২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ

-

কোনো একটি জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার যে গড়পড়তা ধরন, তাকে বলা হয় জলবায়ু। আবহাওয়ার সেই চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়ার নাম জলবায়ু পরিবর্তন। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী ক্রমেই উষ্ণ হচ্ছে, আবহাওয়া আরো চরম হচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ কোনো না কোনোভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার ভুক্তভোগী। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে গ্রিনহাউজ ইফেক্ট। শক্তি উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেনসহ নানা ধরনের ক্ষতিকারক গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এসব গ্যাস ক্রমাগত বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে চলছে।

একইভাবে বাংলাদেশে গত দুই দশক ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুস্পষ্ট। বিশেষ করে তীব্র তাপদাহ, সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন কিংবা বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এসব চ্যালেঞ্জগু মোকাবেলার জন্য একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।

নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তির অন্যতম সুবিধা হলো বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকারক গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ক্ষমতা। জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস) ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিপরীতে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট, হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্ট, বায়ুকলের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্লিন এনার্জি উৎপাদন করা সম্ভব। যেখানে বস্তুকণা সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো বায়ুদূষক ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হবে না। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৯১.৩ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে, ১.৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদিত হয়। অবশিষ্ট ৭.৩ শতাংশ বিদ্যুৎ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় যার মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ১.৯ শতাংশ। এর ফলে দেশের মোট গ্রিনহাউজ গ্যাসের বেশির ভাগ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে নিঃসরিত হয়ে থাকে।

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে হলে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি নয়; বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ- টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনায় ডিজেলের পরিবর্তে সোলার সেচ পাম্পের মাধ্যমে চাষাবাদ করার প্রক্রিয়াকে আরো উৎসাহিত করা। ডিজেলের পরিবর্তে সোলার সেচ পাম্প ব্যবহার করে চাষাবাদ করার মাধ্যমে এটি শুধু কার্বন নিঃসরণই কম হবে না, একই সাথে ভূগর্ভের পানিসম্পদ সংরক্ষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করবে। এ ছাড়া ক্লিন এনার্জি ব্যবহারের অন্যতম সুবিধা হলো এটি কার্বন নিঃসরণ কমানোর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। এত এত সুবিধা থাকার পরও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আমাদের বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ নেই। তবে বিগত সময়ে বেশ কয়েকটি ভালো উদ্যোগ দেখা গেলেও যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে সেগুলো ফলপ্রসূ হয়নি। যেমন- ২০১০ সালে গ্রিড সংযোগ পাওয়ার শর্ত হিসেবে গৃহস্থালি, শিল্প ও বাণিজ্যিক স্থাপনায় ছাদে সৌরশক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা বসানো বাধ্যতামূলক হয়েছিল। দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তিতে নবায়নযোগ্য অংশগ্রহণ বাড়াতেই নেয়া হয় এ পদক্ষেপ। কিন্তু সৌর প্যানেলগুলোতে নিম্নমানের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করা এবং জনসচেতনতার অভাবে কার্যক্রমটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ছাদের সৌর ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে দেশে একটি সন্তোষজনক মাত্রায় নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।

এসব দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্ব দেয়া জরুরি। বাস্তবিক অর্থে বর্তমান পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তবেই আমরা জলবায়ু বিপর্যয় রোধ করে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারব।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ


আরো সংবাদ



premium cement