয়ে ভারতীয় আশীর্বাদ ও বাকশালীদের সর্বতো সহযোগিতায় অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ভারতীয় বশংবদ এক-এগারোর কুশীলব মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন গং বিএনপিকে ধ্বংসের অপকর্মে দেহমনপ্রাণ উজাড় করে দিয়েছিল। ভোটে ক্ষমতায় এনেছিল আওয়ামী-বাকশালী আত্মবিক্রীত স্বৈরাচারীদের। এরপর গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় ইতিহাসের নৃশংসতম স্বৈরিণী, প্রতিহিংসার প্রতীক এবং বাংলাদেশকে সিকিম বানানোর তালিমপ্রাপ্ত, ভারতে আশ্রিত ও প্রশিক্ষিত শেখ মুজিব তনয়া হাসিনা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ভারতে আশ্রিত হাসিনাকে দিল্লি প্রশিক্ষণ দিয়েছিল বাংলাদেশে ফিরে এদেশকে ভারতের বশংবদ বা আরেকটি সিকিম বানানোর মিশনে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুঁজি করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মানবেতিহাসের নৃশংসতম স্বৈরাচারী একনায়কত্ব, দুর্নীতি ও লুটপাটতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র এবং দেশের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করার মৃগয়াক্ষেত্রে। এ অপরাধগুলোর সবক’টি কিংবা বেশির ভাগ অভিন্ন দেখা যায় পতিত ও সমূলে উৎখাত হওয়া স্বৈরাচারী একনায়কদের মধ্যে। তাই গণতন্ত্রে যেমন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ অপরিহার্য, তদ্রুপ স্বৈরশাসক ও গণ-শত্রুদের একটি জাতির নিয়তির সাথে অভিসারে তাদের নিষিদ্ধ করাই অনিবার্য।
পৃথিবীর বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে ব্যতিক্রম বাদে এখানে দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি, যে তালিকায় দেখা যাবে পতিত স্বৈরাচারী দল নামে, এমনকি বেনামেও, দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আর কোনো দিনও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। ফলে ইতিহাসের জঘন্যতম খুনি, লুটেরা, দুর্বিনীত স্বৈরাচারী একনায়ক শেখ হাসিনা বা তার দলবলের রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ কই? যারা দুঃশাসক আওয়ামী-বাকশালীদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবর্তনে ওকালতি করছেন তারা কি জুলাই-আগস্ট গণজাগরণে হাসিনা সরকারের ও তার পেটোয়া বাহিনীর গুলিতে নিহত প্রায় দুই হাজার তরুণ ছাত্র-জনতার লাশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং পঙ্গু প্রায় ৩০ হাজার ছাত্র-জনতা, শিশু-কিশোরের আত্মত্যাগের প্রতি নির্লজ্জ উপহাস করছেন না? কী অধিকারে কোন্ অজুহাতে তারা নতুন বাংলাদেশের নবীন গণতন্ত্রের সঙ্গী হওয়ার প্রত্যাশা করে?
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা