০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১, ২ রজব ১৪৪৬
`

ঈশানকোণে দুর্যোগের আলামত!

-

দেশ এই মুহূর্তে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর চার মাস পেরিয়েছে। এই সময়ে পতিত স্বৈরাচার, তার বিদেশী প্রভু ও দেশীয় অনুচরেরা সরকারকে এক দিনের জন্যও শান্তিতে কাজ করতে দেয়নি। তারা নিত্যনতুন বেশে, নতুন রূপে ন্যায্য-অন্যায্য নানা দাবি আদায়ের নামে ঢাকা শহর তো বটেই, এমনকি সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাওয়ের মতো কাজও করছে। এসবের মূল উদ্দেশ্য সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রেখে জনআকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করা। তারা যে আংশিক সফল, তা বলাই বাহুল্য। তার পরও সরকার সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে ধীরে ধীরে তাদের আরাধ্য কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পতিত স্বৈরাচারের প্রভু ও অনুচরেরা নিবৃত্ত হয়নি এবং সহসা হবে এমন সম্ভাবনাও কম। বরং মনে হচ্ছে তারা আরো ভয়ঙ্কর পথে সরকারকে বিব্রত করা এবং দেশের জনগণকে শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।

১৯৯১ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। সে কারণে নির্বাচনের আগে নিজেদের মধ্যে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত বণ্টন করে ফেলেছিল বলে জনশ্রুতি আছে। কিন্তু জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করে বিএনপিকে বিজয়ী করলে, আওয়ামী লীগের জন্য সেটি মেনে নেয়া দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। বিএনপি সরকার গঠন করার পর শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, তিনি বিএনপি সরকারকে এক দিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। শেখ হাসিনা কথা রেখেছিলেন। তিনি ১৯৯১-৯৬ পর্যন্ত সময়কালে বিএনপি সরকারকে শান্তিতে কোনো কাজ করতে দেননি। তারা প্রথম থেকেই সংসদ বর্জনের নোংরা সংস্কৃতি চালু করে, যা ২০০৬ সাল পর্যন্ত বহাল থাকে।

১৯৯১-৯৬ সংসদের আমলে আওয়ামী লীগ ‘মাগুরা’ নির্বাচনের অজুহাতে দেশে সরকারি সম্পদ ধ্বংস ও আগুন দেয়ার সংস্কৃতি চালু করে। ওই সময়কালে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন সহিংস হরতাল পালন করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৯১ সালের পরে বিএনপি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার ও দেশমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে দেশ এশিয়ার ‘ইমার্জিং টাইগার’ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তপনার কারণে এই বাঘ প্রায় বিড়ালে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। পরে বেগম খালেদা জিয়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোজনের ফলে দেশ অরাজকতা থেকে মুক্ত হয়।

একটি সরকারের মূল্যায়নের জন্য সাড়ে চার মাস অত্যন্ত অল্প সময়। তার পরও লক্ষ্যযোগ্য যে, স্বৈরাচারী সরকারের রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়েও অন্তর্বর্তী সরকার যেসব পরিকল্পনা নিচ্ছে তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা বিপুল। গত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী সরকার দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা একটি একটি করে পুনর্গঠন করছে। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংসই নয়, দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রটিও তারা ‘সিন্ডিকেশনের’ মাধ্যমে জনগণের অর্থ লুটের রাস্তা বানিয়ে রেখেছিল। এ দেশের পুরো আমলাতন্ত্র আওয়ামী লীগের অনুসারী ও সুবিধাভোগীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে, নতুন সরকার যতই চেষ্টা করুক, তাদের গৃহীত কর্মসূচির সফলতার মাত্রা গণ-আকাক্সক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে পারছে না। তবে, উন্নতির লক্ষণ স্পষ্ট।
কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার প্রভুরাষ্ট্র চায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যর্থ হোক, ব্যর্থ হোক প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নে। কারণ তারা জানে, এই সরকার সফল হলে তাদের ফিরে আসার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে। সে কারণেই তারা অরাজকতা সৃষ্টির পথ বেছে নিয়েছে। ভারতের মিডিয়া দিয়ে যে মিথ্যাচার ও গুজব ছড়ানোর কার্যক্রম তারা শুরু করেছিল, আন্তর্জাতিক নিন্দায় তাও ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

গত দুই সপ্তাহে ঢাকার বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যূনপক্ষে তিনজন শিক্ষার্থী হত্যার শিকার হয়েছে। দুর্বৃত্তদের হাতে ছুরিকাহত হয়েছে আরো চার-পাঁচজন ছাত্র। এই আহত-নিহত ছাত্রদের একটি বিষয় ‘কমন’ আর সেটি হলো, এরা সবাই গত জুলাই ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম সারির যোদ্ধা বা কর্মী। হঠাৎ করে ছাত্রদের ওপর এই আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড কেন? এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে গত ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের সাফল্যগাথার মধ্যে। গত সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের ক’টি বড় সাফল্য ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্বীর্য করে রাখা। সরকার তার সব গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এবং ছাত্রলীগ নামক দানব সংগঠনের গুণ্ডাদের দিয়ে এমন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরোধীদলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাদের হিংস্রতার অন্যতম শিকার বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকর সিদ্দিকসহ আরো অনেকে। এই ছেলেদের মধ্যে যারা জীবিত অবস্থায় টর্চার সেল থেকে ফিরতে পেরেছে, তাদের অনেকেই চিরদিনের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছে। ফলে সে বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য হয়তো কোনো দিনই জানা যাবে না।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকার ‘মুরগির ফার্মের’ মতো বিবেচনা করত। শুধু সরকারই নয়, সাধারণ মানুষের ধারণাও ছিল অনেকটা ওই রকমই। ফলে রাজনীতিমুক্ত পরিবেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো প্রলোভন বা হিংস্রতার শিকার হয়নি। তারা তাদের বিচারবুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে বুঝতে শিখেছে কোন বিষয়টি দেশের জন্য মঙ্গলজনক আর কোনটি নয়। সে কারণে জুলাই ’২৪-এ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সব সমন্বয়ককে অবরুদ্ধ ও পরে গ্রেফতার করে ডিবি হেফাজতের নামে অন্তরীণ করে রাখা হয়, তখন ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজপথে নেমে আসে। নেমে আসে ঢাকার মাদরাসার ছাত্রসহ আপামর জনগণ। মালিবাগ থেকে কুড়িল এবং যাত্রাবাড়ী এলাকা জুলাইয়ের শুরু থেকেই সরকারের কর্তৃত্বের বাইরে চলে যায়, যা ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখানেই শহীদ হন মুগ্ধসহ অসংখ্য নাম জানা-অজানা ছাত্র-যুবক। সে দুঃসময়ে পুলিশ, বিজিবিসহ সব বাহিনীকে দিয়েও এই এলাকা থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের সরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি বিদেশী মার্সেনারি ও স্নাইপার দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েও। সে কারণেই ঢাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর স্বৈরাচারের এত রাগ।

কেন এই গুপ্তহত্যা? অনুমান করা কঠিন নয় যে, এটি দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্তের অংশ, যার মাধ্যমে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বার্তা দেয়া যে, ‘ফ্যাসিবাদ’ তার বিরুদ্ধাচরণকারীদের ক্ষমা করে না। এ ছাড়া এই হত্যা ও সহিংসতার মাধ্যমে তারা দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চায়, যাতে বর্তমান সরকার ব্যর্থ হয় এবং এর মাধ্যমে স্বৈরাচারের ফিরে আসার পথ উন্মুক্ত হতে পারে।

দেশে যে শুধু গুপ্তহত্যা হচ্ছে তা নয়, গোপন ও সুচারু ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অরাজকতাও উসকে দেয়া হচ্ছে। তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপ গত কয়েক বছর ধরেই ভিন্ন সময়ে ভিন্ন জামাতের আয়োজন করে আসছে। কখনো গোলযোগ হয়নি। এবার সংঘর্ষের সৃষ্টি হলো এবং চারজন নিহত হলেন। এবার কেন সংঘর্ষ হলো সে প্রশ্ন উঠেছে।

শুধু গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রী নয়, দেশের সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত তাদের দায়িত্বের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছে তা বলা যাচ্ছে না। ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর যে নির্লিপ্ততা লক্ষ করা যাচ্ছিল, তা এখনো অব্যাহত। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। মেধাবী ও সচেতন ছাত্ররা যদি এভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়, তাহলে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। স্বৈরাচারের সময়ে বিরোধী দল দমনে এই পুলিশ বাহিনীরই দক্ষতা আমরা দেখেছি। এখন যদি তারা আমাদের নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে প্রতি মাসে বিপুল অর্থ ব্যয়ে এই বাহিনী রাখার যৌক্তিকতা কী? ৫ আগস্টের পর গণ-অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে যদি হাজার পাঁচেক পুলিশ সদস্য ও শ’ পাঁচেক গোয়েন্দা নিয়োগ করা হতো, তাহলে আমরা এত দিনে তার সুফল পেতাম এবং হয়তো এই তরুণদের হারাতে হতো না। তবে সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। গণ-অভ্যুত্থানে সফলতার পর থেকেই দেশের আকাশের ঈশান কোণে কালো মেঘের আনাগোনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই গুপ্তহত্যা ও অরাজকতা রুখে দিতে না পারলে তা প্রলয়ঙ্করি ঝড়ে রূপ নিতে বেশি সময় নেবে না।

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মচারী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement
ফ্যাসিবাদের পতনে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে : মির্জা ফখরুল বিএনপির র‌্যালিতে গুলি : ডিবির সেই এসআই কনক গ্রেফতার নারায়ণগঞ্জের বাজারে ৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে শীতকালীন সবজি ফুলকপি ইসরাইলে হাউছিদের হামলা, পালাতে গিয়ে ১২ ইসরাইলি আহত ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে ৩ দিনের আল্টিমেটাম জাবালিয়া শরণার্থী শিবির এখন ‘ভূতের শহর’ ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হলেন নয়া দিগন্তের সাইফুল ইসলাম বিপিএলে প্রথম জয়ের দেখা পেল চট্টগ্রাম জবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি আসাদুল, সেক্রেটারি রিয়াজুল মাঠের মেসি এবার ব্যবসায় ‘ভ্রাতৃদেশ’ বাংলাদেশ সফরে আসছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সকল