০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১, ৭ রজব ১৪৪৬
`

সেনা নিরাপত্তায় মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা

-

দেশে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য ছাত্রছাত্রী বাছাইয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমাদের দেশে যেকোনো পরীক্ষার হোক- তা নিয়োগ কিংবা ভর্তি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এই প্রবণতা আমাদের জন্য বিপজ্জনক। বিশেষ করে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে নিম্ন মেধার শিক্ষার্থীরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুবাদে যদি ভর্তি হন, তা হলে এদেশের জনস্বাস্থ্য এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তার চেয়ে আরো বেশি নাজুক হয়ে পড়বে, এ কথা হলফ করে বলা যায়। প্রশ্নপত্র ফাঁদের ব্যাধি নিরাময়ের উপায় নিয়ে এই কলামে বলতে চাই।

২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ‘প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগবাণিজ্য কোটার থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর’ শিরোনামে নয়া দিগন্তে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে যেখানে বিস্তারিতভাবে এ বিষয়ে এনএসআইয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণনা করেছি। একই সাথে তা প্রতিরোধের বেশ কিছু নিয়মাবলি সম্পর্কেও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

দেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবলায়। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি ২৫ ডিসেম্বর রাতে দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয়ে থাকা সচিবলায়ের মতো জায়গায় একই সময়ে একই বিল্ডিংয়ের আলাদা দু’টি জায়গায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। উক্ত আগুনে পুড়ে গেছে পাঁচটি মন্ত্রণালয়। রাত প্রায় ১টা ৫০ মিনিটে লাগা এই আগুন ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের টানা ছয় ঘণ্টার প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আসে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র, কম্পিউটার ও আসবাব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমরা আরো দেখেছি, আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে ট্রাকচাপায় মো: সোহানুর জামান নামে ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্য নিহত হয়েছেন। আবার ২৫ ডিসেম্বরের আগের রাতে বান্দরবানে লামা উপজেলায় সরই ইউনিয়নের তংগোঝিরি ত্রিপুরাপাড়ায় খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরাদের ১৭টি ঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

সার্বিক দিক বিবেচনায় বোঝা যায় এই মুহূর্তে দেশের অভ্যন্তরে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ইতোমধ্যে ৫ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরেও আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশের আমলা থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরের একটি অংশ অসহযোগিতা করে চলছে। দেশের পুলিশ-প্রশাসন এখন পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

এমন পরিস্থিতিতে আমাদের আগামীর স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত হবেন যারা, সেই ভবিষ্যৎ চিকিৎসক তৈরির উদ্দেশ্যে মেডিক্যাল শিক্ষার্থী বাচাইয়ের আয়োজন চলছে প্রতিবারের মতো এবারো। আমরা জানি, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে দেশের মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল গত ১০ ডিসেম্বর এবং ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ তা শেষ হয়েছে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের তথ্যমতে, এবার এক লাখ ৩২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এমবিবিএস ভর্তির আবেদন করেছেন। এবার কোটাসহ মেডিক্যাল কলেজে আসন পাঁচ হাজার ৩৮০টি। দেশে মেডিক্যাল কলেজ ১১০টি। এর মধ্যে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ৩৭টি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ৬৭টি। এ ছাড়া একটি আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ ও পাঁচটি বেসরকারি আর্মি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে হয় মেধাতালিকার ভিত্তিতে। এখানে ভর্তি হতে একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে কতটা লড়াই, কতটা পরিশ্রম করতে হয় তা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে মেডিক্যালের মতো একটা সেনসেটিভ ভর্তি পরীক্ষাতেও প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২০১৫ সালের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি সামনে আসে এবং সেই সূত্র ধরে দেশজুড়ে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে সমবেত হলেও পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি। এমনকি তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করাও হয়নি।

২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট ডেইলি স্টারে ‘১৬ বছরে অন্তত ১০ বার মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস : সিআইডি’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। সিআইডি জানায়, গত ৩০ জুলাই ২০২৩ থেকে ৯ আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল জেলায় অভিযান পরিচালনা করে এ চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় সাইবার টিম। গ্রেফতারকৃতদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। গ্রেফতারকৃত ১২ জনের মধ্যে ৭ জন ডাক্তার। তাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন মেডিক্যাল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্নফাঁস করতেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আটজন তাদের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। যাতে শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম উঠে আসে, যারা প্রশ্ন পেয়ে মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছেন। ইতোমেধ্যে অনেকে পাস করে ডাক্তারও হয়ে গেছেন। আমরা কতটা দুর্বল রুচির জাতিতে পরিণত হয়েছি যে, চিকিৎসার মতো একটা জনগুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেও এমন অপকর্ম করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করছি না।

আগামী ১৭ জানুয়ারি সারা দেশে একযোগে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা। দেশব্যাপী বিভাগীয় পর্যায়ে প্রায় ৫০+ সেন্টারে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা: রুবিনা ইয়াসমীন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেছেন, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা ঘিরে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। শিগগিরই মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। কোচিং সেন্টার বন্ধের সিদ্ধান্ত আসে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা থেকে। তবে এখনো আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়নি।

ভর্তি কমিটির সভায় ১ জানুয়ারি থেকে কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক একজন কর্মকর্তা হিসেবে গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে এ মুহূর্তে দেশের সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমার মনে হয় সামনের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষাকে সর্বোচ্চ নজরদারি ও গুরুত্ব দেয়া অত্যন্ত জরুরি। এ অবস্থায় কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত পরীক্ষা সিস্টেমে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা। সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের কাউকে দায়িত্ব দিয়ে একটা টিম বানিয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন করা এবং ছাপানো। এটি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও কাজ হবে বলে মনে করছি।

দেশের পুলিশ-প্রশাসন এখন পর্যন্ত নাজুক অবস্থানে অবস্থান করছে। তারা তাদের দায়িত্ব কতটা পালন করতে পারবে দেশের সার্বিক অবস্থা দেখে ভয় হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই প্রশ্ন তৈরি, ছাপানোর পাশাপাশি প্রশ্ন বণ্টন থেকে শুরু করে পরীক্ষা নেয়া, কঠোর নজরদারিসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা জরুরি মনে করছি। না হলে বর্তমান ভঙ্গুর সিস্টেমে প্রশ্নফাঁস ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছি। যদি ২০১৫ সালের মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁসের মতো কোনো ঘটনা তথা ম্যাসাকার ঘটে তাহলে পুনরায় এ সরকার নতুন করে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। নতুন করে এ ইস্যু ঘিরে আন্দোলন হতে পারে।

আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি এবং দেখছি দেশীয় মিডিয়া থেকে শুরু করে দেশের বাইরের আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিশেষ কিছু মিডিয়া যেকোনো ইস্যুকে কিভাবে আন্তর্জাতিক মহলে ডিসইনফরমেশন আকারে তুলে ধরছে। যেখানে সচিবলায়ের মতো জায়গায় এরকম ঘটনা ঘটতে পারে; সেখানে এ মুহূর্তে ১৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য হতে যাওয়া দেশব্যাপী এ পরীক্ষাকে হালকাভাবে গ্রহণ করা একটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করছি।

এ মুহূর্তে নতুন করে দেশে বা দেশের বাইরের কাউকে এরকম সুযোগ তৈরি করে তার সুযোগ নিতে আমরা দিতে পারি না। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ভালো। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় আসন্ন মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা সিস্টেমে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি বলে মনে করছি।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি


আরো সংবাদ



premium cement