০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১, ৪ রজব ১৪৪৬
`

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়

-

হর্ন, পুরাতন গাড়ির ইঞ্জিনের বিকট শব্দ, বিল্ডিং নির্মাণ, কলকারখানার শব্দদূষণে অতিষ্ঠ নগরবাসী। হুমকিতে সামান্যতম বেঁচে থাকা পাখি-প্রাণিকুল। কোটি কোটি মানুষ আজ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে এই অপ্রয়োজনীয় শব্দদূষণের কারণে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শব্দদূষণের কারণে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ শ্রবণশক্তির সমস্যায় ভোগেন। প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ হতাশা ও উদ্বেগের সমস্যায় ভুগছেন। শুরুটা খিটখিটে মেজাজ দিয়ে। তারপরে মানসিক সমস্যা, চরম অসহিষ্ণু ও অমনোযোগী, মাথা ধরা, স্মরণশক্তি হ্রাস, আত্মহত্যার প্রবণতা, স্ট্রোকের ঝুঁকি পর্যন্ত বাড়ে। বৃদ্ধ, শিশু ও সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়। উচ্চরক্তচাপ, হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়া, হৃদরোগ এমনকি ফুসফুসের প্রদাহ। মাংসপেশির সংকোচন, পরিপাকে বিঘ্ন, গ্যাস্ট্রিক আলসার। মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর জন্মগত ত্রুটি, শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং তাদের পড়ালেখায় উদাসীন করে তোলা। কানের পর্দা নষ্ট হওয়া, বধিরতাসহ অসংখ্য রোগের কারণ এই শব্দদূষণ।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদ জীবনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করেছে। এ অনুচ্ছেদে জীবনের অধিকার শুধু টিকে থাকাকে বোঝায় না, বরং মানসম্মত জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। এ থেকে বলা যায়, যদি কোনো ব্যক্তি শব্দদূষণের প্রভাবে তৎক্ষণাৎ বা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিগ্রস্ত হন বা তার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়, তাহলে সংবিধানের আলোকে উচ্চ শব্দের বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।

পরিবেশ রক্ষা আইন-১৯৯৫ এর ২০ ধারায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা মোতাবেক এলাকাভেদে শব্দের মাত্রা নির্দিষ্ট করে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ মালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালায় দিন ও রাতকে বিবেচনা করে আবাসিক এলাকা, নীরব এলাকা, মিশ্র এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা এবং শিল্প এলাকায় শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। একই বিধান দ্য এনভায়রনমেন্টাল কনজারভেশন-১৯৯৭ এর ৪ শিডিউলে বলা হয়েছে। শিডিউল ৫ অনুযায়ী যানবাহনের শব্দের মাত্রাও সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৪৬ ধারার ৩-এ বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষণকারী এমন কোনো যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ মোটরযানে ব্যবহার করা যাবে না, যেমন হর্ন বা উচ্চ শব্দের ইঞ্জিন। ধারা ৪৬ এর ৪-এ আরো বলা হয়েছে, কোনো ত্রুটিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, নিষিদ্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপকৃত কোনো মোটরযান সড়ক বা মহাসড়কে চালানোর অনুমতি দেয়া যাবে না।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী, সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিষিদ্ধ। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা হতে ৫০০ মিটারের মধ্যে ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। বিধি অনুযায়ী আরও বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবিলের মধ্যে রাখতে হবে। নীরব এলাকায় (হাসপাতাল ও স্কুলসংলগ্ন এলাকা) দিনে ৫০ এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। মিশ্র এলাকায় (আবাসিক এবং বাণিজ্যিক এলাকা) দিনে ৬০ ডেসিবেল এবং রাতে ৫০ ডেসিবেল পর্যন্ত হতে পারে। তবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাফতরিক কাজ, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসের অনুষ্ঠান, বিমান, রেলগাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার ব্রিগেডের যান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপদসঙ্কেতের প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিধিমালা প্রযোজ্য নয়। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ এর ৯ ধারা অনুসারে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে নীরব এলাকার বাইরে কোনো খোলা বা আংশিক খোলা জায়গায় সামাজিক অনুষ্ঠান, ক্রিয়া, কনসার্ট, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সভা বা অনুষ্ঠানে শব্দের মান মাত্রা অতিক্রমকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে।

