০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ইসকন, সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয় ঐক্য

- ছবি : সংগৃহীত

৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর পরাজিত ও পতিত স্বৈরাচার নানারূপে ফিরে আসছে আমাদের দেশে। কখনো আনসার, পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি, কখনো শিক্ষক-কর্মচারী, কখনো ফেল করা ছাত্র এবং সবচেয়ে বেশিবার এসেছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে সনাতনী ও ইসকনের রূপে।

বাংলাদেশের স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও তার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ভারতের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল অবিশ্বাস ও বিস্ময়ের। তারা এটি কোনোভাবেই কল্পনা করেনি যে, বাংলাদেশে এভাবে হাসিনা সরকারের পতন হবে এবং তাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। দেড় দশকের কঠিন শাসন তলে তলে এত ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল যে, তা যেমন শেখ হাসিনা বুঝতে অক্ষম ছিলেন, তেমনি ভারতও এটি বুঝলে ওই সরকারের পেছনে এত বিনিয়োগ করত না। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত যখন ভেঙে পাকিস্তান ও ভারত নামে যে দু’টি দেশের সৃষ্টি হলো, ভৌগোলিক কারণেই তা টেকসই বিবেচিত হয়নি।

পরবর্তীতে পাকিস্তানি সেনাশাসকগোষ্ঠীর মাথামোটা বুদ্ধি ও পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতাদের গোঁয়ার্তুমির কারণে তারা এদেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের জনগণ যখন স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন ভারতীয়রা তাদের স্বার্থের কারণে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা করে। ভারতের পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তার মাধ্যমে তারা ভারতের ‘ইস্টার্ন ফ্রন্ট’কে চিরকালের জন্য নিষ্ক্রিয় করবে। সে পরিকল্পনা সফল হওয়ার পর তাদের লোভ বেড়ে যায় এবং আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তার বিনিময়ে আমাদের দেশটিকে তাদের করদরাজ্যে পরিণত করার চেষ্টা শুরু করে ১৯৭২ সাল থেকেই। বহুদিন চেষ্টা করার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য ভারতকেই তার একমাত্র সহায়ক হিসেবে বেছে নেন। শেখ হাসিনা তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার লক্ষ্যে অবৈধভাবে দেশের সংবিধান সংশোধন করে ভোট ছাড়াই সারা জীবন ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা করেন। এ কাজে তাকে সহায়তার জন্য ভারতের কাছে এ দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করেননি। ভারত তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাংলাদেশের ভ‚মি, জলসীমা, আকাশসীমা ইত্যাদি করায়ত্ত করার লোভে নিজে গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্তে¡ও বাংলাদেশকে একটি স্বৈরাচারী দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে হাসিনাকে সর্বাত্মক সহায়তা করে গেছে। হাসিনার আমলেই বাংলাদেশের একটি নদী ভরাট করে ভারতের আগরতলায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় বড় জেনারেটর পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরকে বিনাশুল্কে ভারতীয় মালামাল আমদানি-রফতানির সুযোগ তো দেয়া হয়েছে, যেখানে ভারতীয় জাহাজকে বাংলাদেশের জাহাজের উপরে প্রায়োরিটি দেয়া হতো। সামরিক তথ্য সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে ভারতীয় রাডার স্থাপনেরও অনুমতি দেয়া হয়েছিল, যে সুযোগ কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র কখনোই অন্য কোনো রাষ্ট্রকে দেয় না। শেখ হাসিনার পতনের আগ মুহূর্তে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতকে রেল করিডোর এবং আমাদের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মংলার পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত করা হয়েছিল। যে ভারতের অসহযোগিতার কারণে বাংলাদেশ তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, সেই তিস্তায় ‘বেসিন ব্যবস্থাপনার’ কাজও চীনকে দিয়ে করানোর সুযোগ পাওয়া যায়নি ভারতীয় বিরোধিতার কারণে। আর ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে তীব্র বৈষম্যের শিকার ছিল, তা বলাই বাহুল্য।

এই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত যখন বুঝতে পারে এ দেশে তার দখল ও বাণিজ্য স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে চলেছে, তখন তারা বাংলাদেশ-বিরোধিতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চর্চা শুরু করে দেয়। হাসিনার পতনের পর বিস্ময়ের ধাক্কা সামাল দিয়েই তারা এ দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনী সারা বিশ্বে প্রচার করা শুরু করে। ভারতের সাথে এই কাজে যুক্ত হয় পতিত স্বৈরাচারের কর্মী ও সমর্থকরা। ভারতের এই ‘ভুল তথ্য প্র্রচার’ যে মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করছে এবং সামনেও করবে, তা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ২০২৪-এর ঝুঁকি অ্যানালিসিসে পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত। মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানোর কারণে তাদের গ্রহণযোগ্যতা যে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তারা সেদিকেও খেয়াল করছে না। ইসকন নামক একটি চরমপন্থী হিন্দু সংগঠন (যা বিশ্বের অনেক দেশেই নিষিদ্ধ) হাসিনার সময়েই ভারতীয় আনুকূল্যে এ দেশের মূল হিন্দু মন্দিরগুলো দখল করে একেকটি মিলিট্যান্ট আস্তানায় পরিণত করে ক্যাডারভিত্তিক সাম্প্রদায়িক বাহিনী সংগঠিত করে। এই মন্দিরগুলোতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে উন্নয়নকাজ শুরু করার কারণে মূল হিন্দু নেতারাও চুপ করে যান; আর ইসকন সন্ত্রাসীদের ভীতি প্রদর্শন তো ছিলই।

