সেনা অভ্যুত্থান, সেনা শাসন ও আওয়ামী লীগ
- ওয়ালিউল হক
- ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৫৩
আওয়ামী লীগ ও এর সমর্থক মিডিয়া ও সুশীলরা সব সময়ই দলটিকে গণতন্ত্রের পক্ষের বিরাট শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে। বলা হয়েছে, পাকিস্তান আমল থেকে দলটি সেনা অভ্যুত্থান, সেনা শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে; মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছে। তাদের এ বক্তব্য কতটা ঠিক তা কখনো বিচার বিশ্লেষণ করা হয়নি। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এই বিচার বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
১৯৪৯ সালে ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আসাম থেকে ফেরত আসা মুসলিম লীগ নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তরুণ ইসলামী চিন্তাবিদ শামসুল হক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমদ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানে দু’টি ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা এবং দু’টি সফল অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। প্রথম ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটেছিল ১৯৫১ সালে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আকবরের নেতৃত্বে যা রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র নামে খ্যাত। ওই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সাথে জড়িত ছিল পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি। মজার ব্যাপার হলো পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকা সফরে এসে কমিউনিস্টদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজ্জাদ জহিরের পক্ষে আদালতে ওকালতি করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। উল্লেখ্য, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের হাত ধরেই শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। আদালত সাজ্জাদ জহিরকে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সাজ্জাদ জহিরকে মুক্তি দেন। দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সাথে জড়িত না থাকলেও সহানুভ‚তিশীল ছিল।
দ্বিতীয় অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয় ষাটের দশকে, যা পরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিতি পায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল মূলত একটি সেনা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীতে কর্মরত সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে কর্মরত অফিসার ও সৈনিকরা ওই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। পাকিস্তান সরকার প্রথমে ২৮ জনকে গ্রেফতারের কথা জানালেও পরে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে যে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় তারা হলেন :
১. শেখ মুজিবুর রহমান (আওয়ামী লীগ নেতা)। ২. মোয়াজ্জেম হোসেন (লে. কমান্ডার, পাকিস্তান নৌবাহিনী)। ৩. মুজিবুর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত স্টুয়ার্ড, পাকিস্তান নৌবাহিনী)। ৪. সুলতান উদ্দিন আহমেদ (অবসরপ্রাপ্ত লিডিং সিম্যান, পাকিস্তান নৌবাহিনী)। ৫. নূর মোহাম্মদ, লিডিং সিম্যান সিডিআই (নৌবাহিনী) ৬. আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি। ৭. ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ (বিমানবাহিনী)। ৮. এবিএমএ সামাদ (অবসরপ্রাপ্ত করপোরাল, পাকিস্তান বিমানবাহিনী)। ৯. দলিল উদ্দিন, সাবেক হাবিলদার (পাকিস্তান সেনাবাহিনী)। ১০. রুহুল কুদ্দুস সিএসপি। ১১. ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হক (বিমানবাহিনী)। ১২. ভ‚পতি ভ‚ষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী (কোষাধ্যক্ষ, জেলা আওয়ামী লীগ, চট্টগ্রাম)। ১৩. বিধান কৃষ্ণ সেন, (রাজনৈতিক নেতা)। ১৪. আব্দুর রাজ্জাক, সুবেদার (পাকিস্তান সেনাবাহিনী)। ১৫. মুজিবুর রহমান (সেনাবাহিনী) সাবেক হাবিলদার ক্লার্ক। ১৬. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক (বিমানবাহিনী) সাবেক ফ্লাইট সার্জেন্ট। ১৭. সার্জেন্ট জহুরুল হক (বিমানবাহিনী)। ১৮. এ বি এম খুরশিদ, অবসরপ্রাপ্ত লিডিং সিম্যান, (পাকিস্তান নৌবাহিনী)। ১৯. খান এম শামসুর রহমান, সিএসপি। ২০. রিসালদার শামসুল হক (পাকিস্তান সেনাবাহিনী)। ২১. হাবিলদার আযিযুল হক, (সেনাবাহিনী)। ২২. এসএসসি মাহফুজুল বারী (বিমানবাহিনী)। ২৩. সার্জেন্ট সামসুল হক (পাকিস্তান বিমানবাহিনী)। ২৪. মেজর ডা: শামসুল আলম (সেনাবাহিনী)। ২৫. ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ আব্দুল মুতালিব (সেনাবাহিনী)। ২৬. ক্যাপ্টেন এম শওকত আলী মিঞা (সেনাবাহিনী)। ২৭. ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা (সেনাবাহিনী)। ২৮. ক্যাপ্টেন এ এন এম নুরুজ্জামান (সেনাবাহিনী)। ২৯. সার্জেন্ট আবদুল জলিল (বিমানবাহিনী)। ৩০. মোহাম্মদ মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী (কোম্পানি এক্সিকিউটিভ)। ৩১. লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (পাকিস্তান নৌবাহিনী)। ৩২. তাজুল ইসলাম, সাবেক সুবেদার। ৩৩. আলী রেজা (ইন্সট্রাক্টর, নিপা)। ৩৪. ডা: ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দিন আহমেদ (এএমসি)। ৩৫. লে. আব্দুর রউফ (নৌবাহিনী)।
আগরতলা যড়যন্ত্র মামলার আসামিদের তালিকা থেকে বোঝা যায়, ষড়যন্ত্রের সাথে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও রাজনীতিবিদ ও আমলারাও জড়িত ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, রাজনীতিবিদদের মধ্যে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সবুর খানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও তাদের আসামি করা হয়নি এ কারণে যে, মুসলিম লীগের নেতারাও জড়িত এ কথা প্রকাশিত হলে জনমনে এমন ধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে, পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ নেতা পাকিস্তান থেকে আলাদা হবার চিন্তাভাবনা করছেন। স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সবুর খানকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে তার সংশ্লিষ্টতার কথা জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেছিলেন।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বই থেকে জানা যায়, অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সাথে জড়িতরা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। তিনি লেখেন, ‘১৯৬৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি কর্মসূচি ছিল। একই সময় চট্টগ্রামে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হচ্ছিল। পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তার চট্টগ্রামে আসার কথা ছিল। বিপ্লবীরা এ সুযোগে সেনাপ্রধানসহ সব কর্মকর্তাকে গ্রেফতার এবং অন্যান্য সেনানিবাসে যুগপৎ আক্রমণ করে দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু বিপ্লবী পরিষদের দলত্যাগী কোষাধ্যক্ষ করপোরাল আমির হোসেন এ ষড়যন্ত্রের তথ্য ফাঁস করে দেন। ফলে চট্টগ্রামের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সরকার অতি গোপনে সংশ্লিষ্ট কিছু কিছু লোককে গ্রেফতার করতে শুরু করে।’ (পৃষ্ঠা : ১৭০)
পরে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে আইয়ুব পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তার চন্দ্রঘোনা কাগজের কল দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। সামরিক গোয়েন্দা সূত্রে বলা হলো, প্রেসিডেন্ট যে বিমানে চট্টগ্রামে যাবেন, ষড়যন্ত্রকারীরা বোমা মেরে তা উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। আইয়ুব তার চট্টগ্রাম যাত্রা বাতিল করেন। ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ষড়যন্ত্রের’ কথা জেনে তিনি মুষড়ে পড়েন। তথ্য সচিব আলতাফ গওহরকে তিনি সখেদে বলেন, ‘ওরা আমাদের সঙ্গে আর থাকবে না।’ (পৃষ্ঠা : ১৭১)