২০০৬ এর বিধিমালার ধারা ১৭ অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা অতিক্রম করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যেকোনো সময়ে যেকোনো ভবন বা স্থানে প্রবেশ করে অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আটক করতে পারবেন এবং দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে প্রথম অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন এবং পুনরায় একই অপরাধ করলে অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন (ধারা ১৮)।

এ ছাড়াও দণ্ডবিধি-১৮৬০ সালের ২৬৮ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি কাজের মাধ্যমে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, আগুন, তাপ, শব্দ দ্বারা অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করেন, তবে তা গণ-উৎপাত বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ এর ১৩২(ক) থেকে ১৪৩ ধারা অনুসারে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এই গণ-উৎপাত অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ বা নিষেধাজ্ঞাও জারি করতে পারবেন।

আইন থাকলেও না মানার প্রবণতা ও প্রয়োগ থাকে না যেখানে এমন দেশেরই আমরা বাসিন্দা। হর্ন বাজানো নিষেধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, সচিবালয়, বিমানবন্দরসহ বিশেষ এলাকায়। ২০০৭ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হর্ন বন্ধে কিছু দিন তোড়জোড় দেখা গেছে তারপরে আস্তে আস্তে নিমেষে হারিয়ে গেছে। ২০২৪ এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সর্বত্র সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। গত ১ অক্টোবর থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসংলগ্ন এলাকা ও এর উত্তর-দক্ষিণে দেড় কিলোমিটার এলাকাকে সম্প্রতি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ এর বিধি-৪ অনুযায়ী ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করা হয়। বিমানবন্দর এলাকা ছাড়া রাজধানীর বাকিগুলো হলো সচিবালয়, আগারগাঁও, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এলাকা।

দূষণ কমাতে ঢাকার আরও ১০টি সড়ককে নীরব এলাকা করার উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ হতে হবে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে। লাউড স্পিকারে কোনো আওয়াজ শোনা যাবে না বা বাজবে না কোনো গান। হর্ন বন্ধে চাই ড্রাইভারদের ট্রেইনিং ও সচেতনতা। হর্নের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে জানবে ড্রাইভার ও মালিকপক্ষ। হর্ন ব্যবহার না করার ক্ষেত্রে ড্রাইভারদের প্রতি মালিকদের কঠোর নির্দেশ থাকবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার সময় বিশেষভাবে বলতে হবে। শব্দদূষণ বন্ধে প্রয়োজন পরিকল্পিত নগরায়ন, যানবাহন সংখ্যা সীমিতকরণ, বিদ্যমান আইনের সংস্কার, কঠোর প্রয়োগ এবং উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থা।

গাড়ির হর্ন বন্ধে আধুনিক কিছু পদক্ষেপ অবলম্বন করা যায়

* হর্নের তীব্রতা পরিমাপ করে জরিমানা এবং তীব্রতা কমিয়ে দেয়া যায়। * অটোমেটিক হর্ন কন্ট্রোল সিস্টেম বা আধুনিক এআই ব্যবহার করে গাড়ির অবস্থান ও দূরত্ব নির্ণয় করে ওই নির্দিষ্ট গাড়ির হর্ন নিষ্ক্রিয় বা সীমিত করা যায়।

* ইন্ডিয়ার কিছু রাজ্যে ট্রাফিক সিগন্যালে হর্ন বাজালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সবুজ লাইট আসতে আরো পাঁচ মিনিট দেরি করে। বেশি দেরি হওয়ার ভয়ে কোনো ট্রাফিক সিগন্যালে ড্রাইভাররা এখন হর্ন বাজান না।

* ডিভাইসের মাধ্যমে হর্নের সংখ্যা গণনা করা যায় এবং সীমিত করে দেয়া যায়। অতিরিক্ত হর্ন বাজানোর জন্য ট্যাক্স জমা দেয়ার আগে এক্সট্রা বিল এর মেসেজ চলে যাবে।

* হর্ন সব সময় বন্ধই থাকবে। কিন্তু কোনো গাড়ি খুব কাছাকাছি চলে এলে প্রক্সিমিটি সেন্সরের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হর্ন বাজবে। সচেতনতার পাশাপাশি এরকম অসংখ্য আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে অবাধ্যদেরও হর্ন না বাজাতে বাধ্য করা যায়।

লেখক : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
[email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement