১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২ পৌষ ১৪৩০, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সিরিয়া বিপ্লব ও নতুন বাস্তবতা

-

সিরিয়ায় বিপ্লবীদের কর্মযজ্ঞ দেখে মনে হলো- ওরা ১৩ বছর ধরে সশস্ত্র যুদ্ধ করলেও বিজয় অর্জনের পুরো স্পিরিট নিয়েছে বাংলা যুবাদের কাছ থেকে। স্বঘোষিত জনপ্রিয় জগদ্দল পাথরের তারা যেভাবে মূলোৎপাটন করছে তা চোখ জুড়ানোর মতো। এই মুক্তির আনন্দ সিরিয়া আরব ভূখণ্ডের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করেছে। তবে সাথে সাথে উৎকণ্ঠাও প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন কারণে। আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধ শেষের ফলে স্বস্তি ফিরলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব সিরিয়ার জনগণকে ভোগাবে নিশ্চিত। দেশ পুনর্গঠনের আগে ঐক্য প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এটি নির্ভর করছে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তিদের বিভিন্ন টানাপড়েন ও হিসাব-নিকাশের ওপর।

এ ক্ষেত্রে সিরিয়ায় মুক্তিকামীদের বিজয়ে ভিন্ন দু’দেশ তুরস্ক ও ইসরাইলের রাষ্ট্রপ্রধানের তাৎক্ষণিক বিবৃতি প্রণিধানযোগ্য; কারণ এই দুই দেশই তাদের নিজ নিজ স্বার্থে যুদ্ধের প্রথম থেকেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বাশার আল-আসাদের পতনকে তাদের জন্য ঐতিহাসিক দিন বলে ঘোষণা করছে। এর কারণ ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি ছিল ইরানের সেনা বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ও ইরানের মদদপুষ্ট শিয়া বাশার রেজিম। আবার ইরানের সাথে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের ক্ষমতা ও স্বার্থ রক্ষা এবং আমেরিকাকে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে চ্যালেঞ্জ জানাতে রাশিয়াও বাশারকে টিকিয়ে রাখতে উপস্থিত ছিল। এখন বাশারের পতনের ফলে কার্যত সিরিয়ায় রাশিয়া ও ইরানেরও পরাজয় নিশ্চিত হলো। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ইরান-রাশিয়া জোটের হুমকি থেকে নিস্তারের খুশির বার্তা তাদের জনগণকে দিতেই পারে। কিন্তু বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর তাৎক্ষণিক এই ভিডিওবার্তা বিশ্বব্যাপী ইরান সমর্থকদের কিছুটা অপ্রস্তুতও করে দিয়েছে এ জন্য যে, বাশারের পতনের ফলে যদি ইরান ও রাশিয়ার সেখান থেকে বিদায় নিতে হয়, তবে আপাতত ইসরাইলের ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস ফেলার মতো কেউ থাকল না। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে শেখ-সুলতানরা তাদের পারিবারিক ও রাজবংশীয় শাসনকে সংহত রাখতে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলের বিপক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেবে না বা নেয়ার শক্তিও নেই। আর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আমেরিকার উপস্থিতি ও সেনাঘাঁটিগুলো ইসরাইলকে রক্ষার নিশ্চয়তা অব্যাহত রাখবে।

এ দিকে তুরস্কে দীর্ঘ দিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন প্রেসিডেন্ট এরদোগানের তাৎক্ষণিক বিবৃতিও সিরিয়া প্রসঙ্গে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি সিরিয়াকে নতুন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বাস্তবতার সাথে তুলনা করছেন। এরদোগান সিরিয়ার জনগণ ও বিশ্ব পরিমণ্ডলকে সিরিয়াকে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও ধর্মের সমন্বিত নতুনরূপে আবির্ভূত হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। তিনি যদিও সবার সমন্বয়ে নতুন সিরিয়া নির্মাণের আশার বাণী শুনিয়েছেন; কিন্তু তুরস্কের আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটে এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়াও সমর্থন করবেন না বলে দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করছেন তার বিবৃতিতে। তার বক্তব্যে এটি স্পষ্ট যে, সিরিয়ার আপাত বাশার আল-আসাদ ও তার মিত্রদের সাথে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ শেষ হলেও তুর্কি সেনাদের উপস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণ তৎপরতা সহসা শেষ হবে না। কারণ সিরিয়ার স্থিতিশীলতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ওপর তুরস্কের আঞ্চলিক শক্তিমত্তা ও নিরাপত্তা বহুলাংশে নির্ভর করে।

তুরস্কে অবস্থানরত প্রায় তিন মিলিয়নের অধিক সিরিয়ান অধিবাসীকে নিরাপদে দেশে পাঠানো ও তুরস্কের নিজের ভূখণ্ডের অখণ্ডতাও জড়িয়ে আছে সিরিয়ার আগামী দিনের অবস্থার সাথে। কারণ ইসরাইলের অপতৎপরতা এবং কুর্দিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা তুরস্কের বড় মাথাব্যথা। সুতরাং তুরস্কের অখণ্ডতার স্বার্থেই এরদোগান স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিরিয়ার অখণ্ডতা রক্ষায় সবধরনের সহায়তা ও সেনা উপস্থিতি চালিয়ে যাবে বলেই মনে হয়। এর কারণ সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চল কুর্দি যোদ্ধারা যদি দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, সে ক্ষেত্রে তুরস্কের কুর্দি অঞ্চলও তাদের সাথে যোগ দেবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সুতরাং তুরস্কের স্বার্থে সিরিয়ার সব মতাদর্শের সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের মাধ্যমে নতুন ও অখণ্ড সিরিয়া নির্মাণে এরদোগানের সহায়তা করার বিকল্প নেই।

ওদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাশার আল-আসাদের বিচার দাবি করলেও নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ার ঘটনাকে নিজেদের সমস্যা এবং মার্কিনিরা সেখানে কোনো ধরনের সময় ও সামর্থ্য ব্যয় করতে চায় না বলে টুইট করেছেন। কার্যত ট্রাম্পের আগের আমলের মতোই দৃষ্টিভঙ্গি, যা তিনি নির্বাচনী প্রচারণাতেও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ট্রাম্প দায়িত্বভার নেয়ার পর যদি সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে তার দৃষ্টিভঙ্গি এমনই থাকে, তবে সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে? এ ক্ষেত্রে কতগুলো হিসাব কষতে হবে। যেমন- বিশ্বব্যাপী আদর্শবাদী রাজনীতির যে ধারা শুরু হয়েছে তা ব্যাপক প্রসার লাভ করতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে। ধারণা করা হচ্ছে, অন্তত সিরিয়া ও মিসরে আমেরিকা ও রাশিয়ার মুখোমুখি যুদ্ধাবস্থা এবং একে অপরকে মোকাবেলা করার পরিস্থিতি যদি না থাকে, সে ক্ষেত্রে ইসলামী মতাদর্শীরা উপকৃত হবে সবচেয়ে বেশি। কারণ এমনিতেই সেটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ইসলামী আদর্শিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের আবাসভূমি।

অন্য দিকে আঞ্চলিক পরাশক্তি ও ব্রাদারহুডের আদর্শে অনুপ্রাণিত তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানও চাইবেন সিরিয়া ও মিসরে তাদের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ক্ষমতায় আসীন হোক। সে ক্ষেত্রে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং এরদোগানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে অন্যান্য ইসলামিক গ্রুপ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারা। কারণ প্রত্যেকের উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরাচারমুক্ত সিরিয়া এবং এ জন্য ক্রিয়াশীল সব ইসলামী ও প্রগতিশীল মতাদর্শ একযোগে ১৩ বছর লড়াই করেছে। সুতরাং সেখানে এককভাবে কোনো সরকার গঠন বা ইসলামী শরিয়াহ অথবা ইসলামী ভাবাদর্শের রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণ সম্ভব হবে কি না তা এখনি বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে এরদোগান লিবিয়ায় গঠিত সরকার কাঠামোর প্রস্তাব করতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে ঝানু রাজনীতিক এরদোগান সেটিই করবেন বলে মনে হচ্ছে যেটি তিনি করেছিলেন লিবিয়ার ক্ষেত্রেও। সে ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি এড়ানোও সম্ভব হবে। কারণ এককভাবে তুর্কি ও ব্রাদারহুড সমর্থিত গ্রুপ যদি সরকার গঠন করতে চায়, তাহলে সহসা যুদ্ধ থামবে বলে মনে হয় না। অন্যান্য গ্রুপের যেমন দাবি ও স্বার্থ থাকবে তেমনি জায়নবাদী ইসরাইল চাইবে না এমন কেউ ক্ষমতার মসনদে বসুক যারা ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে ইসরাইল নতুন করে মিসরের স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট সিসি ও সৌদি আরবের সাথে যোগাযোগ দৃঢ় করতে পারে। কারণ এই দুই গ্রুপের স্বার্থ কিন্তু স্পষ্ট। সৌদি আরব রাজবংশের এবং সিসি তার স্বৈরাচারী শাসন অব্যাহত রাখতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করে মুসলিম ব্রাদারহুডকে। অন্যদিকে ইসরাইল শিয়া ইরান এবং তাদের মিত্র হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিদেরকে শত্রু মনে করলেও মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের সার্বভৌমত্ব ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হবে। এর মূল কারণ হলো, সিরিয়া মুক্ত হওয়ার ফলে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড খুব দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠবে এটি স্পষ্ট। আর এ জন্য সবচেয়ে বেশি সাহায্য পাবে তুরস্কের জনগণ ও সরাসরি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কাছে থেকে। সুতরাং যদি দু’চার বছরের মধ্যে মিসরে আবারো মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসে সে ক্ষেত্রে গাজাসহ ফিলিস্তিন ইস্যু নতুন মাত্রা পাবে।

তাই বলা যায়, সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরসহ আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের অবসানের ফলে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেলেও আমাদের মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন নতুন গতি পাবে। শেখ শাসকদের ঘুম একটু হলেও বিঘ্নিত হবে। ইহুদিবাদী ইসরাইলের নতুন মাথাব্যথার কারণ হবে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী যারা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে এবং তুর্কিপন্থী সেনা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের যুবারা। মিসরের স্বৈরাচারের নিশ্চিত রাত জাগার কারণ হবে সিরিয়ায় বাশারের পতন। মিসরের ইখওয়ান বা ব্রাদারহুড নতুন করে জাগ্রত হবে। এ ক্ষেত্রে এরদোগানের পুরো সাপোর্ট পেতে পারে তারা। গাজায় একটু হলেও স্বস্তি আসবে। প্যালেস্টাইনের বন্ধুদের ফেবু স্ট্যাটাস ও তুরস্কে থাকা সিরিয়ান ও ফিলিস্তিনিদের উদযাপন দেখে মনে হয়েছে তারা আশান্বিত। আর এটিই হবে ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ। এ জন্য ইরান-রাশিয়া এবং বাশার আল-আসাদের পতন হলেও ইহুদি রাষ্ট্রের খুশি হওয়ার খুব বেশি যৌক্তিক কারণ নেই।

বিশ্বব্যাপী মহামারীর পর দেশে দেশে অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় মনে হয়েছিল বিশ্বরাজনীতিতে নতুন ব্যবস্থার সূচনা হবে, যা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বিত রূপের নতুন কাঠামো। আদর্শবাদী আন্দোলন কিছুটা জনপ্রিয়তা পেলেও বিশ্বব্যাপী তরুণদের কাছে মুক্ত স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, নারী অধিকার ও রাজনীতিতে স্বচ্ছতা বিপুল জনপ্রিয়তা পেতে পারছে। প্রযুক্তি ও তথ্যের অবাধ প্রবাহে যুবকরা সেলফ লার্নিংয়ের মাধ্যমে প্রস্তুত হতে পারছে নিজ দেশ ও বিশ্বের গতিপথ পাল্টে দিয়ে নীতিনির্ধারক হতে। চাপিয়ে দেয়া কোনো বন্দোবস্ত তারা আগামীতেও মেনে নেবে বলে মনে হয় না। ধর্মীয়, আদর্শিক, গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদের সমন্বয়ে নতুন কাঠামো দাঁড় করাতে চাইছে তারা। যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে তথ্যপ্রবাহ ও উন্মুক্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। অর্থনৈতিক ও স্বাধীন ব্যক্তি জীবনের নিশ্চয়তা। জীবন ও কর্মের নিরাপত্তা। রাষ্ট্রের অর্থ ও সম্পদ ব্যবহারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এ জন্য শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ায় স্বৈরাচারীদের পতনের ফলে বিশ্ব যুব নাগরিক সমাজের মানসপট নতুন বার্তা দিচ্ছে। হোক বাংলাদেশ বা সিরিয়া অথবা অন্য কোনো দেশ, নাগরিক আকাক্সক্ষাকে উপেক্ষা করে জোরপূর্বক শাসন চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। এটি অগণতান্ত্রিক চর্চাকে কঠিন বাস্তবতার মুখে ঠেলে দিতে পারে। এ জন্য মধ্যপ্রাচ্য অথবা দূরপ্রাচ্যের যেকোনো জাতির যুবসমাজের প্রত্যাশা, নাগরিক অধিকার, জীবন ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ছাড়া কামানের গোলা বা বন্দুকের গুলি দিয়ে শাসন টিকিয়ে রাখা আদৌ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, গাজী ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক


আরো সংবাদ



premium cement