১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১, ১৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

এলডিসি থেকে উত্তরণের সুফল কী

- নয়া দিগন্ত

স্বল্পোন্নত থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ এ অনুমোদন দিয়েছে। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সে অর্জন উদযাপন করা হয়। চূড়ান্ত স্বীকৃতি মিলবে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর। এ স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের নভেম্বরে। কিন্তু করোনা মহামারীর অভিঘাতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সে সময়সীমা দুই বছর বাড়ানো হয়।

সদ্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকার গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ হিসেবে দেখাচ্ছিল। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ১৫ বছর ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ের ভুল পরিসংখ্যান দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। মিথ্যাচার ও ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকার। অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র কমিটি উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধিকে ধাঁধার সাথে তুলনা করেছে। তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এ পরিসংখ্যান ভুল এবং এর উৎস অজ্ঞাত। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন পর্যালোচনা ছাড়াই প্রকাশ করেছে পতিত সরকার। মাথাপিছু আয় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত অর্থবছরের প্রকৃত মাথাপিছু আয় আগের সরকার যা দাবি করেছিল, তার চেয়ে ৫০০ ডলার কম হবে। কোভিড সংক্রমণের সময় ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের চেয়ে অর্ধেকের কম হয়ে ৩.৪৫ শতাংশে নামে, কিন্তু তখনো মাথাপিছু আয় দেখানো হয় ২,৩২৬ ডলার। এ তথ্যে বিস্মিত হন অনেকে, কারণ মহামারীর সময় দফায় দফায় লকডাউনে অনেকে আয়-উপার্জন হারান, বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর মাথাপিছু আয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ইকোনমিক সেন্স থেকে বোঝা যায়, জিডিপির আকার ও প্রবৃদ্ধির রেট বাড়ানো হয়েছে। মাথাপিছু আয় হিসাব করায় এমনকি জনসংখ্যার হিসাবও কম দেখানো হতো।

এদিকে রফতানির হিসাবেও ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য বিকৃতি ঘটানো হয়। চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হিসাব সংশোধন করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের অসঙ্গতির বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, হিসাবে থাকা ২৩ বিলিয়ন ডলার (গত দুই অর্থবছরের ২০ মাসে) উধাও। রফতানির তথ্য যদি এভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়, অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের অবস্থা তাহলে কী? দারিদ্র্যবিমোচন বা সামাজিক উন্নয়ন সূচকে যে অগ্রগতির কথা বলা হচ্ছে, তার প্রকৃত অবস্থা কী?

এলডিসি থেকে উত্তরণের সাথে সাথে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্ববাজারে যেসব বাণিজ্যসুবিধা ভোগ করছে তা হারাবে। প্রশ্ন উঠেছে, রফতানিকারকরা কি বাণিজ্যসুবিধা ছাড়া ব্যবসায় চালিয়ে যেতে পারবেন? বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক (৭.৯ শতাংশ)। স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে (৬৭ শতাংশ) শুল্ক ছাড়ের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এককভাবে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী। ইউরোপীয় দেশগুলো বিক্রয়ের ওপর ১২ শতাংশ অগ্রাধিকারমূলক মার্জিন পায়, যা একটি উল্লেখযোগ্য মূল্যসুবিধা। ডব্লিউটিওর এক সমীক্ষামতে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বাংলাদেশের রফতানিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ রফতানির ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ হারাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে (ডেইলি স্টার ২৯ জুন, ২০২৪)। অর্থাৎ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধা কমবে। আমাদের পণ্যমূল্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। এসময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের শুল্ক দিতে হবে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। আর প্রতিবেশী ভারতে রফতানিতে সবচেয়ে বেশি হারে শুল্ক অর্থাৎ ২২ দশমিক ৭ শতাংশ দিতে হবে ।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা, এডিবি এবং অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় দাতাদের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে রেয়াতযোগ্য ঋণ এবং অনুদানের প্রবেশাধিকার কমবে যা দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ও সুদের হার বাড়াবে। দাতারা অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশকে অগ্রাধিকার দেবে বলে অফিসিয়াল উন্নয়নসহায়তা সম্ভাব্যতা হ্রাস পাবে। অগ্রাধিকারমূলক বাজারে প্রবেশাধিকার হারানো যা বাংলাদেশী পণ্যগুলোকে আরো ব্যয়বহুল ও আন্তর্জাতিক বাজারে কম প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সমঝোতা বা দরকষাকষি আরো চ্যালেঞ্জিং হবে। শিক্ষা ও গবেষণা কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন কমবে। এমনকি জার্নাল ও পাবলিকেশনে বাংলাদেশীদের খরচ বাড়বে। শিক্ষার্থীরা স্কলারশিপ ও শিক্ষাগত সহায়তা পাওয়ার সুযোগ হারাবে। হ্রাসকৃত কৃষিপ্রযুক্তি এবং মেধাস্বত্ব সহায়তা, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আর্থিক সহায়তা কমার আশঙ্কা আছে। অ্যান্টিডাম্পিং না থাকলেও এলডিসি থেকে উত্তরণের পরে পাট ও কৃষিপণ্য রফতানিতে প্রতিবেশী ভারতে শুল্ক দিতে হতে পারে ২২ দশমিক ৭ শতাংশ।

কঠোর পেটেন্ট আইন জেনেরিক ওষুধের উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে দেশে স্বাস্থ্যসেবার খরচ আরো বাড়বে। ওষুধ ও ফার্মাসিউটিক্যালের রফতানি বাজারমূল্য প্রতিযোগিতায় পড়বে। অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে রেয়াতযোগ্য তহবিল কমবে, বিদেশী ঋণের সুদ বেড়ে উন্নয়নের গতি প্রভাবিত করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন তহবিল এবং এলডিসির জন্য বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয় এমন পরিবেশগত অনুদান প্রাপ্তি কমবে।

সামাজিক সুরক্ষা ও দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচিতে আরো কম আন্তর্জাতিক সহায়তা আসবে। আইএলও ও জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জাতীয় আয়ের ০.০১ শতাংশ হারে বার্ষিক চাঁদা পরিশোধ করতে হবে। একইভাবে প্রযুক্তিসহায়তা সংকোচন, রফতানি আয় ও অনুদান হ্রাস এবং খরচ বেড়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ বিস্তৃত হবে। এসব কারণে বাংলাদেশকে বেশি করে নিজস্ব তহবিল নিশ্চিত করতে হবে।

অর্থনীতির নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে সম্প্রতি আরেকটি দুঃসংবাদ প্রকাশ হলো। শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০০৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা। এ অর্থ গত পাঁচ বছরের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। যা দিয়ে ৭৮টি পদ্মা সেতু করা যেত। এ সময়ে প্রতি বছর পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বেসরকারি ১০টি ব্যাংক দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে। বর্তমানে খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮৮ শতাংশই মন্দঋণ। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ প্রায় সাত লাখ কোটি টাকা। বিশাল এ অঙ্ক ১৩টি মেট্রোরেল ও ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের সমান। প্রতি বছর লাখ লাখ তরুণ-তরুণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করছেন। কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় লাখ লাখ বেকারের ভবিষ্যৎ হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে।

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন কিছু সুযোগ অবশ্যই আনবে, তবে তার অধিকাংশ সম্মানসূচক। বিশ্ব জানবে, এ দেশের প্রতি চারজনে একজন দরিদ্র। অর্থাৎ আমাদের সম্মান আগের চেয়ে বাড়বে। কিন্তু ব্যবসায়-বাণিজ্য কমে গিয়ে আর্থিক ক্ষতি হলে এ দেশের সাধারণ মানুষ কথিত সম্মান দিয়ে কী করবে?

সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যে বেহাল দশা তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর লাগতে পারে। এ কারণে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের বিষয়ে খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আবেগ তাড়িত হয়ে তাড়াহুড়া করা যাবে না। বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আঘাত সহ্য করার মতো যথেষ্ট সমর্থ হয়ে উঠেছে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে আরো কয়েক বছর সময় নেয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, সম্মান বাড়ানোর চেয়ে দেশের মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখা বেশি জরুরি।

এলডিসি স্তর থেকে উত্তরণে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহসী ও কার্যকর সংস্কার করতে হবে। এজন্য দেশের মানুষের প্রকৃত আর্থিক সামর্থ্য ও দক্ষতা বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ, প্রতিযোগী দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতার জন্য যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন এবং সেই সাথে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
লেখক : ব্যাংকার


আরো সংবাদ



premium cement
স্কুলে ভর্তির জন্য তিন লাখ ৬ হাজার শিক্ষার্থী নির্বাচিত গণমাধ্যম সংস্কারে সহযোগিতা প্রদানে আগ্রহী ইইউ মহাকাশ অনুসন্ধান শিক্ষায় সহায়তা করবে যুক্তরাষ্ট্র মুগদায় প্রাইভেট কারের ধাক্কায় বৃদ্ধ নিহত পাঁচ বছর পর সীমান্ত বিরোধ নিয়ে আলোচনায় বসছে চীন-ভারত এবছরও গুচ্ছে থাকছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মেট্রোরেলে একক যাত্রায় বিকল্প হিসেবে কিউআর কোডের ব্যবস্থা পর্নো তারকাকে ঘুসের মামলায় অব্যাহতি পেলেন না ট্রাম্প বঙ্গভবনে হারানো মোবাইল ফোন ফিরে পেলেন মির্জা আব্বাস দুবাইয়ে খুন : ৪৪ দিন পর ফিরল ব্যবসায়ীর লাশ রামগড় সীমান্তে ভারতে অনুপ্রবেশকালে আটক ১২ বাংলাদেশী

সকল