২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ভারতের অভিপ্রায় : জনমতের অবমাননা ও সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন

ভারতের অভিপ্রায় : জনমতের অবমাননা ও সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন - ছবি : সংগ্রহ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিবেশী ভারতের প্রভাব নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ক্ষমতার ভারসাম্যে ভারত প্রভাব বিস্তার করে আসছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। বর্তমানে ভারতের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ধরে রাখার প্রচেষ্টা শুধু বাংলাদেশী জনমতের অবমাননা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি হুমকি।

বাংলাদেশের জনগণ একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের নানাবিধ হস্তক্ষেপ এই স্বাধীনতার মর্মকে ক্ষুণ্ণ করেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ধরে রাখতে ভারতের নিরন্তর প্রচেষ্টা জনগণের মতামতকে অগ্রাহ্য করেছে।
ভারত সবসময়ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার সুবিধা নিশ্চিত করতে চেয়েছে। যখনই বাংলাদেশের জনগণ ভোটের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন চেয়েছে, তখনই ভারতের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ওই পরিবর্তনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এই নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি ও বিরোধী দলের দমন-পীড়ন সত্ত্বেও ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন জানায়। এটি স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের জনগণের মতামতকে অগ্রাহ্য করার একটি দৃষ্টান্ত।

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে গেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, গুম, এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের ওপর দমন-পীড়ন এ সরকারের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার এসব কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। সেখানে ভারত নিজেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুমে অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে ভারতের জেলে পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে বিশ্বমিডিয়ায় কখা উঠলেও ভারত এ বিষয়ে নীরব থেকেছে। বরং অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' (আরএডব্লিউ) এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশে সরকারের পক্ষে কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষত বিরোধী দলগুলোকে দুর্বল করতে এবং সরকারের অবস্থান শক্তিশালী করতে ভারতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এটি শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপই নয়, বরং গণতন্ত্রের মূলনীতি ও মানবাধিকারের প্রতি তাদের অবজ্ঞার প্রমাণ।

ভারতের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা। এটি শুধু রাজনীতিতে নয়, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিকেও প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে তিস্তা নদীর পানি অব্যাহতভাবে প্রত্যাহার করা, সীমান্তে নির্মম হত্যাকাণ্ড, এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভারতীয় পণ্যের একচেটিয়া প্রভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এই পরিকল্পনার অংশ।

তিস্তা চুক্তি ভারতের স্বার্থে আটকে রয়েছে, যা বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সীমান্তে বিএসএফের বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলি করে হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সাথে বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের দাপট দেশের স্থানীয় শিল্পকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য হুমকি।

বাংলাদেশের জনগণ ভারতীয় প্রভাব এবং আওয়ামী লীগের একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। ভারতের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষা করার প্রবণতা সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। ভারতের প্রতি বাংলাদেশী জনগণের আস্থার অভাব এবং বিরোধিতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও এই পরিস্থিতিকে গভীর উদ্বেগের সাথে দেখছেন। বাংলাদেশে ভারতের প্রভাবশালী ভূমিকা শুধু দেশীয় রাজনীতির জন্য নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জনগণ একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। ভারতের বর্তমান ভূমিকা সেই স্বপ্নকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে।

ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক অবশ্যই পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমতা, এবং স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে হবে। ভারতের উচিত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং জনগণের মতামতকে সম্মান জানানো। একই সাথে বাংলাদেশ সরকারকেও ভারতের সাথে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে।

ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণের মতামতকে সম্মান করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি তার দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করা। অন্যথায়, এই দুই দেশের সম্পর্ক শুধু তিক্ততরই হবে। বাংলাদেশের জনগণ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অবস্থান বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ভারতের নীতি যদি তা বাধাগ্রস্ত করে, তবে বাংলাদেশীদের প্রতিরোধ আরো তীব্র হবে।

ভারতের বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ধরে রাখার প্রচেষ্টা কেবলমাত্র বাংলাদেশের জনগণের মতামতকেই অপমান করে না, এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি। ভারত যদি সত্যিই একটি শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই তার বর্তমান নীতি পরিবর্তন করতে হবে। ফ্যাসিবাদি আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বন্ধ করতে হবে।

অন্যথায়, জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ভারতের এই আধিপত্যবাদী নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাবে, একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। ভারতকে বুঝতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিসীমা এখন দুনিয়া বিস্তৃত। কোনো একক দেশের উপর নির্ভরতার দিন আর নেই। ভারতকে এও বুঝতে হবে, কোনো নতজানু সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও পুরো জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তাই ভারত বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখবে। এটাই নতুন বাংলাদেশের চাওয়া।

লেখক : ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement