২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাষ্ট্র সংস্কারভাবনা : কিছু কথা

- প্রতীকী ছবি

একজন প্রবীণ রাজনীতিক এক আলোচনায় উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি শুরুতেই ভুল লাইনে উঠে গেছে। অর্থাৎ ১৯৭২ সালে স্বাধীন রাষ্ট্রটি পথ চলার শুরু থেকেই ভুল পথে হেঁটেছে। আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান তার ওই বক্তব্যের যথার্থতা প্রতিপাদন করেছে। ১৯৭২ থেকে ২০২৪ এ সময়ের প্রবাহ আমাদের এ রাষ্ট্রটিকে এমন এক সঙ্কটে নিপতিত করেছে যে, পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ছাড়া একে আর এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সংস্কার করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে এ এমন এক আবর্জনার স্ত‚প যে কোনটা রেখে কোনটা সংস্কার করা প্রয়োজন হিসাব মেলানোই কঠিন। গত ৫৩ বছরে আমরা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারতাম যদি পরিচালকরা সত্য ও ন্যায়ের রাস্তায় চলতেন এবং যা কিছু ক্ষয় তা ক্রমান্বয়ে মেরামত করতেন। তা না করে তারা আরো কুৎসিত আচরণ করেছেন, হিংসা, জিঘাংসা জ্যামিতিক হারে বাড়িয়েছেন। সমাজে ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজনের খাদ গভীরতর করেছেন। তাই আজ দাবি উঠেছে পূর্ণমাত্রায় রাষ্ট্র সংস্কারের।

সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে ১০টি কমিশন গঠন হয়েছে। এর একটি সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত। এটিই প্রধানত রাষ্ট্রের মূল কাঠামোর রূপরেখা দেবে। বাকিগুলো রাষ্ট্রের শাখা, প্রশাখা, উপশাখা সংস্কারবিষয়ক। সেগুলোকেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। অনেকে মনে করছেন আরো কিছু বিষয়ে কমিশন গঠনের প্রয়োজন হবে।

বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রের একটি মূল কাঠামো নির্ধারণ করা আছে। তা হলো নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা এবং বিচার বিভাগ। এ লেখার প্রতিপাদ্য আইনসভা এবং নির্বাহী ক্ষমতা সম্পর্কিত। রাষ্ট্রপতি কার্যত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কিছুই করতে পারেন না। বর্তমান সংবিধানের চতুর্থভাগে নির্বাহী বিভাগের রূপরেখা, ক্ষমতা কাঠামো লিপিবদ্ধ আছে, যা অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত। ফলে প্রকৃত অর্থে কার্যকরী একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করতে হলে আমাদের ঐতিহাসিক জ্ঞানের আলোকে ওয়েস্ট মিনিস্টার পদ্ধতির বাইরে এসে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা, কর্মবিভাগের মধ্যে একটি ভারসাম্যমূলক ক্ষমতা বিভাজন করতে হবে। বাংলাদেশে গত ৫৩ বছরের ইতিহাসে ক্ষমতা প্রকটভাবে কেন্দ্রীভ‚ত হয়েছে, একনায়কতান্ত্রিকতা সৃষ্টি হয়েছে, যা চূড়ান্তরূপে ফ্যাসিবাদ নামে আখ্যায়িত।

এখন সময় হয়েছে নতুনভাবে নীতি-পদ্ধতি ও কৌশল নির্ধারণ, যাতে এ প্রবণতা রোধ করা যায়। এ জন্য আমাদের আইনসভা এবং নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা বণ্টনের মাধ্যমে একটি চতুর্ভুজ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। কাঠামোটা নিম্নরূপ হতে পারে :

যুক্তরাষ্ট্রে যেমন প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ আছে বাংলাদেশেও তেমনই প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যবৃন্দ সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে। সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদের (সংসদ সদস্যদের) মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক মন্ত্রী প্রতিনিধি পরিষদের সর্বদলীয় সদস্যের অবাধ ভোটে নির্বাচিত হবেন। দুই কক্ষবিশিষ্ট আইন সভা গঠন করতে হবে, যথা : ১. গণপরিষদ/প্রতিনিধি পরিষদ (নিম্ন কক্ষ) এবং ২. সিনেট (উচ্চ কক্ষ)। এ দু’টি মিলে হবে জাতীয় পরিষদ। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের মাধ্যমে সিনেটে (উচ্চ কক্ষ) আসন পাবেন। প্রাপ্ত আসন সংখ্যার বিপরীতে কমিউনিটি সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন, অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের সংগঠন এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব দানকারী তুলনামূলকভাবে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে দ্বিগুণ সংখ্যক ব্যক্তিকে সিনেটর পদে মনোনয়ন দেবেন। তাদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি পরিষদের ভোটে প্রতিটি দল থেকে নির্ধারিত সংখ্যক সিনেটর নির্বাচিত হবেন। প্রথম সিনেট শুধুমাত্র প্রতিনিধি পরিষদের অবাধ ভোটে নির্বাচিত হবেন। দ্বিতীয় সিনেট থেকে পূর্ববর্তী সিনেট এবং নতুন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা সিনেটর নির্বাচন করবেন। দ্বিতীয়বার থেকে সব দলীয় প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য এবং সিনেট সদস্য যৌথভাবে অবাধ ভোটে মন্ত্রী পরিষদ এবং পরবর্তী সিনেট নির্বাচন করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল প্রয়োজনীয় সংখ্যক মন্ত্রীর জন্য তার দলের মধ্যে থেকে সাধারণ এবং কারিগরি শ্রেণীতে যতজন মন্ত্রী লাগবে তার দেড়গুণ প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন। যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাধিক্যের হিসাবে অন্যান্য মন্ত্রীরা নির্বাচিত হবেন। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনাক্রমে অন্য মন্ত্রীদের দফতর বণ্টন করবেন।

এরূপ পরিস্থিতি কখনো এমন ঘটনাও ঘটতে পারে যে, যে দল থেকে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, সেটির পরিবর্তে অন্য একটি দল জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল। কাজেই প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভা নির্বাচিত হবে দ্বিতীয় দল থেকে। এ ক্ষেত্রে অনেকেই বলবেন, তাহলে তো রাষ্ট্র চলবে না, অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে অচলবস্থা সৃষ্টি হলেও পর্যায়ক্রমে তারা সমঝোতায় উপনীত হবে। যেমনটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেসের মধ্যে হয়। এমন ক্ষেত্রে প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট মধ্যস্থতা করতে পারবে। প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার যৌক্তিক বিভাজন হলে উভয়েই যার যার অধিক্ষেত্রে ন্যায় এবং সততার সাথে দায়িত্ব পালনে বাধ্য হবে। না হলে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করবে নতুবা প্রধানমন্ত্রী তার দলবল নিয়ে প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করবে। এখন যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরকে জানের শত্রু মনে করে সে অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ায় বহুমুখী কাঠামো নির্মাণ করতে হবে। যাতে একটি পদ্ধতি নিষ্ক্রিয় বা অকার্যকর হলে অন্য একটি কাঠামো সক্রিয় করা যায়। কেননা যদি ভোটদানের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে এবং রাজনৈতিক দলগুলো অযৌক্তিক আচরণ করে জনগণ তাদেরকে ভোটের মাঠে জবাব দিয়ে দেবে। রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবৃন্দ, প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেট কারো মেয়াদই চার বছরের বেশি হবে না। রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি ও প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচনের তিন মাসের মধ্যে সিনেট নির্বাচন করতে হবে। কোনো ব্যক্তিই ধারাবাহিকভাবে দু’বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না এবং জীবনে সর্বমোট দু’বারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না। জাতীয় নির্বাচনকালে সিনেট নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করবে।

রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা একই দলীয় হোক বা ভিন্ন ভিন্ন দলীয় হোক রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে রাষ্ট্রীয় কার্যের সুস্পষ্ট বিভাজন থাকতে হবে। পাশাপাশি তাদের উভয় কাজের সমন্বয়ের বা সমন্বিত কার্যাবলির জন্য একটি স্পষ্ট নীতিমালা বা কার্য বিধিমালা থাকতে হবে। তাদের কাজ মোটা দাগে দুই ভাগ করা যায়। যথা ১. রাষ্ট্রের স্থায়ী কাঠামোগুলো সুচারুভাবে পরিচালনা যেমনÑ রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো অক্ষুণ্ন রাখা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ, প্রতিরক্ষা কার্যবিভাগ, জন কর্মবিভাগ, পররাষ্ট্র সম্পর্ক ইত্যাদি যা রাষ্ট্রপতি-উপরাষ্ট্রপতির নিকট ন্যস্ত থাকবে। ২. রাষ্ট্রের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা যেমন- প্রয়োজনীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন তদারকিকরণ, মূল্যায়ন, দুর্যোগ মোকাবেলা ইত্যাদি কার্যাবলি প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নিকট ন্যস্ত থাকবে।

কার্যনির্বাহের ক্ষেত্রে মন্ত্রীগণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনামাফিক বা নীতিমালা অনুসারে কাজ হচ্ছে কি না তা মূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বা কার্যসম্পাদনের দায়িত্বের নির্বাহী ক্ষমতা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের (আমলাতন্ত্রের) কাছে ন্যস্ত করতে হবে। কর্ম সম্পাদনের সুস্পষ্ট নীতিমালা বা কার্য বিধিমালা থাকতে হবে। মন্ত্রী আপিল অধিক্ষেত্রে নির্বাহী কাজের ভুল সংশোধন, আইন, নীতিমালা বা পরিকল্পনা পরিপন্থী কাজ বাতিল করতে পারবেন। এ ধরনের কাজ পুনরায় মন্ত্রিপরিষদে পর্যালোচনা রিভিউ করা হবে। নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত আমলাতন্ত্র কোনো ভুল, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি করলে তাদের শাস্তির বিধান ইত্যাদি দায়িত্ব গুরুত্ব অনুসারে মন্ত্রী/মন্ত্রিপরিষদের নিকট ন্যস্ত থাকবে। মন্ত্রিপরিষদের সুপারিশের আলোকে রাষ্ট্রপতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ক্ষমতা অতি কেন্দ্রীভূত। ফলাফল অস্বচ্ছতা, পক্ষপাতিত্ব। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে যৌথভাবে সংসদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। বর্তমান পদ্ধতিতে নির্ধারিত সিলিংয়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পনামন্ত্রী অবশিষ্ট প্রকল্পের জন্য একনেক সভায় প্রকল্প অনুমোদন হয়। একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তাই হয়।

প্রকল্প গ্রহণে পার্লামেন্ট ও সিনেটের অনুমোদন গ্রহণের বিধান করা হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়তে পারে। তাহলে আইন পরিষদগুলোর ক্ষমতায়ন হবে। ক্ষমতা বিভাজিত হওয়ায় প্রকল্পের লুটপাটের লাগাম টানা যাবে।

গত ৩৫ বছরে আমাদের গণতান্ত্রিক কার্যকলাপের পুঞ্জীভূত ফলাফল হলো চরম ফ্যাসিবাদের উত্থান। আমরা যদি এ অভিজ্ঞতা আবার ভুলে যাই এবং পদ্ধতি জটিল হলে রাষ্ট্র চলবে না এ আশঙ্কায় পদ্ধতির মধ্যে ছিদ্র রেখে দিই তাহলে আবার পরিণতি ওই বেহুলা-লক্ষিনদরের বাসর ঘরের মতোই হবে।

পক্ষত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোটদান সংক্রান্ত বর্তমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিধান বিলুপ্ত করতে হবে। আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কার কী ভূমিকা হবে সে বিষয়েও একটি কার্যবিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে। কণ্ঠভোট পদ্ধতি রহিত করতে হবে। ইনক্রিমেন্টাল ভোটিং পদ্ধতিতে আইন পাশের পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাহলে দলীয় সরকারের প্রয়োজনমাফিক কালো আইন প্রণয়ন করার শঙ্কা কমবে।

লেখক : কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement