দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন উন্নয়নের বাধা
- মো: মাঈন উদ্দীন
- ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:০৭
বাংলাদেশ উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। উন্নয়ন ও অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন। জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। যে যত বড় মাপের দুর্বৃত্ত, সে তত বড় ক্ষমতাবান। সমাজে সে তত উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত, তত বেশি সালামপ্রাপ্ত। তারা স্তাবক, পারিষদ, অস্ত্রধারী, বন্দুকধারী, লাঠিয়াল বাহিনী দ্বারা পরিবৃত্ত। তারা সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করে, মানুষকে ভয় দেখায়, অঙ্গচ্ছেদ করে, লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্য মানুষ হত্যা করে, অধিকার কেড়ে নেয়, মানুষকে গলা কেটে জবাই করে, গুম করে।
মানুষ চায় প্রশান্তি, চায় নিরাপদ স্থান, একটু স্বস্তি, হাফ ছেড়ে বাঁচার জায়গা, মনখোলে কথা বলতে চায়। মানুষ চায় সাম্য, চায় ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা। গত ১৫ বা ১৭ বছরে এর শেষ ধাপ শুরু হলেও স্বাধীনতাত্তোর কাল থেকেই বৈষম্য, গণতন্ত্রহীনতা, মানবাধিকার বঞ্চনা থেকে এর যাত্রা শুরু হয়। উন্নয়ন, অনুন্নয়ন, দুর্নীতি-স্বচ্ছতা, দুর্বৃত্তায়ন, ন্যায়বিচার, হত্যা, গুম, খুন যাই বলি না কেন সব কিছুর মূলে রয়েছে অর্থ। অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ আর সৎভাবে অর্জিত অর্থ দুটোরই ব্যবহার যাই হোক ফলাফল কিন্তু সমান হতে পারে না।
এত দিন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, ব্যাংক ঋণখেলাপি, বিদেশে টাকা পাচারকারীদের মাধ্যমে একটি বড় আকারের ধনী ও অতিধনী শ্রেণী সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের অর্থনীতির মূল স্রোতে আনার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছিল। ফলে স্বৈরাচারী পতিত সরকার নিজেদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতকল্পে পরিকল্পনামাফিক দুর্বৃত্তায়ন, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অর্থলোপাটকারীদের নানা সুযোগ তৈরি করে দেয়। সমাজে, অর্থনীতিতে বৈষম্য তৈরি হয়। অর্থপাচার করে প্রবাসীদের পাঠানো সঞ্চিত রেমিট্যান্সেও ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসে। দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী ও নানা অনিয়ম, অর্থ পাচার, কর ফাঁকির সুযোগ গ্রহণ করে।
পতিত সরকার নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে সব অনিয়মকে আশ্রয় প্রস্রয় দিয়ে গেছে। ফলে তৈরি হয়েছে বড় বড় ক্ষত। যার খেসারত জনগণকে দিতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০ শিল্প গ্রুপের মধ্যে চারটি গ্রুপ নিয়ে তদন্ত শুরু করছে সিআইডি। বাকি ছয়টির তদন্ত করছে দুদক। এ তালিকায় রয়েছে বহুল আলোচিত এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন, নাসা, বসুন্ধরা ও শিকদার গ্রুপ। পত্রিকার রিপোর্টে দেখা যায় শুধু ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই সেটি থেকে এস আলম গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ বের করে নেয়। এ অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ। এই ব্যাংক থেকে গ্রুপটির নেয়া পরোক্ষ ঋণের পরিমাণ সাত হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। যদিও ইসলামী ব্যাংক কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপকে সর্বোচ্চ ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে। তবু তারা সেই সীমা লঙ্ঘন করে অনেক বেশি দিয়েছে। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইসলামী ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নিয়ে গ্রুপটির চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করে ঋণ আদায়ে উদ্যোগী হয়। অন্য দিকে দেশের ১৬টি ব্যাংক ও সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বেক্সিমকো গ্রুপের ৭৮টি প্রতিষ্ঠানের দায়ের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ টাকার প্রায় অর্ধেকই জনতা ব্যাংকের।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, যদি মানুষকে অর্থনৈতিক স্বস্তি দেয়া না যায় এবং আইনশৃঙ্খলা দিয়ে সুরক্ষা দিতে না পারি, তাহলে সংস্কারের জন্য মানুষের যতই ভালোবাসা থাকুক না কেন, ধৈর্য থাকবে না। পতিত স্বৈরাচারী সরকার অর্থনীতির যে ভয়াবহ বিপর্যয় এনেছে তার উত্তরণের জন্য সরকারকে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা এই সরকারের বড় শক্তি জনগণের সমর্থন। সরকার সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, দুদক প্রভৃতি সংস্কারে যেসব কমিশন গঠন করেছে, তার প্রতি সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আছে। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে পথচলা বর্তমানে সরকারকে মনে রাখা উচিত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি না ঘটলে, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলে সব পরিকল্পনা বিফলে যেতে পারে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ পণ্যের দাম বাড়ার জন্য চাঁদাবাজিকে দায়ী করেছেন। চাঁদাবাজি বা মজুদদারি; যে কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ুক না কেন, এর বিরুদ্ধে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থনীতিতে ব্যাংক ও আর্থিক খাত খাদের কিনারে পতিত। যার ফলে ব্যবসায় বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বিরাট শূন্যতা রয়েছে। বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। ২০২৪ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আইনের সময়োপযোগী প্রয়োগ। আজ আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, সে সমাজে বৈষম্য স্বাধীনতার পর থেকে যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। আমরা যদি আমাদের আশপাশের দেশগুলোয় দেখি, সেসব দেশ কিন্তু আমাদের দেশের তুলনায় উন্নত হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে বৈষম্য ততটা বাড়েনি।
বৈষম্য নিরাময়ের বিষয়ে অর্থনীতিবিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া উচিত। ‘আমাদের নীতি কাঠামো এবং আমাদের অর্থনীতির যে মূল ধারা, সেটি পরিবর্তন করতে হবে। আমরা বর্তমানে যেভাবে উন্নয়ন করছি সে ধারা বৈষম্য কমানোর চেয়ে বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই আমাদের নতুন ধারায় উন্নয়ন করা লাগবে, যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে প্রধান হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।’ অর্থনীতিতে গণতন্ত্রের প্রতিফলন থাকতে হবে। আজ আমাদের সমাজে একটি অলিগার্ক শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যার মূল কারণ আমাদের অর্থনীতিতে পুঞ্জীভূত সম্পদ অনেক। এ পরিস্থিতি উত্তরণে অর্থনীতিতে সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা থাকা চাই। অর্থনীতি ও রাজনীতিতে গত দেড় দশকে ব্যাপক দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। এসবের নীতিনির্ধারক ছিল একশ্রেণীর লুটেরা। অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হলে, স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
ইমেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা