০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ইসকন বটিকায় সর্বনাশা চক্রান্ত

- প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অযাচিত ভ‚মিকার কদাকার প্রকাশ ঘটে চলেছে। নিজেদের মাটিতে মুসলিম এমনকী হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নিম্নবর্গের ওপরও অসংখ্য অকথ্য নির্মমতার ঘটনা আড়াল করে এখন কোমর বেঁধে নেমেছে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ইস্যুতে। একের পর এক রটাচ্ছে এ দেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের কল্পকাহিনী। যেখানে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার জরিপেও উঠে এসেছে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক স্থিতিশীলতার কথা। জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে। সেখানে এজেন্ডার অংশ হিসেবে নিয়মিত ঘি ঢালছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধির জয়সওয়াল।

সর্বশেষ ২৯ নভেম্বর শুক্রবারও এক ঝাপি অভিযোগ ঝেড়েছেন তিনি। সেখানে ভারত সরকারের খাস পছন্দের কিছু সাংবাদিককে আ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে রাখা হয়েছে ইচ্ছেমতো উসকে দেয়ার প্রশ্ন করতে। এরপর রসিয়ে রসিয়ে জবাব দেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ মুখপাত্র। শুক্রবারের ব্রিফিংয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশ সরকার ইসকনকে ‘উগ্রবাদী সংগঠন’ আখ্যা দিয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মত কী? রনধির জসওয়ালের জবাব, ‘ইসকন বৈশ্বিকভাবে প্রখ্যাত সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত। তাদের সামাজিক ক্ষেত্রে অবদানের ভালো রেকর্ড আছে। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে আবারো বলব, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।’

যেই জাতের প্রশ্ন, সেই জাতের জবাব। দেশে বিশৃঙ্খলা পাকাতে ক্ষমতাচ্যুতদের ষড়যন্ত্রের বিপরীতে এবার দুর্গাপূজার সময় ছাত্র সংগঠন, মাদরাসা, রাজনৈতিক দলসহ বাংলাদেশের মানুষ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় যে অনন্য কাজ করেছে, চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে নির্মম ও উসকানিমূলকভাবে হত্যার পরও বাংলাদেশের মুসলমানরা যে সংযম ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে ভারতের গণমাধ্যমে তার ছিটেফোঁটা খবরও নেই। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোড়ে তাদের পছন্দের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রভাবশালী নেতাদের পলায়নের খবরও প্রচার হয়নি। অথচ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ইসকন নেতা চিন্ময়কে গ্রেফতার এবং জামিন আবেদন নামঞ্জুর করার ঘটনা ফলাও করে প্রচার হয়েছে। উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতির খবর প্রচার হয়েছে আচ্ছা রকমে।

আর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, দেবতার অবমাননা, মন্দিরে চুরি-ভাঙচুরের কল্পিত কথা তো থাকছেই। যা দুই প্রতিবেশী দেশের বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়ার চেতনারও পরিপন্থী। একদিকে বলা হচ্ছে, ইসকনের বাংলাদেশ পার্ট থেকে গত জুলাইতে বহিষ্কার করা হয়েছে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে। আরেক দিকে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর পর তার অনুসারীরা ঘোষণা দিয়ে ত্রিশুলসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলে পড়ে পুলিশ ও আইনজীবীদের ওপর। কুপিয়ে হত্যা করে সরকারি পাবলিক প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম আলিফকে। এ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে খবর নেই। দেশটির সংসদেও আলোচনা হয় একেবারে বিপরীত তথ্য নিয়ে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করাকে দায়িত্ব বলে ভারতের সংসদে বৃহস্পতিবারও বিবৃতি দিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কৃতি বর্ধন সিং। রীতিমতো গায়ে পড়ে আচানক কাণ্ড।

এর আগে চিন্ময়ের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর হুমকি-ধমকি দিয়েছেন বিজেপি নেতা। বাংলাদেশে গ্রেফতার বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে ইসকন নেতা উল্লেখ করে তার মুক্তি দাবি করেছেন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি শুভেন্দু অধিকারী। তাকে মুক্তি না দিলে সীমান্তে সনাতনীরা ধ্বজ নিয়ে অবরোধ করবে বলে হুমকিও দিয়েছেন। এমনকি কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেছে এবং বাংলাদেশের পতাকা ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়েছে। ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে কোনো পরিষেবা বাংলাদেশে ঢুকতে না দেয়ার হুঙ্কার দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে চিন্ময়কে বলা হয়েছে বাংলাদেশে হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষার নেতা নামে। বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা শালীন এবং রক্ষণাত্মক। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবামৃত সঙ্ঘ-ইসকনের বিষয়ে সরকারের অবস্থানের কথা আদালতকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। জবাবে আদালত থেকে জানানো হয়েছে, ইসকন নিষিদ্ধ হবে কি না এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার, এ নিয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না। এর বিপরীতে ইসকন নেতা চিন্ময়ের গ্রেফতার নিয়ে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য ও ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং দেশটির গণমাধ্যমের ভাষা প্রায় অভিন্ন। গাঁথুনিও কাছাকাছি। এর প্রতিবাদে উত্তাল বাংলাদেশ। ইসকন নিষিদ্ধ এবং আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ চলছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

ইসকনের মানে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণা কনশাসনেস। বাংলা অনুবাদে বলা হয়- ‘আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সঙ্ঘ’। এর জন্ম ১৯৬৬ সালে। প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ, সংক্ষেপে শ্রীল প্রভুপাদ। তার আসল নাম অভয়চরণ দে। কাগজ-কলমে এর সাংগঠনিক লক্ষ্য শ্রীকৃষ্ণের ভক্তি চর্চা-প্রসার, ভক্তিযোগ, শিক্ষা ও গবেষণ, কথা। কীর্তন, হরিনাম সঙ্কীর্ত, সঙ্গীত ও ধ্যানের কথাও আছে। প্রধান ধর্মীয় পাঠ্যভগবদগিতা। কিন্তু বাস্তবে এসবের ধারেকাছে নয়। সাধু-সন্যাসী সেজে, নিরামিষভোজী পরিচয়ে বাংলাদেশে থেকে তাদের ভারতের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন প্রকাশ পেয়েছে আরো আগে। বাংলাদেশকে এভাবে ভারতের পেয়ে বসার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। বাংলাদেশে বিরাজমান সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টায় ইসকনের আয়োজন অনেক দিনের। তারা এগোয় ধীরে। এতদিন আন্তর্জাতিক বিস্তারের দোহাই দিয়ে মুখোশের আড়ালে থেকে কিছু দিন ধরে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকটা উতলা হয়ে উঠেছে। বেশ চাতুরিতে কাজের আওতা বাড়িয়েছে। সাইবার জগতে তারা বেশ তৎপর। বাংলাদেশে সনাতন মন্দিরগুলো দখল ও সনাতনদের তাড়িয়ে দেয়ার কাজে তারা অনেকদূর এগিয়েছে। ঢাকার স্বামীবাগের মন্দিরটি আগে সনাতনদের ছিল, পরে ইসকনরা কেড়ে আগেরদের ভাগিয়ে দেয়। পঞ্চগড়েও সনাতনদের পিটিয়ে এলাকাছাড়া করেছে। ঠাকুরগাঁওয়ে সনাতন হিন্দুকে হত্যা করে মন্দির দখল, সিলেটের জগন্নাথপুরে সনাতনদের রথযাত্রায় হামলার মতো কাজ ইসকনরা করেছে খুব পাকা হাতে।

এক্সপার্ট হ্যান্ডে সংখ্যালঘু নিয়ে এমন কার্ডের বিপরীতে উগ্রবাদী কার্ডও ঘুরছে বাংলাদেশে। তা ঘুরছে দেশের মিডিয়া জগতের বিশেষ চত্বরেও। জবাই করা গরুর গায়ে এক ‘সম্পাদকে’র নাম সাঁটা হয়েছে। এসব সরকারের ইমেজ নষ্টের খেলা। বহির্বিশ্বে ভুল বার্তা পৌঁছাচ্ছে।

মনে পড়ে সংক্ষেপে জে সি পান্থ নামে একদা ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োজিত জগদীশ চন্দ্র পান্থর সফল অপারেটিভ আলোচিত। তার নিরন্তর চেষ্টায় ঘাদানির প্রসার ঘটে, তসলিমার লজ্জা ইস্যু তৈরি হয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর দুটো বড় ইস্যু তৈরি হয়, যা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক অসুবিধার মধ্যে ফেলে দেয়। একটি ঘাদানি তৈরি।

আরেকটি হঠাৎ তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বই প্রকাশ। কলকাতার একটি গ্রুপের একনিষ্ঠ প্রযোজনায় ওই বইটি প্রকাশিত হয় ঝড়ের গতিতে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি তখন এটি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রচারণায় নামে। আর বাংলাদেশে নামিয়ে দেয়া হয় কথিত ধর্ম রক্ষার নামে একটি দলকে। তখন প্রেস ক্লাবের সামনে আকস্মিক কতগুলো লোক সাপ নিয়ে তসলিমাবিরোধী মিছিল করে। ওই মুহূর্তে এ দেশেরই কিছু ফটোগ্রাফারকে দিয়ে সেই মিছিলের ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয় বিশ্ব গণমাধ্যমে। পরে আরেক গ্রুপকে নামিয়ে দেয়া হয় ‘আল্লার দল’ নামে। তারাও প্রেস ক্লাবের আশেপাশে মিছিলে নামে ধর্ম রক্ষার স্লোগানে। তাদের ছবিও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হয়। গোয়েন্দারা একসময় একটি ছবি বিশ্লেষণ করে দেখেন, স্বয়ং দাড়িওয়ালা জে সি পান্থ জোব্বা পরে ওই মিছিলে হাজির। গোয়েন্দাদের তৎপরতায় তখন দ্রুত নাই হয়ে যায় ‘আল্লার দল’।

এবারের প্রেক্ষিত ও ঘটনা ভিন্ন। আয়োজনে আরো ভিন্নতা। ভারতেও এখন এই কার্ডের খেলা। ২০২৫ সালে পশ্চিম বাংলায় বিধানসভার নির্বাচন, এতে জিততে হলে নরেন্দ্র মোদির বিজেপিকে হিন্দু কার্ড খেলতে হবে। তাদের বিশেষ চাওয়া একটি অস্থির বাংলাদেশ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে অস্থির রাখা দরকার তাদের। বাংলাদেশের ভেতরে যে গোষ্ঠী ধর্মের কার্ড খেলে রাজনীতি এগোতে চায় তাদের কাছেও সাম্প্র্রদায়িক উত্তেজনা দরকার। পৃথিবীর সব প্রান্তের এই শক্তির রং, পোশাক ভিন্ন হলেও লক্ষ্য ও কৌশল অভিন্ন। তাদের মনস্তত্ত্ব একই। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা এখন যে শক্তি দেখাচ্ছে, আগে তা পারেনি। আলোচিত প্রিয়া সাহা যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিল তখন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা তাকে বলেছে দেশদ্রোহী। তাদের এখনকার চেষ্টা প্রিয়া সাহা আবার ট্রাম্পের কাছে গিয়ে নালিশ করুক। দুষ্টামির পাটাতন তৈরিতে ধর্মীয় বিভাজন-উগ্রতা ছড়ানোর সেরা কারিগর বলা হয় নরেন্দ্র মোদিকে। তার এদেশীয় ছা-পোনারাও মাঠে সক্রিয়। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও তার সম্পদ ও সম্বল। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নরেন্দ্র মোদির ভারতে বাংলাদেশের মতো স্বস্তিতে নেই।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে উত্তাল বাংলাদেশ জ্যামাইকায় অবিশ্বাস্য লিড বাংলাদেশের মধ্যরাতে ভারতবিরোধী স্লোগানে উত্তাল নোবিপ্রবি আগরতলায় ভাঙচুরের পর এবার মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ উপকমিশনের সামনে বিক্ষোভ বাংলাদেশের মানুষ কারো দাদাগিরি পছন্দ করে না : জামায়াত আমির আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে ববিতে বিক্ষোভ আগরতলার বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা পূর্বপরিকল্পিত : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে ইবিতে বিক্ষোভ রংপুরে ভারতীয় পণ্য ও মিডিয়া বর্জনের ডাক অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে ইসিকে সহায়তা দিতে চায় জাতিসঙ্ঘ আজাদি আজাদি স্লোগানে উত্তাল ঢাবি

সকল