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। সেটি হলো রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্রের মতো এই ষড়যন্ত্রের সাথেও কমিউনিস্টদের অংশগ্রহণ ছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি ও পরে আওয়ামী লীগ নেতা কর্নেল শওকত আলীর লেখা ‘সত্য মামলা আগরতলা’ থেকে জানা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির অন্তত দু’জন সদস্য বিছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টার সাথে জড়িত ছিলেন। একজন সেনাবাহিনীর ডা: শরফউদ্দীন আহমদ ওরফে এসডি আহমদ ও আরেকজন নৌবাহিনীর কমান্ডার আব্দুর রউফ। এসডি আহমদ পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার হাতে ধরা না পড়লেও আব্দুর রউফ ধরা পড়েন এবং তাকেও মামলার আসামি করা হয়। বাংলাদেশ হওয়ার পর এসডি আহমদ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে এবং আব্দুর রউফ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ফ্রন্ট অর্গানাইজেশন ন্যাপে (মোজাফ্ফর) যোগ দেন।
এবার নজর দেয়া যাক সফল দুই সেনা অভ্যুত্থানের দিকে। পাকিস্তানের প্রথম সফল সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন এবং সেনাবাহিনীর প্রধান আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন। নিয়োগপ্রাপ্তির ২০ দিন পর ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন।
প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারির ফরমানে রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতা দখলের দ্ব›দ্ব ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে স্পিকারকে মারধর, ডেপুটি স্পিকারকে হত্যা এবং জাতীয় পতাকার অবমাননার বিষয় উল্লেখ করেছিলেন; অর্থাৎ অভ্যুত্থানের কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, আওয়ামী মুসলিম লীগ নেজামে ইসলাম, গণতন্ত্রী দল ও খেলাফতে রাব্বানী পার্টির সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের মূল নেতা ছিলেন ফজলুল হক। ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভূমিধস জয়লাভ করে। তারা ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৮টি আসনে বিজয়ী হন। এর মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ পায় ১৪৩টি, কেএসপি ৪৮টি, নেজামে ইসলাম ২২টি , গণতন্ত্রী দল ১৩টি ও খেলাফতে রাব্বানী পার্টি পায় দু’টি আসন। এরপর মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে শুরু হয় কেএসপি ও আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব।
দ্বন্দ্ব বাধে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমান তখন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক কিন্তু ফজলুল হক তাকে মন্ত্রিসভায় নিতে রাজি ছিলেন না। পরে আওয়ামী নেতাদের চাপে তাকে মন্ত্রিসভায় নিতে বাধ্য হন। সেসময় অবশ্য আরেকটি ঘটনাও ঘটে। আদমজী পাটকলে বাঙালি বিহারি দাঙ্গায় পাঁচ শ’ শ্রমিক নিহত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ দাঙ্গার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করলেও আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী খুলনার শেখ আবদুল আজিজ তার ‘রাজনীতির সেকাল ও একাল’ বইয়ে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে হক সাহেব মন্ত্রিসভার অন্তর্ভুক্ত না করায় তিনি বিক্ষুব্ধ হয়ে আদমজী জুট মিলে তার অনুগত শ্রমিকদের দিয়ে অবাঙালি শ্রমিকদের সাথে দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টি করেন। এ হৃদয়বিদারক হত্যাযজ্ঞের ফলে মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক শেখ মুজিবকে তার মন্ত্রী নিযুক্ত করেন।’
এরপর ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিব দলের প্রবীণ নেতাদের আপত্তি উপেক্ষা করে প্রাদেশিক পরিষদে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করলে আওয়ামী লীগের ৩৫ জন কেএসপিতে যোগ দেন। ফলে ফজলুল হক টিকে যান, কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। কেএসপি নেতা বিডি হাবিবুল্লাহ যুক্তফ্রন্ট ভাঙার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে দায়ী করলেও শেখ আবদুল আজিজের ভাষ্যমতে, ‘এ সময় প্রচারিত হয়েছিল আওয়ামী লীগই যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যুক্তফ্রন্ট ভাঙার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক সাহেব। পরে শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগেই প্রকৃতপক্ষে যুক্তফ্রন্ট ভাঙা হয়।’
যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার পর কেএসপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্ব›দ্ব চরমে ওঠে। এর ফলে একের পর এক মন্ত্রিসভার পতন ঘটে এবং শেষমেশ ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে অধিবেশন কক্ষে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করা হয় এবং তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ওই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন।
এবার দেখা যাক, আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন জারির ঘটনার দিকে। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব ও পাশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হলে আইয়ুব খান প্রথমে বল প্রয়োগ করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেন এবং পরে যখন বুঝতে পারেন জনগণ তাকে আর চাইছে না, তখন ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেন এবং সঙ্কট উত্তরণের লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গোলটেবিল বৈঠক বর্জন করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত হয়ে নেতৃবৃন্দকে আওয়ামী লীগের ছয় দফা মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। অন্য নেতৃবৃন্দ শাসনতান্ত্রিক উপায়ে সঙ্কট সমাধানের ওপর জোর দিলেও শেখ মুজিব ছয় দফা মেনে নেয়ার দাবিতে অনড় থাকেন। ফলে বৈঠক ভণ্ডুল হয়ে যায়। ওই সময় পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, ‘আপনি ধীরচিত্তে বিবেচনা করুন। মওলানা ভাসানী কোনো ইস্যু নয়। ইস্যু হচ্ছে গণতন্ত্র বহাল করা। দীর্ঘ আন্দোলনের পর গণতন্ত্র হাসিলের মহা সুযোগ এসেছে। মিলিটারি ডিকটেটর থেকে এত সহজে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার কোনো নজির ইতিহাসে নেই। এ সুযোগ ব্যর্থ হতে দেবেন না।’ (জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির ভূমিকা : অধ্যাপক গোলাম, পৃষ্ঠা-৪৭)
অধ্যাপক গোলাম আযম আরো লেখেন, গোলটেবিল বৈঠক চলাকালে পিন্ডিতে জোর গুজব চলছিল যে, গভীর রাতে শেখ মুজিবের সাথে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান গোপনে সাক্ষাৎ করে তাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, সামরিক শাসনের কোনো আশঙ্কা নেই। বৈঠক থেকে উঠে বাইরে বিশেষ কারণে বের হতেই সাংবাদিকরা আমাকে ঘেরাও করে এ গুজবের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি এ বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করলে তারা নিরাশ হন।
পরবর্তী কিছু ঘটনায় ওই গুজব সত্য বলে আমার ধারণা হয়েছে। সেনাপতি হয়তো চেয়েছিলেন যে, গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হবার সুযোগ নিতে পারবেন। তার এ আশাই পূরণ হলো। সামরিক শাসন জারি হওয়ার পরপরই জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের তদানীন্তন সেক্রেটারি জেনারেল চৌধুরী রহমত ইলাহী ঢাকায় এসে শেখ সাহেবের সাথে দেখা করতে চাইলেন। ফোনে যোগাযোগ করে নিয়ে গেলাম। শেখ সাহেব চৌধুরী সাহেবের সাথে সালাম বিনিময় ও কোলাকুলি করার পরই আমাকে আক্ষেপের সাথে বললেন, ‘আযম সাহেব, যদি আমার সামান্য সন্দেহও হতো যে, মার্শাল ল হবে, তাহলে আমি ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতাম।’ আমি বললাম, ‘গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে সামরিক শাসন হবে বলে মাওলানা মওদূদী নিশ্চিতভাবেই আপনাকে বলেছিলেন।’ (পৃষ্ঠা-৪৯)
গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে দেশে মার্শাল ল জারি হবে- এ ব্যাপারে শেখ মুজিবের ধারণা ছিল না এ কথা ঠিক নয়। শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ড. কামাল হোসেন তার ‘মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল’ বইয়ে লিখেছেন, প্রকৃত ক্ষমতাধর হিসেবে সেনাবাহিনীর আবির্ভাব পরিষ্কার হয়ে গেলে ১২ মার্চ শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সাথেও পৃথক বৈঠক করেছিলেন। ওই বৈঠকে শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির ব্যাপারে বাঙালিরা যে গুরুত্বারোপ করে থাকে তা ইয়াহিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। ইয়াহিয়া সহনশীলতার ভান করেন এবং পরোক্ষ ইঙ্গিত দেন যে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে ছয় দফা দাবির বিরুদ্ধে ‘অস্ত্রের ভাষা’য় জবাব দেয়ার মনোভাব পোষণ করে আইয়ুব ও মোনেম খান ভুল করেছেন। আসলে ইয়াহিয়ার দিক থেকে ওই বৈঠক ছিল তার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশের প্রস্তুতির অংশ। তিনি চাইছিলেন আলোচনা ব্যর্থ হোক। আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়াটা তার ক্ষমতা গ্রহণের পরিস্থিতি তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল। (পৃষ্ঠা : ৩৭)
ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবের যোগাযোগ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালেই শুরু হয়েছিল। ঢাকার জিওসি জেনারেল মুজাফফরউদ্দিন ছিলেন সেই যোগাযোগের মাধ্যম। ড. কামাল হোসেন তার ওই বইয়ে আরো লেখেন, ‘আন্দোলন যতই জোরালো এবং আরো জোরালো হয়ে উঠছিল, পুলিশ এবং গভর্নর মোনেম খান ও তার প্রশাসন ততই পর্দ অন্তরালে পশ্চাৎপসরণ করছিল। ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে যিনি মঞ্চে আবির্ভূত হতে শুরু করেছিলেন, তিনি জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) জেনারেল মুজাফফরউদ্দিন। বোঝা যাচ্ছিল- সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন-চিফ জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার জিওসির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির ব্যাপারে সরাসরি ধারণা পাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানুয়ারিতে মানিক মিয়ার সাথে মুজাফফরউদ্দিনের একটি বৈঠকের কথা আমার মনে পড়ছে। বৈঠকে মুজাফফরউদ্দিন মানিক মিয়াকে এরকম ধারণা দেন যে, ইয়াহিয়া খান পরিস্থিতির ব্যাপারে মানিক মিয়ার মূল্যায়ন জানতে আগ্রহী এবং তিনি (ইয়াহিয়া) বিশ্বাসও করেন যে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার উদ্যোগ নেয়া উচিত। ইয়াহিয়ার জন্য কোনো বক্তব্য থাকলে তা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও তিনি (মুজাফফরউদ্দিন) নেন। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছিল যে, কমান্ডার-ইন-চিফ ইয়াহিয়া ইতোমধ্যেই এমন কিছু শুরু করেছেন, যা তার স্বাধীন ভূমিকার পরিচায়ক। যাহোক, বৈঠকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহারের গুরুত্ব সম্পর্কে জেনারেল মুজাফফরকে পরিষ্কার ধারণা দিয়ে বোঝানো হয় যে, কেবল শেখ মুজিবের মুক্তির পরই রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য আলোচনা শুরু হতে পারে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মুজাফফর জানালেন, তাকে যেসব বিষয়ে বলা হয়েছে তা তিনি ইয়াহিয়াকে জানিয়েছেন এবং ইয়াহিয়া ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে কোনো আইনগত উপায় খুঁজে পাওয়া গেলে তা বিবেচনা করা হবে।’ (পৃষ্ঠা : ২৬)
এসব বিষয় বিবেচনায় কেউ যদি মনে করেন শেখ মুজিব ছয় দফার ব্যাপারে অনড় থাকার মাধ্যমে গোলটেবিল ভণ্ডুল করে ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য সবুজ সঙ্কেত দিয়ে এসেছিলেন তাহলে তা কি খুব অযৌক্তিক হবে?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা