জনআকাঙ্ক্ষা ও সরকারের পথচলা
- মো: মাঈন উদ্দীন
- ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:৩১
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী জনগণের যে চাওয়া-পাওয়া তা নিয়ে প্রতিদিনই হিসাব-নিকাশ চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা রকম পদক্ষেপ নেয়ার পরও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি বরং বেড়েই চলেছে। এতে সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষ। সাধারণ মানুষ বোঝে না অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি কখন কিভাবে ঠিক হবে। তারা বোঝে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কত কম দামে সহজে পাওয়া যাবে। পতিত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তের দুঃখকষ্টের শেষ ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর স্বাভাবিকভাবে জনগণের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। কিন্তু সব আশা ও প্রত্যাশা এ সরকার পূরণ করতে পারবে তা আশা করা যেমন ঠিক নয়, আবার কিছু প্রয়োজনীয় চাওয়া-পাওয়ার প্রতি সরকারের উদাসীনতাও অগ্রহণযোগ্য। তাই সরকারকে জনগণের ভাষা, তাদের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বেকারত্ব নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, ব্যবসায় বাণিজ্যে গতি ফিরিয়ে আনাসহ আমদানি-রফতানিকে স্বাভাবিক করার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাতে বলা যায়, নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির যে চিত্র তা খুবই উদ্বেগজনক। খবর অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবার ১৪ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। গত নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। এর পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে। তিন মাস পরই পবিত্র মাহে রমজান। রমজান সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের দাম যাতে কোনোভাবেই না বাড়ে, সরকারকে আগে থেকেই তার জন্য বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে বাস্তবতা কঠিন। ভোগ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়লেও মানুষের আয় বাড়ছে না। অর্থনীতিতেও চলছে স্থবিরতা। পণ্য আমদানিও কমছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তারা চাহিদার চেয়ে কম খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছেন অথবা সংসারের অন্যান্য খাতে ব্যয় কমিয়ে খাবার কিনছেন।
কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রমজান সামনে রেখে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছে। সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে আট টাকা বাড়ছে। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন থেকে বিক্রি হবে ১৭৫ টাকায়, যা এত দিন ছিল ১৬৭ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৫৭ টাকা। খোলা পাম তেলের লিটারও ১৪৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৬০ টাকা, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা। এর আগে বাজার থেকে বোতলজাত সয়াবিন উধাও হয়ে যায়।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়মিত বাজার তদারকির পাশাপাশি বিকল্প উপায় পণ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ দিকে দেশে বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে। বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। বিবিএস তথ্য মতে, বর্তমানে বেকারের হার ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের গড় বেকারের হারের চেয়ে কিছুটা বেশি। ২০২৩ সালের গড় বেকারের হার ছিল ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিগত সরকারের আমলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে বহু শিক্ষিত যুবক বেকার হয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন যা কোটা আন্দোলন থেকে শুরু হয়েছিল তার অন্যতম কারণ যুবসমাজের মধ্যে বড় একটি অংশ বেকারত্বের অভিশাপে নিমজ্জিত থাকা। স্বৈরাচারী সরকার সর্বত্র বৈষম্য সৃষ্টি করে মেধাবীদের গুরুত্ব দেয়নি; যে কারণে বহু মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তো পতিত সরকার প্রায় শেষ করে দিয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে এখন শিক্ষার্থীরা পড়তে যায় না। আড্ডাবাজি করে দিন কাটায়। অন্তর্বর্তী সরকারকে শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার করে দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করতে হবে।
ব্যবসায় বাণিজ্যেও এখনো গতি ফেরেনি। ফলে বাজেট বাস্তবায়নে সমস্যা হতে পারে। প্রয়োজনীয় এলসি করতেও ব্যবসায়ীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের মুনাফার হার নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যদিও ব্যাংকে টাকা রাখা নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই, তবু গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক এখনো পুরো কাটেনি। ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বাড়াতে হবে। ব্যাংকে টাকা জমা ও অর্থের হাতবদল বাড়াতে হবে। অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য সামাজিক আন্দোলন ও এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগ দ্রুত ও যথাযথ হতে হবে। জনগণ চায় অর্থ লোপাটকারীদের উপযুক্ত সাজা হোক। বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরে আসুক।
শহরে চলাচল নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে যানজট নিরসনে বিকল্প ও সৃজনশীল পথেই অগ্রসর হতে হবে। যানজট নিরসনে অবিলম্বে প্রাইভেট কারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, চৌরাস্তাগুলোয় টানেল নির্মাণ, ছোট ছোট বিকল্প রাস্তা তৈরি করা, ফুটপাথ দখলমুক্ত করা ও ট্রাফিক পুলিশের জনবল বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যানজটের কারণে অনেক শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়; যা দেশের উন্নয়নের জন্য হুমকি। বিশেষ করে ঢাকা শহরে ক্রমবর্ধমান জনস্রোত কিভাবে ঠেকানো যায়, সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে গরিব ও মধ্যবিত্তের সেবার মান বাড়াতে হবে। জনগণ চায় তার সন্তান শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে সৎভাবে আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। শিক্ষার মানোন্নয়ন করে ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে জনগণের সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব না হলেও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি দরকার। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও চোরাচালান, অবৈধ ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে। সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ ও সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধ করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হবে। জনগণ স্থানীয় অনেক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজনৈতিক সরকার আসার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে জনগণের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য ও স্থানীয় ইউনিটগুলো কার্যকর থাকবে। সরকারের সিস্টেম লস কমবে।
পরিশেষে বলতে চাই, আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। শুধু ব্যবসায়ীদের নয়, জনগণের সুবিধার প্রতিও সরকারের নজর থাকা চাই।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
ই-মেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা