১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ভারতীয় চলচ্চিত্রে বাংলাদেশকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন!

ভারতীয় চলচ্চিত্রে বাংলাদেশকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয় - প্রতীকী ছবি

১.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক বাস্তবতার সঠিক চিত্রায়ন ভারতীয় চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক মঞ্চে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে। বিশেষত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, সীমান্ত সমস্যা ও বাংলাদেশী চরিত্রগুলো অনেক ভারতীয় চলচ্চিত্রে ভুল বা অতিরঞ্জিতভাবে চিত্রিত হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নির্মিত গল্পগুলোতে সে দেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকা অত্যধিক এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান প্রায় উপেক্ষিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি অবিচার।

বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ যুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং জাতির পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু ভারতের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের এ চিত্রায়ন প্রায়ই ভুল, অতিরঞ্জিত ও অসম্পূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ ‘গুন্ডে’ (২০১৪) সিনেমাটি, যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র নিয়ামক শক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমাটির গল্পে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল চরিত্র, বাংলাদেশীদের সংগ্রাম এবং তাদের আত্মত্যাগ প্রায় উপেক্ষা করা হয়েছে। ভারতীয় সেনাদের অবদানকে অতিরিক্তভাবে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এতে সিনেমার পটভূমি বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ পায়, যা দুই দেশের জনগণের মধ্যে ভুল ধারণা এবং পারস্পরিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলায় ভূমিকা রাখছে।

তেমনি ‘১৯৭১’ (২০০৭) সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়নি। সিনেমাটির মূল কাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান ঘিরে নির্মিত, যেখানে বাংলাদেশের সংগ্রামকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অথবা সামাজিক দিকও সিনেমায় প্রকাশিত হয়নি, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের সাথে একেবারে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

২.
বাংলাদেশের সীমান্ত সমস্যা ও অভিবাসন সম্পর্কিত চিত্রায়নও ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রায়ই বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়। ‘গঙ্গাজল’ (২০০৩) সিনেমায় বাংলাদেশী অভিবাসীদের অপরাধী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, এ চলচ্চিত্রে তাদের ভারতে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ ধরনের উপস্থাপনা শুধু বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি ভুল ধারণা তৈরি করে না; বরং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সীমান্ত সমস্যা আরো জটিল করে তোলে। এমনকি ‘এক থা টাইগার’ (২০১২) সিনেমায় বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যা আসলে বাস্তবতাবিবর্জিত। এটি বাংলাদেশীদের প্রতি চরম অবিচার।

বাংলাদেশ থেকে ভারতে অভিবাসন সম্পর্কিত সঠিক তথ্য ও বাস্তবতার অভাব ভারতীয় চলচ্চিত্রে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এ ধরনের সিনেমার মাধ্যমে শুধু ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়, ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যেও বাংলাদেশের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম নেয়, যা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর গভীরভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৩.
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সমাজের অবস্থা ভারতীয় চলচ্চিত্রে হরহামেশা ভুলভাবে চিত্রিত হচ্ছে। ‘টিগার জিন্দা হ্যায়’ (২০১৭) সিনেমায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল ও দুর্বল হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেখানে মূলত বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং বর্তমান পরিস্থিতি উপেক্ষা করা হয়েছে। এ ধরনের উপস্থাপনা শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার বিকৃতি নয়; বরং দেশটির মানুসের প্রতি অসম্মানও প্রকাশ করে। রাজনৈতিক অস্থিরতার অনেক কারণ, যেমন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, দুর্নীতি এবং অন্য সমস্যা, সেখানে ভারতে কূটকৌশলে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা পুরোপুরি বাস্তবতার বিপরীত।

বাংলাদেশের নিজস্ব চলচ্চিত্র শিল্প কিছু ক্ষেত্রে এ ভুল চিত্রায়নের প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং ইতিহাসের সঠিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। ‘ওরা এগারো জন’ (১৯৭২) ও ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪) মুক্তিযুদ্ধের চিত্রায়ন করেছে, যা ভারতের চলচ্চিত্রের তুলনায় অনেক বেশি সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য। বিশেষ করে ‘ওরা এগারো জন’ সিনেমা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি ঐতিহাসিক সময়কে তুলে ধরেছে, যেখানে সঠিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঠিক চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন, যদিও আন্তর্জাতিক স্তরে তার সঠিক প্রশংসা এখনো হয়নি।

৪.
ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের উচিত বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঠিক চিত্রায়ন করা, যাতে ভুল ধারণা এবং সাংস্কৃতিক বিভেদ দূর করা যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সীমান্ত সমস্যা এবং অভিবাসন বিষয়ে নির্মিত সিনেমাগুলো যদি সঠিক ইতিহাস ও বাস্তবতা তুলে ধরে, তাহলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন তৈরি হবে। ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের উচিত রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা, যাতে আন্তর্জাতিক স্তরে দুই দেশের ভাবমর্যাদা ইতিবাচক হয়।

ভারতীয় চলচ্চিত্রে বাংলাদেশকে ভুলভাবে চিত্রিত করা শুধু দু’টি দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না; বরং এটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতেও এক নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। সঠিক ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং বাস্তবতার প্রতি অবিচল থাকাটা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দায়িত্ব। এটি শুধু দুই দেশের জনগণের মধ্যে ভুল ধারণা দূর করতে সহায়তা করবে না; বরং আরো গভীর ও ইতিবাচক সম্পর্কের পথও প্রশস্ত করবে।

লেখক : কবি ও সভাপতি, প্যারিসের জানালা


আরো সংবাদ



premium cement