১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

খলিল জিবরানের দেশের দুঃখগাথা

-

একটি শহরে দু’জন জ্ঞানী ব্যক্তি বাস করতেন। দু’জনকেই বেশ যোগ্য মনে করা হতো কিন্তু চিন্তাগত বিরোধের কারণে উভয়ে পরস্পরে বিতর্কে লিপ্ত হতেন। তাদের মধ্যে একজন আল্লাহকে বিশ্বাস করতেন। আর অপরজন আল্লাহকে অস্বীকার করতেন। একদিন উভয়ের মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক চলল। কয়েক ঘণ্টা বিতর্ক চলা সত্ত্বেও এ ফয়সালা হলো না যে, কে জিতলেন আর কে হারলেন? আল্লাহকে অস্বীকারকারী জ্ঞানী ব্যক্তিটি বিতর্ক ছেড়ে সোজা উপাসনালয়ে যান। সেজদায় লুটিয়ে পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেন। যে জ্ঞানী আল্লাহকে বিশ্বাস করতেন, তিনি ঘরে গিয়ে তার সব গ্রন্থ জ্বালিয়ে দেন। কেন না, তিনি আল্লাহকে অস্বীকারকারী হয়ে গেছেন। উভয়ের জীবনে পরিবর্তন আসে।

এটি একটি গল্প। আর এ গল্পের রচয়িতা খলিল জিবরান। খলিল জিবরান লেবাননের মানুষ। তিনি তার জীবনে বহু গ্রন্থ লিখেছেন, যা এখনো বেশ জনপ্রিয়। খলিল জিবরানকে আরবি ভাষায় শেক্সপিয়রও বলা হয়। শেক্সপিয়র লম্বা লম্বা নাটক লিখতেন কিন্তু খলিল জিবরান ছোট ছোট গল্প ও কাহিনীতে বড় বড় কথা বলতেন। তিনি এক খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তিনি ধর্মের ভিত্তিতে বিদ্বেষের পরিবর্তে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন। খলিল জিবরান ১৯২৩ সালে ‘আন-নাবী’ নামে আরবিতে একটি গ্রন্থ লেখেন, The prophet নামে যার ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে। এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় উদারতা ও সর্বজনীনতার বার্তা দিয়েছেন। তিনি মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। আফসোসের বিষয় হচ্ছে- খলিল জিবরানকে তো লেবাননে দাফন করা হয়, কিন্তু তার চিন্তার সাথে লেবাননের পরিচয় হয়ে উঠেনি। খলিল জিবরানের মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত লেবানন ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের শিকার হয়।

১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর লেবাননে গৃহযুদ্ধ ও সঙ্কট ইসরাইলকে নিজের অস্তিত্বের জন্য ভাবতে বাধ্য করে। কেননা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের একটি বিশাল অংশ লেবাননে এসে বসতি গড়ে তুলেন। ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের জন্য হুমকি ছিল। আর আরব লেবাননিরা এ ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করতেন। এ কারণে ইসরাইল প্রথমে লেবাননিদের সাথে ফিলিস্তিনিদের লড়াই বাধিয়ে দেয়। এর পর লেবাননিদেরও পরস্পরের মধ্যে লড়াই করায়। দীর্ঘদিন পর আরব লেবাননিরা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক হয়ে যান। লেবাননে আসার পর থেকে প্রতিদিনই সংবাদ আসছে যে, ইসরাইল দক্ষিণ লেবাননে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। তবে ইসরাইলের হামলাকে দুর্বল করে দেয়া হয়। বাহ্যত ইসরাইলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লড়াই করছে হিজবুল্লাহ। কিন্তু হিজবুল্লাহর এ লড়াইয়ের পেছনে আরব লেবাননিদের মুসলিম-খ্রিষ্টান ঐক্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

লেবাননে খলিল জিবরানের স্বপ্ন সত্যে পরিণত হচ্ছে। তবে পূর্ণ হওয়ার আগে স্বপ্ন ভেঙে দেয়ার চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। ইসরাইল লেবাননের শিয়া অধ্যুষিত এলাকাকে বেশি লক্ষ্য বানাচ্ছে। সুন্নি ও খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকাকে কম টার্গেট করছে। অথচ দক্ষিণ লেবাননের খ্রিষ্টানরাও ইসরাইলের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। ইসরাইল আরব লেবাননিদের আবারো ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে। ইসরাইলের বোমাবর্ষণের কারণে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ছে। লেবাননের সরকার ও সেনাবাহিনী এতটা শক্তিশালী নয় যে, এই লাখ লাখ আক্রান্ত ব্যক্তিকে সামলাবে। এই আক্রান্ত ব্যক্তিরা কিছুটা নিরাপদ এলাকায় খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের এ আশ^াস দেয়া হচ্ছে যে, যদি লেবাননে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের থামিয়ে দেয়া যায়, তাহলে তাদের সমস্যার সমাধান হতে পারে। সাধারণ লেবাননিদের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য ইসরাইলের পক্ষ থেকে ড্রোন টেকনোলজিও ব্যবহার করা হচ্ছে।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বৈরুত ছাড়া তারাবলুস ও সৈদাসহ লেবাননের বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধাক্রান্তদের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়। আপনি যখনই যেকোনো স্থানে যুদ্ধাক্রান্তদের সাথে কথা বলবেন, দেখবেন তারা অনবরত আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। ট্যাক্সিওয়ালাও গর্দান ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন আর বলছেন, ইসরাইলি ড্রোন বেশ নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। যখন থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, ইসরাইলের ড্রোন লেবাননের আকাশের এক স্বতন্ত্র অংশ হয়ে গেছে। এগুলো দিন-রাত উড়ে বেড়াচ্ছে আর মানুষ তার শব্দে আতঙ্কে থাকছে। এ ড্রোন ওই এলাকাগুলোতেও উড়ে বেড়ায়, যেখানে খ্রিষ্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। একজন পাকিস্তানি যখন ইসরাইলি ড্রোনের এ আকাশসন্ত্রাস বারবার দেখে, তখন তার নিজেদের এয়ারফোর্সের কথা মনে পড়ে যায়, যা ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইলের অহমিকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে তাদের বিমান ধ্বংস করেছিল। যদি এ ধরনের ড্রোন পাকিস্তানে পাঠানো হয়, তাহলে ড্রোনগুলো কয়েক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে। ইসরাইলি ড্রোনের স্বতন্ত্র গর্জন শুনে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের জন্য মন থেকে দোয়া বেরিয়ে আসে, যারা পাকিস্তানের আকাশে ঢুকে পড়া শত্রুর বিমানকে তৎক্ষণাৎ ফেলে দেয় এবং বিমান থেকে প্যারাস্যুটের মাধ্যমে ঝাঁপ দেয়া পাইলটকে চা পান করিয়ে তার দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান নিজেদের ভূমিকাকে শুধু জাতীয় নিরাপত্তা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখলে তারা নিজেদের ওই সমালোচনা থেকে নিরাপদ রাখতে পারবে, যা তাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের কারণে সৃষ্টি হয়। বৈরুতে এ সময় অনেক পশ্চিমা সাংবাদিক উপস্থিত রয়েছেন। যারা ইউক্রেনের যুদ্ধের রিপোর্ট করে নিজেদের বেশ অভিজ্ঞ যুদ্ধকাহিনীবিদ মনে করছেন। লেবাননের যুদ্ধ তাদের হতভম্ব করে দিয়েছে। কেননা, সাধারণ লেবাননিরা প্রতিটি পশ্চিমা সাংবাদিককে নিজেদের শত্রু মনে করেন। এ সাংবাদিকরা যুদ্ধাক্রান্তদের আস্থা অর্জন ব্যতিরেকে তাদের নিয়ে ভিডিও শুরু করতেই তাদের ক্যামেরা ভেঙে দেয়া হয়। বেলজিয়ামের এক সাংবাদিককে দক্ষিণ বৈরুতে অনুমতি ব্যতিরেকে ভিডিও করতে বাধা দেয়া হয়। তিনি বিরত না হওয়ায় তার পায়ে গুলি করা হয়। পশ্চিমা সাংবাদিকদের বেশির ভাগই যখন ভৌগোলিক বাস্তবতাকে অনুধাবন না করে নিউজ কভার করেন, তখন জনসাধারণের প্রতিক্রিয়ার নিশানায় পরিণত হন। এ প্রতিক্রিয়া তাদের খলিল জিবরানের কথা মনে করিয়ে দেয়, যিনি আজো পাশ্চাত্যে বেশ জনপ্রিয়। পাশ্চাত্যের বুঝে নেয়া উচিত, যদি খলিল জিবরানের দেশে শান্তি কায়েম না হয়, তা হলে এখান থেকে শুরু হওয়া অশান্তি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। খলিল জিবরানের দেশের দুঃখগাথা একটি আন্তর্জাতিক দুঃখগাথায় পরিণত হবে।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং হতে
উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
রাখাইন রাজ্যে সংঘর্ষে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষা শিখলে উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে বিসিএসের আবেদনে চিকিৎসকদের বয়স ৩৪ করা হোক : ড্যাব জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ শিক্ষার্থী গুপ্তহত্যায় ছাত্রশিবিরের উদ্বেগ যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি দাবি শিশু বিশেষজ্ঞদের ‘বাংলাদেশের উপজেলাসমূহের ডিজিটাল মানচিত্র প্রণয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের সেমিনার বাংলাদেশকে আরো ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দেবে আইএমএফ তদন্তে বেরিয়ে এলো মা-মেয়ে হত্যার লোমহর্ষক কাহিনী বিকল্প টুর্নামেন্টের চিন্তা করছে বাফুফে যাত্রীদের প্রতাশা পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে ইউএস-বাংলা চুয়াডাঙ্গার বিএনপি নেতাকে কুপিয়ে জখম

সকল