সম্প্রতি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ভারত তার এই বাহিনীকে ব্যবহার করা শুরু করেছে। ইসকন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করা থেকে শুরু করে বাংলাদেশকে ভেঙে একটি হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রও করছে। ফলে দেশের সরকারের এই রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড দমন করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। সরকার ইসকনের এক শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করলে ইসকনের সন্ত্রাসীরা দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অরাজকতার সৃষ্টি করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে একজন তরুণ আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করে এই ইসকন সন্ত্রাসীরা। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এত উসকানির পরও পাল্টা কোনো সহিংসতা করেনি। এতে ভারতের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় তারা বাংলাদেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে থাকে। এর মধ্যে তারা কলকাতার বাংলাদেশের উপহাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেয়াও আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ইউনূসের কুশপুত্তলিকা দাহ করার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটল গত ২ ডিসেম্বর, ২০২৪ ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায়। সেখানে হিন্দুত্ববাদীরা বাংলাদেশের উপহাইকমিশন কার্যালয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেয় এবং ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে পদদলিত করার চেষ্টা করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

এখানেই শেষ নয়, পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর জন্যও ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। ভারতের কোনো এক রাজ্যের মূর্খ মুখ্যমন্ত্রী কী বলল, সেটি ধর্তব্যের মধ্যে না নিলেও বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা ও আমাদের স্বাধীনতাকে ভ‚লুণ্ঠিত করার লক্ষ্যে ভারতের যেকোনো একটি গোপন পরিকল্পনা আছে, তা বোঝা যাচ্ছে। তবে আশার কথা হলো- কিছু সংখ্যক আওয়ামী-ভারতদাস, ইসকন সদস্য ও কতিপয় সনাতনী ছাড়া বাংলাদেশের আপামর জনগণও বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। গত বেশ ক’বছরের মধ্যে এবারই প্রথম লক্ষ করছি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট, গণতান্ত্রিক-জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলো সমস্বরে ভারতের এই অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে কথা বলছে এবং কর্মসূচি পালন করছে। তারা ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতো সঙ্ঘাতের পথে না হেঁটে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের কথা বলছেন। এখানেই আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। এ দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মূল অংশও এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে এসেছে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশে এই ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ সব ধরনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তুলবে এবং সব চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেবে, যার চিহ্ন ইতোমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করা একটি দেশকে করায়ত্ত করা এত সহজ না।

বিজেপি শাসনামলেই শুধু নয়, এর অনেক আগে থেকেই ভারতে মুসলিম, শিখ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে Pav Singh’s ‘1984 : India’s Guilty Secret’, বা ‘The Gujrat Files’ by Rana Ayyub বইগুলো সারা বিশ্বে ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ক্ষেত্রে রেফারেন্স হিসেবে বিবেচিত হয়। এই মুহূর্তেও ভারতের কাশ্মির, মনিপুরে বিচ্ছিন্নতাবাদের আগুন জ্বলছে, যার মূল কারণ অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর ‘হিন্দুত্ববাদীদের’ নিপীড়ন ও নির্যাতন। ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের পরিণাম বিষয়ে ২০২৩ সালের ২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সতর্ক করে বলেছিলেন, ভারত সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ না করলে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। এতেও ‘হিন্দুত্ববাদী’ ভারতীয়দের টনক নড়েনি। ভারতের বিপুল আয়তন ও বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তির কারণেই শুধু নয়, ভারতের তাঁবেদার সরকার বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে এ দেশের মানুষ ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও হত্যার বিষয়ে বড় কোনো শোরগোল করতে সমর্থ হয়নি, যদিও তারা প্রতিবাদ করতে কখনো পিছপা হয়নি।

গত ২৪ নভেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশের ‘শ্যাম্ভল’ এলাকায় অবস্থিত মোগল আমলের এক মসজিদকে (ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে) সার্ভে করার সরকারি নির্দেশের প্রতিবাদে স্থানীয় মুসলমানদের বিক্ষোভে ভারতীয় পুলিশ গুলি করলে চারজন মুসলিম নিহত হন ও প্রায় দুই হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়; সেখানে ইতোমধ্যে অসংখ্য মুসলমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের প্রখ্যাত সুফি সাধক মইনউদ্দিন চিশতির মাজার আজমির শরিফকেও ভাঙার জন্য নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এই সংবাদগুলো আশঙ্কাজনক। বাবরি মসজিদকে ভেঙে রামমন্দির নির্মাণ সারা বিশ্বের মুসলমানদের ব্যথিত করেছে। ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বিশ্বের মুসলমানদের কাছে আর গ্রহণযোগ্য হবে না। বিষয়টি ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের মনে রাখা দরকার।

বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। তারা সৎ প্রতিবেশী হিসেবে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভারতের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, কিন্তু কোনোভাবেই ভারতীয় আধিপত্যবাদের কাছে মাথানত করে নয়। আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার কোনো সম্ভাবনা নেই, এ বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করে ভারত যত দ্রুত তাদের দিবাস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে একটি সুষ্ঠু সম্পর্ক বিনির্মাণে এগিয়ে আসবে, তত দ্রুতই এই অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মচারী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement