১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্য

- ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক শক্তিশালী হলে তা ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অর্থনৈতিক প্রভাব ও বাণিজ্য সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে পাকিস্তানের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দিক পরিবর্তন করতে পারে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই সীমিত ছিল। এর পেছনে ছিল ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বাধা। তবে, গত কয়েক বছরে বাণিজ্য কিছুটা বেড়েছে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি এবং বাংলাদেশের কিছু পণ্য পাকিস্তানে রফতানির মাধ্যমে। বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আমদানি করে কাঠ, পাট, পশুখাদ্য, সিরামিকস, খাদ্যপণ্য ইত্যাদি। আর পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে টেক্সটাইল, মুদ্রিত কাপড় এবং খাদ্যপণ্য।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করা গেলে, এটি উভয় দেশের জন্য অনেক নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। বিশেষ কিছু খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্য বৃদ্ধি সম্ভব। পণ্যের রফতানি এবং আমদানির সুবিধায় ভৌগোলিক অবস্থানও সাহায্য করতে পারে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম টেক্সটাইল রফতানিকারক দেশ এবং পাকিস্তানও এই খাতে শক্তিশালী। উভয় দেশের মধ্যে টেক্সটাইল পণ্যের ব্যবসায়িক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে একে অপরের বাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। উভয় দেশই তুলা উৎপাদনে সক্ষম এবং এতে সহযোগিতা করতে পারে, যেমন একে অপরের জন্য প্রাথমিক কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারে।

পাকিস্তানের বস্ত্রশিল্প বাংলাদেশের জন্য পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করতে পারে এবং বাংলাদেশ পাকিস্তানের জন্য ইউরোপীয় ও আমেরিকান বাজারে প্রবেশের সুযোগ করে দিতে পারে।

বাংলাদেশ সিরামিক শিল্পের ক্ষেত্রে শক্তিশালী এবং পাকিস্তানও এই খাতে একাধিক ভালো মানের পণ্য তৈরি করে। উভয় দেশের মধ্যে সিরামিক পণ্য যেমন স্যানিটারি ও নির্মাণসামগ্রী, ওয়ালপেপার এবং অন্যান্য পণ্য আদান-প্রদান করা যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা বা অন্যান্য উন্নয়নশীল বাজারে প্রবেশের জন্য দুই দেশ একত্রে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান উভয়েই খাদ্য উৎপাদনে শক্তিশালী, বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, মসলা এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্য। বাংলাদেশের শাকসবজি এবং ফলমূল পাকিস্তানে রফতানি করা যেতে পারে এবং পাকিস্তান থেকে চাল, মসলা, খেজুর ইত্যাদি বাংলাদেশে আসতে পারে। উভয় দেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, যেমন কনফেকশনারি, বিস্কুট, এবং ডেইরি পণ্য একে অপরের বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করতে পারে।

দুই দেশ যদি একে অন্যের জন্য যান্ত্রিক সরঞ্জাম এবং নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করে, তবে উভয় দেশের শিল্প খাত আরও শক্তিশালী হতে পারে। উভয় দেশ শক্তি উৎপাদন এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির খাতে সহযোগিতা বাড়াতে পারে, যা কেবল নিজেদের জন্যই নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার জন্য উপকারী হতে পারে। উভয় দেশই প্রযুক্তি খাতে উদ্ভাবনী সমাধান তৈরি করতে পারে এবং একে অপরের সাথে এই সমাধান শেয়ার করতে পারে, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি এবং ডিজিটাল ব্যবসার ক্ষেত্রে।

ভারতের নেতিবাচক নীতির কারণে পাকিস্তান-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্ক কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি ভারত। দেশটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিকাশে অন্তরায়। ভারত মাঝে মাঝে শুল্ক বিধি এবং বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য চালু রাখা কঠিন করে তোলে। ভারত চাইবে না যে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ একটি আঞ্চলিক বাণিজ্যিক জোট গঠন করুক।

ভারত যদি দেখতে পায়, পাকিস্তানের মাধ্যমে বাংলাদেশ পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করতে শুরু করছে, তাহলে সে ওই অঞ্চলে নিজের প্রভাব ধরে রাখতে আরও কঠোর কৌশল গ্রহণ করতে পারে।

পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হলে ভারত সেটিকে তার নিরাপত্তা ক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টির সম্ভাব্য কারণ বলে মনে করতে পারে এবং ভারত এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। এর ফলে, পাকিস্তান-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক এক ধরনের রাজনৈতিক ক্ষতি বা সীমাবদ্ধতার মধ্যে পড়ে যেতে পারে। ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক চুক্তি বা বাণিজ্যিক প্যাকেজে বিরোধিতা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের পক্ষ থেকে যে কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি যা পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সম্পর্ককে গভীর করবে, তার বিরুদ্ধে একাধিক নীতিগত প্রতিবাদ দেখা যেতে পারে। ফলে, দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

এখনকার পরিস্থিতিতে, উভয় দেশ যদি তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও স্থিতিশীল করে এবং বাণিজ্যিক চুক্তির মাধ্যমে সহযোগিতা বাড়ায়, তবে বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান একে অপরের জন্য শুল্ক সুবিধা বা প্রণোদনা প্রদান করে, তাদের বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ পেতে পারে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একে অপরের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করতে পারে, যেখানে তারা একে অপরকে শুল্ক সুবিধা ও বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করতে পারে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একে অপরের জন্য লজিস্টিক সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারে, যেমন উন্নত পরিবহনব্যবস্থা, ট্রানজিট সুবিধা এবং উভয় দেশের বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবসা সহজতর করা।

পাকিস্তানের মাধ্যমে বাংলাদেশের পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করার সুযোগ বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে, তাহলে ভারতের বাণিজ্যিক আধিপত্য কমে আসবে। পাকিস্তান বাংলাদেশের জন্য নতুন বিকল্প বাজার হতে পারে, যা ভারতীয় পণ্যের বাজারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।

পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্কের ফলে চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়তে পারে, বিশেষত চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর হওয়ার কারণে।

চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (ঈচঊঈ) বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে, যার ফলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক পথ উন্মুক্ত হবে। ঈচঊঈ-এর অংশ হলে বাংলাদেশ চীনের বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নের সুবিধা নিতে পারবে।

চীন, পাকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে বাংলাদেশের জন্য এটি নতুন সুযোগ তৈরি করবে। চীনের সাথে জ্বালানি ও প্রযুক্তি সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হতে পারে।

বাংলাদেশকে তার বাণিজ্যিক কৌশল ভারসাম্যপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে সে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে মিশ্র সম্পর্ক রাখতে পারে। বাংলাদেশকে অবশ্যই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে।

লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি,
নর্থ-সাউথ ইউ নিভার্সিটি
ব-সধরষ: সধৎধংযরফ৪২৬@মসধরষ.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement