পুলিশের সংস্কার- জনমানুষের প্রত্যাশা
- মোহাম্মদ আবদুল মাননান
- ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:০৮
ভারতের একজন বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার বলেছেন, সরকারি উর্দির আড়ালে পুলিশ এক সংগঠিত গুণ্ডাবাহিনী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, উহাদের (পুলিশের) লালায় বিষ থাকে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩) লিখেছেন, অবশেষে পুলিশও গাহিল রবীন্দ্রসঙ্গীত (যেন, পুলিশ সচরাচর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার অধিকার রাখে না)। আমাদের বিবেচনায়, দলে দলে মানুষ পুলিশ হয় কিন্তু একজন পুলিশও মানুষ হয় না। পুলিশ নিয়ে ঋণাত্মক উদ্ধৃতি আরো আছে। অবশ্য পুলিশ নিয়ে ভালো মন্তব্যেরও অনটন নেই। পুলিশ একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য অঙ্গ এবং একে বাদ দিয়ে সরকারব্যবস্থার কথা চিন্তাও করা চলে না।
উপরের তিনজন মৃত এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির পুলিশ নিয়ে এই মনোভাব কেন? কিংবা এ সময়ের জনসাধারণ্যে পুলিশ নিয়ে ধারণাটি কী অথবা পুলিশের সেবায় নাগরিকদের কতজন সন্তুষ্ট? এসব গভীরভাবে অধ্যয়ন না করলে সরকার গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন যথাযথ সুপারিশ করতে পারবে না। কমিশনকে মাথায় রাখতে হবে, পুলিশের সব সদস্য এ সমাজেরই মানুষ। তারা আমাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-সহপাঠী কিংবা নিকটজন। পুলিশে যোগ দিয়েই তাদের কেউ বিচ্ছিন্ন প্রাণীতে রূপান্তিত হয় কেন? সমস্যা কোথায়? সমস্যা কি পুলিশের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ বা কর্মপরিবেশে? নাকি অন্য কোনো কারণ? দুই দিন আগের কমিটেড-প্রোমিজিং ছাত্র কিংবা বেকার যুবকটি ওখানে পৌঁছেই মানুষ থেকে রাতারাতি কেন-ই-বা পুলিশ বনে যায়? পুলিশি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা বা একজন ব্যক্তি কি এর জন্য দায়ী, নাকি দেশের রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থার এতে দায় আছে? এই পাঠ গ্রহণ ছাড়া পুলিশের সংস্কার প্রস্তাব প্রস্তুত করা সম্পূর্ণ হবে না।
শাহ আবদুল হান্নান, তখন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক। একটি প্রশিক্ষণে বলতে শুনেছি, ‘কাস্টমসে বেশ কিছুসংখ্যক ইনসপেক্টর নিয়োগ দিয়েছি এবং আমি নিশ্চিত করেছি, একজনকেও চাকরি পেতে টাকা দিতে হয়নি। কিন্তু চাকরিতে এসেই তিন মাসের মধ্যে ঘুষ নেয়া শুরু করেছে। সমস্যাটি তো বুঝলাম না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোর গলায় আওয়াজ তোলা ছেলেমেয়েটি কেন চাকরিতে ঢুকেই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে (সব সার্ভিসেই) তা পুলিশ-দুদক-জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যথার্থভাবে অনুধাবনে ব্যর্থ হলে কমিশন থেকে ভালো সুপারিশ পাওয়া যাবে না। পুলিশ সংস্কার কমিশনকে মর্ম উদ্ধার করতে হবে, ডাকাতির মামলা রুজুতে পুলিশের অনীহা কেন? জানতে হবে, এই রাজধানীতে ছিনতাই ঘটনার ৫০ শতাংশ থানায় রিপোর্ট হয়, মানুষ থানা-পুলিশকে সেবার বদলে হয়রানির জায়গা মনে করে। কিন্তু কেন? কেনই বা ডাকাতির কেস নিয়ে থানায় গেলে এজাহারের বদলে জিডি করতে উৎসাহিত করা হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই সংস্কার কমিশন বুঝতে পারবে, জনমানস কী রকমের পুলিশ চায় কিংবা পুলিশ থেকে কী পেতে চায়।
ফৌজদারি কার্যবিধি পুলিশি ক্ষমতার আকরগ্রন্থ। গ্রেফতার, বলপ্রয়োগ, লাঠিচার্জ, রিমান্ড, জিজ্ঞাসাবাদ, সাক্ষ্যগ্রহণ, তদন্ত, চার্জশিট ও মামলা পরিচালনায় পুলিশি ভ‚মিকা সবটাই এতে বর্ণিত আছে। পরিপালন হয় না কেন? গ্রেফতারের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে কি হাজির করা হচ্ছে? রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক নির্যাতনের কথা কি ফৌজদারি কার্যবিধিতে আছে? এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন, মাঝে মধ্যে পুলিশি হেফাজতে যে নির্যাতনের খানিক বিবরণ মিডিয়ায় আসে বলুন, ওই পুলিশকে মানুষ বলতে পারবেন! ওই লোকটি এমন অমানসিক নির্যাতন হরে ঘরে গিয়ে ঘুমাতে পারে তো? ক্রোসফায়ারে একজনকে নাই করে দেয়ার পর সংশ্লিষ্টরা বাসায় ফিরে স্বীয় বাচ্চাদের দিকে তাকায় কী করে! বলবেন, উপরের নির্দেশে এসব করতে হয়। ঊর্ধ্বতনদের বেআইনি নির্দেশ পালনীয় নয়; এই কথাটি উচ্চারণের শক্তিও কেন এক জনের হারিয়ে যায়- এসব খুঁজতেই হবে। আর রাজনৈতিক সরকার পুলিশকে কেন এসব বেআইনি কাজ করায়? পুলিশের অপব্যবহার রোধে সুস্পষ্ট সুপারিশ ছাড়া কমিশনের রিপোর্ট কাজে আসবে না। পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার রোধ করতে না পারলে আগামীতেও ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চলবে। মনে করে দেখুন তো, ১৯৭০ সালের আগে নানা আন্দোলনে পুলিশ কি নির্বাচারে গুলি করেছিল? তাহলে স্বাধীন দেশে পুলিশের এত গুলি করতে হয় কেন? সত্য-মিথ্যা দিয়ে মামলার পাহাড় রচনা করতে হয় কেন? একটি বাসে কী করে দুই হাজার মানুষ আগুন ধরিয়ে দিতে পারে; এসব প্রশ্ন তো আসবে। কীভাবে পুলিশে বেনজীর-হারুনরা সৃষ্টি হয়? এই পাঠ ধরে ধরেই কমিশনকে এগোতে হবে।
পুলিশকে স্বাধীন করে দিলে বিপদ আছে। আবার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রাখলেও বিরোধী দমনে পারঙ্গম হয়ে ওঠে। ফলে কমিশনকে এই দুইয়ের মাঝামাঝি উপায় ভাবতে হবে। অধিকাংশ পুলিশের বিরুদ্ধে হার্মাদ হয়ে ওঠার অভিযোগ ওঠে। ক্ষমতার দাপট, বন্দুকের দাপট এবং এসবের নেপথ্যে আছে হয়রানি করার মোক্ষম পন্থা। পুলিশ কর্তৃক অযথা হয়রানির সব দরজা বন্ধ করতে হবে। অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আর ভালো মানুষের রক্ষার মহান ব্রতে পুলিশকে ফেরাতে হবে। অপরাধী পুলিশকে ভয় পাবে কিন্তু নির্যাতিত নির্দ্বিধায় পুলিশের কাছে পৌঁছে যাবে, বন্ধু ভাববে, থাকবে না মধ্যপথে কোনো দেয়াল- এটিই সাধারণ মানুষের চাওয়া। মামলা করার পর আসামি ধরার জন্য একবার, তদন্ত রিপোর্টের জন্য আরো একবার অর্থ দিতে হবে কেন; কমিশনের বিজ্ঞ সদস্যরা এসব জানেন না, এমন নয়।
উচ্চ আদালতের নির্দেশও অনেক সময় মানতে চায় না পুলিশ। ৫৪ ধারায় গ্রেফতার, রিমান্ড ও জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে নানা সময়ে প্রদত্ত উচ্চ আদালতের আদেশ প্রতিপালন হচ্ছে না। গ্রেফতারকালে কাস্টডি মেমোর ব্যবহার আজও শুরু হয়নি। পুলিশের কনস্টেবল থেকে ইনসপেক্টর হচ্ছে পুলিশ। উপরের দিকে সবাই প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভেন্ট- এদের বিরুদ্ধে গুম-আয়নাঘরের অভিযোগ উঠলে পুরো ব্যবস্থা নিয়ে ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
পুলিশের এখতিয়ার ও ক্ষমতা প্রসঙ্গে সিআরপিসি পরিবর্তনে বিশেষ দরকার হবে কি? তেমন মনে হয় না; বরং সিআরপিসির বিধানগুলো কিভাবে কার্যকর হয়, সেটি নিয়ে ভাবার আছে। হ্যাঁ, পিআরবি সেই বহু আগে প্রবর্তিত হয়েছে। পিআরবির বহু কিছু তুলে দেয়া যেমন দরকার, তেমনি আধুনিক পুলিশের জন্য নতুন কিছুর সংযোজন করার দরকার আছেই। শহুরে পুলিশের জন্য প্রণীত আইন নিয়ে কিছুটা সময় দেয়ার অবকাশ আছে। তবে আইনের চেয়ে আইনের প্রয়োগেই সমস্যা। একই আইনে পুলিশ কমিশনার একটি রাজনৈতিক দলকে এক দিন আগে চাইলেও সমাবেশের অনুমতি দিয়ে দেন। আবার একই আইনে অন্য একটি দল সাত দিন আগে চেয়েও অনুমতি পায় না। আইন নয়, আইন প্রয়োগকারীর সমস্যা। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে এই অবস্থার উন্নতি কিভাবে? এ প্রশ্নের জবাবই কমিশনের সুপারিশে দেখতে চাই।
পুলিশের সংখ্যা বেশ বেড়েছে। একটি থানা তিনজন সাব-ইনসপেক্টরকে সামলাতে দেখেছি; এখন কোনো কোনো থানায় ৫০-এর অধিক এসআই কাজ করছে। রাজধানীসহ সব মেট্রোপলিটনে থানার সংখ্যা বেড়েছে। বরিশাল-গাজীপুর-ময়মনসিংহ-রংপুর-সিলেট শহরে একজন ওসি সবটা সামলাত। এখন কমিশনার থেকে শুরু কতগুলো পদ হয়েছে কিন্তু সেবার মান একজন ওসির সময়ে যা ছিল তারও নিচে নেমেছে। কোথাও পুলিশের কথা উঠলেই পুলিশের সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলা হয়। পুলিশের বড় কর্তারা পুলিশ স্বল্পতার কথা তোলেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলকে ঠেঙাতে আজ অবধি পুলিশের কমতি পড়েনি। অফিসারদের বাসায় ঘরদোর-বাগানের কাজে পুলিশের একদমই স্বল্পতা নেই। তারপরও উপরের তুলনায় নিচের দিকে পদ-পদবি কমই বৃদ্ধি পেয়েছে- এসবও কমিশন দেখুক। বিগত বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি গাড়ি কেনা হয়েছে পুলিশের জন্য; কেবল মিলছে না কাক্সিক্ষত সেবা।
মানুষ পুলিশকে পুলিশের দেয়া স্লোগানেই দেখতে চায়- পুলিশ জনমানুষের বন্ধু। ওই যে চঙখওঈঊ ভেঙে লেখা হয়- পোলাইট, ওবিডিয়েন্ট, লয়াল, ইনটেলিজেন্ট, কারেজিয়াস, এনার্জেটিক (মতান্তরে এডুকেটেড); ঠিক এমনটিই জনপ্রত্যাশা। তবে এই পোলাইট, লয়াল, ওবিডিয়েন্ট হতে হবে সেবাপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে। একটি রাষ্ট্রের পুলিশের বিরুদ্ধে খুন, গুম, হয়রানি এবং সর্বোপরি নৈশ নির্বাচনের দায় আসবে কেন? পুলিশ তো চায় জনগণের বন্ধু হতে। মানুষও সেটি চায়। পুলিশের বিরুদ্ধে জনারণ্যে অভিযোগের পাহাড় থাকলেও ব্যবস্থা গ্রহণের নজির কম। এই যে ঊর্ধ্বতন পুলিশের অনেকের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা অর্জনের অভিযোগ উঠেছে, কই তাদের সদর দফতরের গোয়েন্দা সেল তার কিছুই দেখল না! বরং পুলিশের সৎ অফিসাররা হয়রানির শিকার বলে অভিযোগ আছে। পুলিশকে রাজনৈতিক মেরুকরণ থেকে দূরে রাখার বিকল্প নেই। অন্য দিকে ছাত্রজীবনের পরিচয় দিয়ে চাকরিতে দাপট দেখানো থেকে সুবিধা গ্রহণের পথ রুদ্ধ করা চাই।
অবৈধভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। থানায় এজাহার না দিলে আদালতে যাওয়ার বিধান আছে। সে পথ কি খুব মসৃণ? ফলে সংস্কার কমিশন সিভিল সোসাইাট সমন্বয়ে গঠিত মধ্যপথে একটি সেলের কথা ভাবতেই পারে। কমিশন ভাবতে পারে, কেবল জেলা-থানা আইজির উপর রেখে সিআইড, এসবি, নৌ, পর্যটন, হাইওয়ে, শিল্প, মেট্রোপলিটান পুলিসের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ডিজি করে সরাসরি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করলে কেমন হবে। পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ দেখার জন্যও আলাদা কমিশন থাকতে হবে; এই সুপারিশও করুক সংস্কার কমিশন। পুরোনো দিনের পুলিশ দিয়ে এ সময়ের সমস্যার সমাধান কিংবা সেবা নিশ্চিত করা মোটেই সম্ভব নয়। ফলে পুলিশের সেবার মানসিকতা, সেবার ধরন, তদন্ত পদ্ধতিসহ সব কিছুর আধুনিকায়ন দরকার হবে আর সেসবের বিস্তারিত সুপারিশই করুক গঠিত কমিশন। চাই তো, একটি সরকার বদলের পর পুলিশ যেন থানা ছেড়ে পালিয়ে না যায়; সরকার বদল হবে- সরকারি চাকুরেরা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে, এমন পুলিশই চাই।
এক কথায়, জনবান্ধব পুলিশ চাই; সৎ ও যোগ্য পুলিশ চাই। কথায় নয়, কাজে। নিরপরাধীদের হয়রানি করবে না, এমন পুলিশ চাই। বিপদে দ্রুত কাছে পাবো এমন পুলিশ দরকার। পুলিশ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করলে বহু অপরাধ সংঘটিতই হবে না। এ জন্য দরকার হলে আইন, নিয়োগ প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ সব পাল্টে যাক- বদলে যাক পুলিশের খোলনলচে। নাগরিকরা তাতে মোটেই আপত্তি করবে না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা