মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও হাসিনার বিচার
- সুরঞ্জন ঘোষ
- ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:০৯
কবি রফিক আজাদের ‘নত হও, কুর্নিশ করো’ শিরোনামের কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি, ‘হে আমার অবাধ্য কলম, ক্রোধ সংবরণ করো,/ ভদ্রলোকের মতো লেখো, ভদ্রলোকদের দ্বারে ধর্না দিও-/শিখে নাও সাজানো-গোছানো প্রভুপ্রিয় বাক্যাবলি/হে কলম, এইবার নত হও, নতজানু হও।’ গত এক দশকের বেশি সময় বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে মতপ্রকাশের জন্য যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেছে নিয়েছিলেন সেই ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি রাষ্ট্র, সরকার এবং রাষ্ট্রবহির্ভূত কিছু শক্তি এই বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিল- ‘নতজানু হও’।
রফিক আজাদের এ কবিতার মর্মবাণী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা উপলব্ধি করতে পারেননি, তাদেরকে দিতে হয়েছে চড়া মাশুল। কথা বলার ওপরে এসব বাধা কেবল লিখিত বিষয়ে সীমিত থাকেনি, রাষ্ট্র এমন সব প্রযুক্তি সংগ্রহ করেছে, যার নজরদারির ক্ষমতা সীমাহীন। আড়িপাতার আইনি ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে সংগৃহীত হয়েছে নাগরিকের কথোপকথন, সেগুলো আবার ফাঁস করা হয়েছে সরকার সমর্থক গণমাধ্যমে। এমন ভীতির আবহাওয়া তৈরি করা হয়েছিল যাতে কথা বলা ছিল এক প্রাণঘাতী কাজ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে, যখন আইনি এবং আইনিপ্রক্রিয়ার বাইরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হচ্ছে, ততক্ষণ সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি। সাধারণ নাগরিকরা ব্যক্তি হিসেবে তাদের মতামত প্রকাশে রাষ্ট্রের কাছে ‘বিপজ্জনক’ বলে প্রতীয়মান হননি। কিন্তু ভীতিকর অবস্থার অবতারণা হয় দুটি আইন এবং তার প্রয়োগে। ২০১৩ সালে এর সূচনা হয় ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট ২০০৬-এর সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এবং তা এক সর্বগ্রাসী রূপ নেয় ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে।
২০১৬ সালে আইসিটি আইন নিয়ে তীব্র বিতর্কের সূচনা হয়। সে সময় পর্যন্ত ৯৪ শতাংশ মামলা হয়েছে বিতর্কিত ৫৭ ধারায়। ‘আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৬৬ শতাংশ মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছেন। আর তদন্ত পর্যায়ে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে ১৩ শতাংশ মামলা। পুলিশ সেগুলোর বিষয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।’ তদন্তে ঘটনার সত্যতা না পেয়ে গত ২০১৩-২০১৬ এ তিন বছরে ৪৬টি মামলায় পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এ আইনের ব্যবহারের ব্যাপকতা কেবল লক্ষ করার বিষয় নয়, তা আমাদের জন্য সমপরিমাণে গুরুত্বপূর্ণ এ জন্যে যে, এ ধরনের আইনের অপ্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া মানুষের মধ্যে এমন ভীতি তৈরি করতে সক্ষম হয় যে, যে কেউ যেকোনো সময়ে এর শিকার হতে পারেন।
এ ভীতি ২০১৮ সালের অক্টোবরের পরে এসে ভয়াবহ রূপ নেয়। নির্বাচনের মুখে সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাস করে এ যুক্তিতে যে, তা সাইবার স্পেসে নাগরিকদের নিরাপত্তা বাড়াবে, বিভিন্ন ধরনের হয়রানি থেকে সুরক্ষা করবে। কিন্তু ২০১৮ সালের গোড়ায় এ আইনের খসড়া মন্ত্রি¿সভায় অনুমোদনের সময় প্রশ্ন ওঠে, কার নিরাপত্তায় এ আইন প্রণীত হচ্ছে। আইসিটি আইনের সবচেয়ে আলোচিত এবং ব্যবহৃত ৫৭ ধারার অধীন বিষয়গুলো বাদ না দিয়ে চারটি ভাগে বিভক্ত করে তা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ আইনে এমন অনেক বিষয় অপরাধ বলে গণ্য করা হয় যেগুলো অস্পষ্ট এবং নানাভাবে সেগুলোর ব্যাখ্যা করা যায়।
এ আইন প্রণয়নের সময় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক দিনুশিকা দিশানায়েক স্মরণ করিয়ে দেন যে, এ আইন আন্তর্জাতিক আইন ও মানের সাথে সাংঘর্ষিক। আপত্তি উঠেছিল দেশের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকেও। তারা বলেছিলেন, এ আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১. ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে’। পুরো আইনকে তারা ‘সংবিধানের ৩৯ (২) (ক) ও (খ) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলোর পরিপন্থী’ বলে চিহ্নিত করেন (প্রথম আলো, ২০১৮)।
২০১৩ সালে শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যকার ফোনালাপ ফাঁসের পর থেকে এ ধরনের ফোনালাপ মিডিয়ার প্রকাশের ধারা জোরালো হয়। ওই অডিও টেপ কিভাবে ফাঁস হয়েছিল, সেটি না জানালেও তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এ ধরনের কাজের সমর্থন দেন। এরপরে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কথাবার্তা প্রায়ই ফাঁস হয়েছে। এগুলোর প্রচারে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সহজে বোধগম্য, যদিও তা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে না।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক ও তার স্ত্রীর মধ্যকার কথাবার্তা ফাঁস করার কারণ একই বিবেচনার মধ্যে পড়ে। এ ধরনের আলাপ ফাঁসের তালিকায় এমনকি চাকরিচ্যুত পুলিশ কর্মকর্তাদের কলও বাদ যায়নি। এসব ফোনালাপ ফাঁসে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কেবল যে সামাজিকভাবে হেনস্তা হয়েছেন বা মানহানির শিকার হয়েছেন তা নয়, অন্তত একটি ক্ষেত্রে এতে করে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। মাহমুদুর রহমান মান্না এবং সাদেক হোসেন খোকার মধ্যকার ফোনালাপের সূত্র ধরে মান্নার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়। তিনি দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। ওই মামলা এখনো বহাল।
বাংলাদেশে ফোনে আড়ি পেতে সংগৃহীত অডিও ফাঁসের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইনি বাধা আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে আড়িপাতা নিষিদ্ধ এবং তার জন্য শাস্তির বিধান আছে। এ বিষয়ে আইনটি হচ্ছে ২০০১ সালের বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন। টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেন যে, এ ধরনের আড়িপাতা সম্ভব যে প্রযুক্তি দিয়ে, তার অন্যতম হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল সাবস্ক্রাইবার আইডেনটিটি ক্যাচার (আইএমএসআই ক্যাচার), যা ফোন এবং বেইস স্টেশনের মাঝখানে স্থাপনের মাধ্যমে কথোপকথন রেকর্ড করতে পারে।
বাংলাদেশে ব্যক্তি মালিকানায় এ ধরনের প্রযুক্তি থাকার কোনো খবর কখনো জানা যায়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার এবং গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এ ধরনের প্রযুক্তি আছে এবং তা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ২০১০ সালে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা মন্ত্রী ও সরকারদলীয় কয়েকজন নেতার মুঠোফোনে আড়ি পেতেছিল। ওই সংস্থা এ আড়িপাতা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠালে ‘সরকারের উচ্চপর্যায়ে হইচই পড়ে যায়। পরে খোঁজ নিয়ে সরকার জানতে পারে, আড়িপাতার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানত না। কিভাবে আড়িপাতা হয়েছে, খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোয়েন্দা সংস্থা নিজের মতো করে আড়িপাতার কাজ করেছে।
বাংলাদেশ একটি বিতর্কিত দেশ থেকে প্রযুক্তি কিনেছে বলে অনেক দিন ধরে শোনা যাচ্ছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আল-জাজিরায় প্রচারিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ ইসরাইল থেকে এ প্রযুক্তি কিনেছে। সরকার ইসরাইলের কাছ থেকে কেনার কথা অস্বীকার করলেও, কবুল করে নেয় যে এ প্রযুক্তি কেনা হয়েছে। তবে তা কেনা হয়েছে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী মিশনে ব্যবহারের জন্য। অন্যদিকে জাতিসঙ্ঘ বলে, বহুজাতিক শান্তি মিশনে এ ধরনের প্রযুক্তির দরকার নেই। এ প্রযুক্তি কেনায় দুর্নীতি ঘটেছে কি না, তাও তদন্ত করে দেখতে জাতিসঙ্ঘ হাসিনা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল।
এ প্রেক্ষাপটে ২০২১ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশের কাছে ইসরাইলের আড়িপাতা যন্ত্র বিক্রির বিষয়ে তুমুল আলোচনার সূত্রপাত হয়। ইসরাইলের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ঘোষণা করে, ‘বাংলাদেশী একটি আধা সামরিক অভিজাত বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণে তারা বাংলাদেশের কাছে এ ধরনের পণ্য আর বেচবে না।’ কথা বলা বা ভিন্নমত দমিয়ে দেয়া, বিরোধী কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দেয়া এবং শারীরিকভাবে হেনস্তা করা, কোনো ব্যক্তিকে গুম করা, এমনকি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার ঘটনাবলি বাংলাদেশে বিগত ১৫ বছরে শত শত ঘটেছে।
নোবেলজয়ী ড. মো: ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন দেশ চালাচ্ছেন। এ সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা, উল্লিখিত ফ্যাসিবাদী ভোট ডাকাত হাসিনার বিচার হোক। তাকে দেশে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক। দেশে প্রতিষ্ঠা হোক আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার।
লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক ছাত্রনেতা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা