মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয়
- মো: মহি উদ্দিন
- ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:২২
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি অনেক চাপের মধ্যে আছে। অর্থনীতির প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ আয়বৈষম্য, বিপুল বৈদেশিক ঋণ, রাজস্ব আয়ে গাটতি, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব, বিনিয়োগে স্থবিরতা, ডলার-সঙ্কট ইত্যাদি। এ মুহূর্তে সরকারের সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। খাদ্যের বাড়তি দাম ব্যাপকভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবারও ১৪ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। গত মার্চ মাসের পর থেকে টানা আট মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। নভেম্বরে তা বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে ওঠে। এর আগে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল ২০১১ সালের মার্চ মাসে, তখন এই হার ছিল ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এরপর চলতি বছরের জুলাই মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি সেই হার ছাড়িয়ে যায়। বিবিএস এখন যে পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি গণনা করে, তাতে গরিব মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ কতটা অনুভব করেন সে বিষয়টি যথাযতভাবে উঠে আসে না। সার্বিকভাবে জাতীয় গড় হিসাবে মূল্যস্ফীতির হিসাব আসে। বিবিএস যে পরিসংখ্যান দেয়, তার চেয়ে গরিব মানুষের ওপর খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক বেশি। তাই গরিব মানুষ ভোগ করে এমন পণ্য ও সেবার ওপর ভিত্তি করে একটি আলাদা মূল্যস্ফীতির সূচক প্রকাশ করলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। সারা দেশের ৬৪ টি জেলার ১৫৪টি হাটবাজার থেকে সাড়ে সাত শ’ পণ্য ও সেবার মূল্যের উপরে নির্ধারিত সময়ে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে থাকে বিবিএস। বিবিএসের হিসাবে, একটি পরিবারকে গড়ে তাদের আয়ের ৪৮ শতাংশ অর্থই খাবার কেনার পেছনে খরচ করতে হয়। অন্যদিকে খাবার কিনতে গরিব পরিবারকে তাদের আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের মতো অর্থ খরচ করতে হয়। দেশে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে যে, রাজনৈতিক সুবিধা পেতে আগে মূল্যস্ফীতি কম দেখানো হতো, অর্থনীতি নিয়ে প্রকাশিত শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বিবিএস পরিসংখ্যানে কারসাজি করার অভিযোগ আনা হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রতিবেদন অনুসারে, গত এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১৫ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে ছিল কিন্তু বিবিএসের প্রকাশ করা পরিসংখ্যানে মূল্যস্ফীতি অনেক কম দেখানো হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বৃদ্ধি মৌলিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, বাংলাদেশ ব্যাংকও সে পথেই হাঁটছে। বাজারে অর্থ সরবরাহের লাগাম টেনে ধরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় দফায় দফায় বাড়াচ্ছে নীতি সুদহার। ২০২২ সালের মে মাসে নীতি সুদহার ছিল ৫ শতাংশ। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১১ বার বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার। চলতি বছরে চার দফা এ সুদহার বাড়ানোর পর সম্প্রতি আবারো ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে তা ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। সাধারণত বাজারে অর্থপ্রবাহ বেড়ে গেলে এবং সে কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়লে, অর্থপ্রবাহ কমাতে নীতি সুদহার বাড়াতে হয়। নীতি সুদহার বেড়ে গেলে দেশের ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হয়। আবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয়, তার সুদহারেও এর প্রভাব পড়ে, এতে গ্রাহকরাও ঋণ গ্রহণে নিরুৎসাহিত হয়। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি মুদ্রা সরবরাহজনিত কারণে নয়। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের যে দুর্দশা এতে মানুষের আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে এ খাতের উপর। আবার জনসংখ্যার বড় একটি অংশ ব্যাংক খাতের আওতায় নেই। ফলে নীতি সুদহার বাড়িয়ে টাকার প্রবাহ কমানোর প্রভাব পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতিতে পড়লেও এ দেশে খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না।
একদিকে উচ্চ সুদহারের কারণে ঋণ নেয়া থেকে বিরত থাকছেন ব্যবসায়ীরা, অন্যদিকে তারল্য সঙ্কটে থাকায় গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না কয়েকটি ব্যাংক। এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা কমছে। অর্থাৎ ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এক ধরনের শ্লথগতি নেমে এসেছে, এর প্রভাবে উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটছে যা পক্ষান্তরে বাজারদর আরো উসকে দিচ্ছে। উপরন্তু আগে থেকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সঙ্কট, ভঙ্গুর বাজার ব্যবস্থাপনা, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ- সব মিলিয়ে মূল্যস্তর ফুলেফেঁপে উঠছে। এতে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের, ফলে ভালো কোম্পানিও চাপে পড়ে যাবে, অনেকে রুগ্ন হয়ে পড়বে, তাতে শুধু ঋণখেলাপিই বাড়বে। আবার দেশে তীব্র গ্যাস সঙ্কটসহ নানা সমস্যার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিস্থিতিও আশাব্যঞ্জক নয়, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারে নতুন বিনিয়োগের মাত্রাও কমেছে যা বেসরকারি খাতে তারল্য সঙ্কট আরো বাড়িয়ে তুলেছে, ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেভাবে এই সমস্যার সমাধান করেছে, তা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। নেদারল্যান্ডস কৃষিপ্রযুক্তির জন্য বিশ্বে প্রসিদ্ধ, তারা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমিয়ে বাজারের ভারসাম্য রক্ষা করেছে। ভারত মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা কমিয়ে কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা করেছে। চীন মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে বাজার স্থিতিশীল করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশও তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। অবশ্য আমাদের দেশে বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হলে সর্বাগ্রে অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যে ভর্তুকি চালু করা গেলে তাদের জন্য একটি মানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাবে। এর জন্য সরকারের আরো সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। দেউলিয়াত্ব থেকে ফিরে আসা দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি দুই মাস ধরে ঋণাত্মক। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমতে থাকায় দেশটিতে এখন মূল্য সঙ্কোচন দেখা যাচ্ছে। বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে, এখানে আরো অবনতি হয়েছে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির।
শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয় ২০২২ সালের প্রথমার্ধে। ডলার সঙ্কট ও অর্থনৈতিক বিপত্তির প্রভাবে দেশটিতে খাদ্য ও জ্বালানির সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি জর্জরিত দেশগুলোর একটি হয়ে ওঠে শ্রীলঙ্কা। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ঠেকে ৭০ শতাংশে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের প্ররিপ্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে এ বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে থাকে বৈদেশিক দায় পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা দেশটি। নিয়ন্ত্রণে চলে আসে মূল্যস্ফীতি। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ঋণাত্মক দশমিক ৫ শতাংশ, অক্টোবরে দাঁড়ায় ঋণাত্মক দশমিক ৮ শতাংশে। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বৃদ্ধি, মুদ্রার বিনিময় হার নমণীয় করা এবং কঠোর আর্থিক ও মুদ্রানীতির মতো পদক্ষেপ নেয়ায় এর সুফল মিললেও তাতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। বাংরাদেশেও সুফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে।
চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধের পাশাপাশি কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা না নিয়ে পণ্যমূল্য নির্ধারণের মতো পদক্ষেপ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সেভাবে কার্যকরী হয় না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশে মূল্যস্ফীতি এখন ২ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে, এসব দেশে মুদ্রানীতি ভালোভাবে কাজ করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে আমানত ও ঋণের সুদহার ৬ ও ৯ শতাংশে নির্ধারিত করে রাখা হয়েছিল, যাতে বাজার ব্যবস্থাপনা আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির ব্যবহার এখানে নতুনভাবে শুরু হয়েছে, এর ফল পেতে সময় লাগবে। তবে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে আমাদের ভূমিকা কম। যদি বাজার ব্যবস্থাপনায় তাদের ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণও থাকে, সিন্ডিকেট কমিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোয় জোর দিতে হবে, অন্যথায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
লেখক : ব্যাংকার, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা