২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইসলামী ব্যাংকিং সংস্কারে প্রস্তাবনা

-

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে আমদানি-রফতানি ও রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সবার শীর্ষে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের মোট স¤পদের ২৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ, আমানতের ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ ও বিনিয়োগের ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকিংয়ের। সবমিলিয়ে দেশের আর্থিক খাতের এক-তৃতীয়াংশ মার্কেট শেয়ার ইসলামী অর্থায়নের। এ ছাড়া বিগত ১০ বছর ধরে বিশ্ব সেরা এক হাজার ব্যাংকের তালিকায় দেশে একমাত্র ইসলামী ব্যাংক শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে অবস্থান করতে সক্ষম হয়েছে।

সরকারি-বেসরকারি বহু ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন জমা পড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দেশে প্রকৃত ইসলামী ব্যাংকের সংখ্যা কয়টি? আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে পুরো ব্যাংক প্রচলিত কিন্তু ওই ব্যাংকের কয়েকটি শাখা ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করলে তারা কি সত্যিকার অর্থেই শরিয়াহ পরিপালনের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনা করতে পারছেন? গ্রাহকরাও একটি সত্যিকার ইসলামী ব্যাংক খোঁজ করে থাকেন এবং তারাও প্রশ্ন রাখেন, পুরো ব্যাংকিং যেখানে সুদভিত্তিক সেখানে ওই ব্যাংকের ছোট্ট একটি অংশ কিভাবে ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনা করে? প্রকৃতপক্ষে, একটি সম্পূরক ইসলামী ব্যাংকের যেসব অবকাঠামো অত্যাবশ্যকীয় তা অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডো ব্যাংকগুলোতে উপস্থিত নেই। ফলে শাখা অথবা উইন্ডো খুলে যেসব ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে সেগুলো কী ধরনের ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

গত চার দশকে ইসলামী ধারার ব্যাংকিংয়ে বড় সাফল্য পেয়েছে মালয়েশিয়া। দেশটির আধুনিক অর্থনীতির ভিত তৈরিতে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভূমিকা ছিল যুগান্তকারী। মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশেও এ সময়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিতে কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখার আগেই আস্থার সঙ্কটের মুখে পড়েছে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে এ ধারার ব্যাংকিং এখন দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় পতিত হয়েছে।

মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার আলাদা আইন ও নীতিমালা লক্ষ করা যায়। স্বাতন্ত্রিক নীতিমালা না থাকলে অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ, তারল্য সঙ্কটের সম্ভাবনাসহ জনআমানতের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়। থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার মতো অমুসলিম দেশগুলোয়ও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য পৃথক আইন চালু হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য দেশে একটি স্বতন্ত্র আইন প্রণয়নের দাবি দীর্ঘদিনের হলেও এতদিন তা অদৃশ্য কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। শক্তিশালী কোনো আইন না থাকার সুযোগে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংককে অনিয়ম, আর্থিক কেলেঙ্কারি ও বাংলাদেশ ব্যাংক তথা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অবাধ লুণ্ঠনের মাধ্যমে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ইসলামী ব্যাংক কোম্পানি আইন-২০২৪’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে যা ইতিবাচক সংবাদ। ইসলামী ব্যাংক সংস্কারে আমি কতগুলো প্রস্তাব উপস্থাপন করছি : ১. একক ব্যক্তি তার পরিবারের সদস্য অথবা কোনো গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় একটির বেশি ইসলামী ব্যাংক পরিচালিত হতে পারবে না। তা ছাড়া পরিচালক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা বা মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে। ২. প্রত্যেক পরিচালককে ব্যক্তিগতভাবে শরিয়াহ পরিপালন করতে হবে, তিনি অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুদভিত্তিক ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন না এবং শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের বিরুদ্ধে কোনো কার্যক্রম করতে পারবেন না মর্মে অঙ্গীকার করতে হবে। এ ধরনের অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে পরিচালক পদে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। ৩. প্রচলিত ও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সুদ। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো মুনাফা ভাগাভাগি করে। ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমে যাতে কোনোভাবেই সুদের লেনদেন না করতে পারে সে ব্যাপরে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে। ৪. মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, পাকিস্তান ও ওমানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে স্বতন্ত্র ইসলামী ব্যাংকিং বিভাগ রয়েছে। ইসলামী অর্থায়ন খাতের নিয়মতান্ত্রিক তদারকি ও নিবিড় তত্ত্বাবধানের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং অভিজ্ঞ জনবলসহ একজন ডেপুটি গভর্নর বা সমমর্যাদার কর্মকর্তার অধীনে ডেডিকেটেড ইসলামী ব্যাংকিং বিভাগ চালু করতে হবে। ওই বিভাগের অধীনে নিরীক্ষা, রিসার্চ ও ট্রেনিং, সময়ে সময়ে পরিবর্তিত আইন-কানুন, সার্কুলার, গাইডলাইন এবং প্রকাশনা প্রণয়ন ও প্রকাশ করবে। মোটকথা, সার্বিক ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

৫. বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক শরিয়াহ বোর্ড থাকবে, যা দেশের সব ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ৬. সব ইসলামী ব্যাংকের সমন্বয়ে একটি ‘ইসলামী ব্যাংক রিক্রুটমেন্ট কমিটি (আইবিআরসি)’ গঠন করা যেতে পারে যার অধীনে সারা দেশ থেকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের সব ইসলামী ব্যাংকে মেধাবী কর্মী নিয়োগ করা যেতে পারে। ৭. সাধারণভাবে প্রচলিত ও ইসলামী ব্যাংকিং একসাথে চলতে পারে না। তবে প্রচলিত ব্যাংকে শাখা অথবা ইউন্ডো থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন শরিয়াহ বোর্ড এবং শরিয়াহভিত্তিক নিরীক্ষা বিভাগ থাকতে হবে। ৮. কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ইসলামী মানি ও ক্যাপিটাল মার্কেটকে শক্তিশালী করতে হবে। ৯. ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য গভর্ন্যান্স বোর্ড অব স্ট্রাকচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাশাপাশি আইনে স্পষ্টভাবে শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হওয়ার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা উল্লেখ থাকতে হবে। ১০. বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ গ্রহণ ও প্রদানের ক্ষেত্রে সুকুকসহ বিভিন্ন ইসলামী আর্থিক খাতগুলো ব্যাপক ভূমিকা পালন করলেও বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য এটি একেবারেই নতুন ক্ষেত্র। এখানে এখনো মৌলিক অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। তাই সুকুকের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।

১১. প্রকৃত আমানতকারীদের মধ্যে কমপক্ষে চারজনকে পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। ১২. একজন পরিচালকের সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে তিন বছর এবং সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ পর্যন্ত অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন। ১৩. বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একক প্রতিষ্ঠান ও গ্রুপসীমা পৃথকভাবে নির্ধারিত থাকতে হবে। ১৪. ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্রয়-বিক্রয় নিশ্চিত করার জন্য অ্যাজেন্ট নিয়োগ করার বিধান আছে। এ ধরনের এজেন্টের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার মানদণ্ড নির্ধারিত থাকা উচিত। ১৫. ব্যাংক জনগণের সরবরাহকৃত আমানত এবং বিনিয়োগ গ্রহণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাই ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগের তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত থাকতে হবে। ১৬. সেবা বিশেষ করে সফটওয়্যারের মতো অস্পৃশ্য পণ্য আমদানি-রফতানি বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ¯পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। ১৭. বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের মামলা অনির্দিষ্ট সময় ধরে আদালতে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। তাই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের ব্যবস্থা করতে হবে।

১৮. সব গ্রাহকের একটি ইউনিক আইডি (এনআইডিও হতে পারে) যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং ওই আইডির বিপরীতে সব ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে। একজন গ্রাহকের একটি ব্যাংকে সমজাতীয় একাধিক হিসাব থাকতে পারবে না। তাহলে জাল-জালিয়াতি প্রতিরোধ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। ১৯. ইদানীং অসাধু মালিকপক্ষের চাপে অনেক ব্যাংকের সফটওয়্যার ম্যানিপুলেশন করার মাধ্যমে কৌশলে সুদ হার হ্রাস বা সুদ নির্ণয় না করা, খেলাপি ঋণ/বিনিয়োগকে নিয়মিত দেখানো এমনকি অনেক ক্ষেত্রে লেনদেন মুছে ফেলার অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে সব ইসলামী ব্যাংকের একটি ইউনিক সফটওয়্যার থাকা উচিত যার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত নিয়ন্ত্রণ থাকবে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্নীতিগ্রস্ত হলে এর সুবিধা কতটুকু পাওয়া যাবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ২০. অর্থ পাচারকারীদেরকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে, তাদের রাষ্ট্রীয় সব সুবিধা বাতিল এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আইন কার্যকর করতে হবে। ২১. ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ঋণখেলাপিদের নাম-ঠিকানা বিভিন্ন গণামাধ্যম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে, তাদের পাসপোর্ট বাতিলসহ পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে হবে।

যেহেতু ইসলামী ব্যাংকিংব্যবস্থা গতানুগতিক ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, তাই এখানে ব্যাংকিং দক্ষতার পাশাপাশি নৈতিক প্রশিক্ষণ ও ইসলামিক ব্যাংকিংব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ আনুগত্যশীল ও বিশ্বাসীরা ছাড়া এর পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা খুবই দুরূহ। সেটি ব্যাংক পরিচালনা পরিষদ থেকে শুরু করে ব্যাংকের একজন প্রহরীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ এখানে পেশাসংশ্লিষ্ট বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি ব্যক্তির মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ লালন ও নিজের মধ্যে প্রয়োগের মাধ্যমে পরকালীন প্রতিদান প্রাপ্তির বিষয়টিও ব্যাংকিং সফলতার পেছনে অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। সে ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক খাতকে গতানুগতিক ব্যাংকের মতো করে পরিচালিত করলে এখানে দিন দিন আরো ঝুঁকি বাড়ার শঙ্কাই প্রবল।

লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিশ্লেষক
ই-মেইল: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement