এপার বাংলা-ওপার বাংলা বলে কিছু নেই
- ডা. ওয়াজেদ খান
- ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:১৮
‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে দেশে বিতর্ক চলছে দীর্ঘদিন ধরে। মুক্তিযুদ্ধের এই স্লোগানটি দলীয় স্লোগানে পরিণত করে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সাথে মানানসই নয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। এসব কারণে দেশের বেশির ভাগ মানুষের অনীহা এ স্লোগানে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী আমলে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী রিট করেন ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করার দাবিতে। হাইকোর্ট শুনানি শেষে ২০২০ সালের ১০ মার্চ রায় দেন, ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হবে। আদালতের রায়ে উজ্জীবিত আওয়ামী সরকার স্লোগানটি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে জনগণের ওপর। জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরা লাশের পর লাশ ফেলে রাজপথে। পাঁচ আগস্টের অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে দাবি ওঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বাতিলের। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিল গত ১০ ডিসেম্বর মঞ্জুর করেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ। স্থগিত করেন ‘জয় বাংলা হবে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান’-হাইকোর্টের এমন রায়। এ রায়ের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের চাপিয়ে দেয়া ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের অসারতা প্রমাণিত হলো।
‘জয় বাংলা’ স্লোগানের অপ্রাসঙ্গিকতা
‘জয় বাংলা’ স্লোগানের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে বিভিন্ন সময় পরিবর্তন ঘটেছে ভারতীয় উপমহাদেশের মানচিত্রে। বিশেষ করে আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ড বিভিন্ন শাসকের আমলে পরিচিত লাভ করেছে একাধিক নামে। ইতিহাসের বাঁক ঘুরে সবশেষে একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাভ করেছে স্বাধীনতা। বাংলাদেশ এখন একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছে জাতিসঙ্ঘে। এই রাষ্ট্রের নাগরিকরা বাংলাদেশী এবং তাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্লোগান নিয়ে বিতর্ক ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো আদর্শগত দিক থেকে ’জয় বাংলা’ এবং ’বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে আসছে বরাবর। বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সমাজনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ‘জয় বাংলা ’ স্লোগানটির কোনো কার্যকারিতা নেই এখন। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জাতীয়তা ও স্বাধীনতার মৌলিক চেতনার নিরিখে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি সময়োপযোগীও নয়। এই স্লোগান এখন স্পষ্ট করে না বাংলাদেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতা ও জাতীয়তার মীমাংসিত বিষয়টি। ‘জয় বাংলা’ কেন আর বাংলাদেশের স্লোগান নয় তার মর্মার্থ বুঝতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশী জাতিসত্তার অতীত ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ পূর্বাপর সময়কালকে।
স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। একাত্তরে ৮ মাস ২১ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে সম্পূর্ণ নতুন একটি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের। ইতঃপূর্বে ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট বাংলাদেশ নামে কোনো ভূখণ্ডের অস্তিত্ব ছিল না বিশ্ব মানচিত্রে। হাজার বছর ধরে বঙ্গ, বাঙাল মুলুক, পশ্চিম বাংলা, অবিভক্ত বাংলা ও সর্বশেষ পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল এ অঞ্চল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ববাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত হয় পৃথক প্রদেশ। পরবর্তীতে ১৯১১ সালে রদ করা হয় বঙ্গভঙ্গ। ইতিহাসে দীর্ঘ এ সময়কালে ভূখণ্ডটি শাসিত হয়েছে পালরাজা, হিন্দু সেনরাজা, তুর্কি মুসলিম সেনা, স্বাধীন সুলতান, পাঠান, মোগল বাদশাহ, নবাব, ইংরেজ ও পাকিস্তানিদের দ্বারা। বঙ্গ নাম নিয়ে একাধিক মতভেদ থাকলেও বাংলা নামের উৎপত্তির বিষয়ে জানা যায় মোগল আমলে আবুল ফজল লিখিত আইনী আকবর গ্রন্থ থেকে।
বঙ্গের রাজারা সে সময় জমির সীমানায় উচ্চ ও প্রশস্ত আইল নির্মাণ করতেন। আর সেখান থেকেই বঙ্গের সাথে আইল সংযুক্ত হয়ে নামকরণ হয়েছে বাংলা। দেড় শতক পূর্বেও বাংলার কোনো ইতিহাস নেই বলে বঙ্গদর্শনে আক্ষেপ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিংশ শতাব্দীতে রাখালদাশ বন্দোপাধ্যায় প্রথম রচনা করেন বাংলার ইতিহাস। পূর্ব বাংলার প্রথম মানচিত্র অঙ্কিত হয় ১৭৭৭ সালে। বর্তমান বিশ্ব মানচিত্রে বাংলা বলে কোনো ভূখণ্ড নেই। নেই এপার ও ওপার বাংলার অস্তিত্ব। এক আছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর অপর দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। ফলে কোনো অঞ্চলকেই এখন আর অবকাশ নেই বাংলা বলে চিহ্নিত করার। অঞ্চল বা দেশ হিসেবে বাংলা বুঝাতে চাইলে অবশ্যই এখন প্রশ্ন উঠবে কোন বাংলা? পূর্ববাংলা না পশ্চিম বাংলা? আর বাংলা বলতে একক এবং অখণ্ড একটি অঞ্চলকেই বুঝায়। এ ক্ষেত্রে উঠে আসে জাতীয়তার প্রশ্নটিও। যেমন কান টানলে মাথা আসে। বাংলা নিয়ে এ বিভ্রান্তির অবসান ঘটেছে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে।
জয় বাংলা মানে বাংলার বিজয়। ‘Victory of Bengal’ এই স্লোগানকে বলা হয় ‘ওয়ার ক্রাই’ (War Cry) অর্থাৎ যুদ্ধ চিৎকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উজ্জীবিত করেছে লাখো মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে। বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক সংগঠন এখন জয় বাংলাকে পরিণত করেছে দলীয় স্লোগানে। ফলে দেশের বেশির ভাগ মানুষের মুখে অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছে এই স্লোগান। এখনো যাদের স্লোগান বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। অপর দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২০১৮ সাল থেকে সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি শুধু স্লোগান নয়, ফোন ধরে হ্যালো না বলে জয় বাংলা বলার পরামর্শ দিয়েছেন রাজ্যের নাগরিকদেরকে। শোনা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে বাংলা নামকরণ করা হবে। এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক বাহাস চলছে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি নেতৃবৃন্দের মধ্যে। দু’টি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের কণ্ঠে একই জাতীয়তাভিত্তিক স্লোগান সৃষ্টি করছে বিতর্ক ও বিভ্রান্তির। সঙ্গতকারণেই বাংলাদেশভিত্তিক স্লোগান এখন জরুরি হয়ে পড়েছে আমাদের জন্য।
‘জয় বাংলা’র প্রথম ধ্বনি
ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে ১৯৬৯ এর উত্তাল সময়ে ২২ ফেব্রুয়ারি, শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা জানায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই অনুষ্ঠানেই প্রথম ধ্বনিত হয় এ স্লোগান। তারও ৪৭ বছর আগে ‘জয় বাংলা’ কথাটি উঠে আসে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ভারতবর্ষে চাঙ্গা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। এ সময় পূর্ণচন্দ্র দাশ নামে মাদারীপুরের একজন স্কুল শিক্ষককে স্বাধীনতা আন্দোলনের অভিযোগে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ। পরে পশ্চিম বাংলার বেহরামপুর জেল থেকে মুক্তি পান তিনি। পূর্ণচন্দ্রের মুক্তি উপলক্ষে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে একটি কবিতা লেখার অনুরোধ জানান কালিপদ রায় চৌধুরী। ১৯২২ সালে কবি নজরুল ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ নামে একটি কবিতা লেখেন, যা তার ‘ভাঙ্গার গান’ কবিতার বইয়ে সংকলিত। নজরুলের কবিতায়ই প্রথম উঠে আসে ‘জয় বাংলা’ কথাটি।
কবিতাটি ছিল এমন
‘জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র জয় জয় আদি অন্তরীণ
জয় যুগে যুগে আসা সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি অন্তহীন।’
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কিছু মৌলিক অনুসঙ্গ থাকে। যেমন তার ভৌগোলিক সীমানা, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, সংবিধান, জাতীয় নেতা, জাতীয় স্লোগান ইত্যাদি। যা প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় সমঝোতা, সঠিক ও সত্য ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে। আইন আদালতের মাধ্যমে বিষয়গুলো চাপিয়ে দেয়া যায় না। বাংলাদেশে এমন অনেকগুলো বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে এখনো। একটি নূতন রাষ্ট্র প্রয়োজনে অবশ্যই তার পরিবর্তন আনতে পারে মৌলিক অনুসঙ্গে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে জাতীয় পতাকায় স্থান পায় বাংলাদেশের মানচিত্র। একাত্তরে কোন ভূখণ্ডের জন্য লড়াই ছিল তা স্পষ্ট করতেই পতাকায় সংযুক্ত করা হয় মানচিত্র। ১৯৭২ সালে মানচিত্র ছেঁটে ফেলে পরিবর্তন আনা হয় জাতীয় পতাকায়। ভৌগোলিক অবস্থান ও ঐতিহাসিক সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশ, দেশের রাজধানী, শহর, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতসহ রাষ্ট্রীয় মৌলিক অনুসঙ্গে আনা হয়েছে পরিবর্তন। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
বাঙালি একটি শংকরায়িত জাতি। ধারণা করা হয় চার সহস্রাধিক বছর আগে এ অঞ্চলে আসা অস্ট্রিক ও মঙ্গোলীয়দের সংমিশ্রণে বাঙালি জাতির উৎপত্তি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নৃতাত্ত্বিকভাবে আমাদের পরিচয় বাঙালি। কিন্তু জাতি রাষ্ট্রের নাগরিক পরিচয় বা জাতীয়তা বাংলাদেশী। কেননা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আরো অনেকগুলো উপজাতির বসবাস। ভিন্নভাষী হলেও তারা বাংলাদেশের নাগরিক। তাই সবার সম্মিলিত জাতীয়তা বাংলাদেশী। এ কারণেই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের জাতীয়তা ভারতীয়। শুধু ভাষার ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারিত হলে আরব সাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর এবং লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্য সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত গোটা আরবি ভাষীদের জাতীয়তা হতো এরাবিয়ান। কিন্তু তা হয়নি। মরক্কো থেকে শুরু করে ইয়েমেন, সৌদি, মিসরসহ এ অঞ্চলের সবগুলো আরব দেশের জাতীয়তা ভিন্ন। বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিভক্তপ্রায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে কোনো গুরুত্ব নেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে নতুন করে জাতীয় স্লোগান নির্ধারণের আবশ্যকতা। আদালতের আদেশ নয়, জাতীয় সমঝোতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হোক বাংলাদেশের নতুন জাতীয় স্লোগান।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা