মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য পরিস্থিতি উসকে দেয়
- এম এ খালেক
- ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:৪৩
দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আলোচিত বিষয়। এটি অর্থনীতিতে নানামুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আর্থিক খাতের দুর্বৃত্তরা পারস্পরিক যোগসাজসে কর্মকাণ্ড চালায়। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হলেও পতিত সরকারের সৃষ্ট ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র এখনো বহাল রয়েছে। যে কারণে নানাভাবে চেষ্টা করেও মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আনা যাচ্ছে না।
দেশের পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও পণ্যমূল্য বেড়ে গেলে সে অবস্থাকে মূল্যস্ফীতি বলা যায়। এটি যে সব সময় অর্থনীতির জন্য খারাপ তা নয়। অনেক সময় উৎপাদনের স্বার্থে কিছুটা মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত হতে পারে। মূল্যস্ফীতি নেতিবাচক অবস্থায় চলে গেলে ভোক্তারা লাভবান হলেও তৃণমূলের উৎপাদক শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হন। তারা উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পাবেন না। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে উৎপাদনকারী পরবর্তী বছর উৎপাদনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। এতে দেশের পণ্য উৎপাদন ও জোগান ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই একটি নির্দিষ্ট হারে মূল্যস্ফীতি থাকা বাঞ্ছনীয়।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে তিন থেকে চার শতাংশ মূল্যস্ফীতি থাকা সহনীয় হতে পারে। এর চেয়ে বেশি হলে তা বিপর্যয়কর।
অনেকের এমন ধারণা রয়েছে যে, কোনো একটি বা দু’টি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে তাকে মূল্যস্ফীতি মনে করেন। আসলে মূল্যস্ফীতি পরিমাপে কিছু নির্দিষ্ট পণ্য বিবেচনায় নেয়া হয়। অর্থনীতির পরিভাষায় কোনো একটি বা দু’টি নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিকে মূল্যস্ফীতি বলে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতি পরিমাপ করে। সংস্থাটি নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের গড়মূেল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস বিবেচনায় মূল্যস্ফীতি পরিমাপ করে। এ নির্দিষ্ট পণ্যগুলো আবার দু’ভাগে ভাগ করা হয়। কোনোটি শহরের, কোনোটি গ্রামের জন্য। শহরের জন্য মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ে ৪২২টি পণ্য বিবেচনায় নেয়া হয়। গ্রামের বেলায় ৩১৮টি পণ্য বিবেচনায় নেয়া হয়। এসব পণ্যের গড়মূল্য বেড়ে গেলে তাকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব পণ্যের গড়মূল্য হ্রাস পেলে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী হয়েছে ধরা হয়। মূল্যস্ফীতি আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে একটি খাদ্যপণ্যে, অন্যটি খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে।
টাকার বিনিময় হার হ্রাস পেলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিতে পারে। বিনিময় হার হ্রাস পেলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্য বাড়তে পারে। মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এতে বিশেষ করে স্বল্প এবং নিম্নআয়ের মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। মূল্যস্ফীতি যখন উচ্চমাত্রায় চলে যায় তখন তাকে অর্থনীতির দানব বলে চিহ্নিত করা হয়। এ অবস্থায় ভোক্তা আগের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করে একই পরিমাণ পণ্য ও সেবা পান না। সুবিধাবঞ্চিতরা উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাদের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে আসে। তারা চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। এসব সুবিধাবঞ্চিতের বেশির ভাগ শ্রমজীবী। তাদের মনে হতাশা দেখা দেয়। উচ্চ আয়ের মানুষেরা এবং যারা চেষ্টা করলে আয় বাড়াতে পারেন তাদের জন্য এটি বড় সমস্যা নয়।
যারা তৃণমূলপর্যায়ের উৎপাদক তারা আশা করেন, তাদের পণ্যের মূল্য বাড়ুক। কিন্তু ভোক্তারা চান পণ্যমূল্য কমুক। কোন পণ্যের উৎপাদন এবং জোগান কমে গেলে সেটির মূল্য বাড়তে পারে। আবার কোনো পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেলেও মূল্যস্ফীতি ঘটতে পারে। উৎপাদন স্বাভাবিক থাকা অবস্থাতেও পরিবহন সঙ্কটে পণ্যমূল্য বাড়তে পারে।
আমাদের মতো দেশে মূল্যস্ফীতির হ্রাস-বৃদ্ধি যাই ঘটুক না কেন, তাতে ভোক্তা এবং উৎপাদক কেউ লাভবান হন না। যারা মধ্যস্বত্বভোগী তারা তৃণমূলপর্যায়ের উৎপাদকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বাজার দরের চেয়ে কম দামে পণ্য কিনে তা অতিরিক্ত মূল্যে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেন।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে যত উদ্যোগ নেয়া হোক না কেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে তা তেমন ভূমিকা রাখতে পারবে না। যদি না বাজারে রাজনীতি প্রভাবিত ব্যবসায়ী দুষ্টচক্র দমন করা না যায়। ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র ভাঙতে না পারলে বাজারে পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় নামিয়ে আনা যাবে না। বিগত সরকারের আমলে বিবিএস মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার অনেকটা কমিয়ে দেখাত। বর্তমানে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা চলছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনাকালীন উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে তিন কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গিয়েছিল। এ ছাড়া বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ (র্যাপিড) সম্প্রতি দেখিয়েছে, গত দুই বছরে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান থাকায় ৭৮ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যে ৩৮ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র শ্রেণীতে নেমেছে। এ ছাড়া আরো ৯৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি আগামীতে নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে এ মানুষগুলোও দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারেন। করোনাকালে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া লোকদের মধ্যে কতজন দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসতে সক্ষম হয়েছেন তা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে মূল্যস্ফীতির যে পরিসংখ্যান দেখানো হচ্ছে, তা যে পূর্ণাঙ্গ এবং সঠিক এমন মনে করার কারণ নেই। বিবিএস মূল্যস্ফীতির যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে; বাজারে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। জ্বালানি তেলের মূল্যের ওঠানামা অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির ওপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে গত সরকারের আমলে সর্বশেষ জ্বালানি তেলের মূল্য ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয়। বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলে স্থানীয় বাজারেও জ্বালানি মূল্য সমন্বয় করা হবে। কিন্তু সেই অঙ্গীকার পালন করা হয়নি। ক্রমবর্ধমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসকরণ অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এ মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। দরিদ্র মানুষ বিপ্লব বোঝেন না। তারা বোঝেন দুই বেলা খাবার জুটছে কি না। সাধারণ মানুষ যদি বাজারে গিয়ে সামর্থ্যরে মধ্যে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কিনতে না পারেন তাহলে কোনো কিছু তাদের শান্ত করতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে এক বছর সময় প্রয়োজন। তাহলে এই এক বছর কী মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যসামাগ্রী ক্রয় করতে পারবেন না? এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়া। এ জন্য সবার আগে দরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা।
লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা