২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ছাত্রলীগ এক কলঙ্কিত নাম

ছাত্রলীগ - ফাইল ছবি

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হাজারো অভিযোগে অভিযুক্ত সংগঠনটি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার ও আতঙ্ক ছড়ানোর লক্ষ্যে নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সহিংসতা, পতিতাবৃত্তি এবং নিজের মতো অন্যের ওপর চাপাতে গিয়ে হত্যার মতো নৃশংসতাও চালিয়েছে বারবার।

মূলত খুন, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, টেন্ডারবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, অগ্নিসংযোগ, হল দখল, বাকি খাওয়াসহ নানাবিদ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে অবশেষে দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি সংগঠনের নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
আজ এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত যে ছাত্রলীগ হলো সন্ত্রাস ও সহিংসতার নামান্তর। অনেকে বলেন, ছাত্রলীগের একটি সোনালি অতীত আছে। কী সেই সোনালি অতীত? তাদের অতীতের কিছু খণ্ডাংশ দেখে নেয়া যাক :

১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রলীগের চেহারা উন্মোচিত হতে থাকে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা ছাত্রলীগের আচরণ ক্ষুধার্ত হায়েনার রূপ ধারণ করে। তারা কেবল প্রতিপক্ষকে নির্যাতন ও হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছে নিজ দলের কর্মীদের ওপরও। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী হত্যার পাশাপাশি ছাত্রলীগের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী হত্যার শিকার হয়, যার বেশির ভাগ নিজ দলের অন্তঃকোন্দলে মারা যায়।

৪ এপ্রিল ১৯৭৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের মাঠে সাতজন দলীয় কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে মুজিববাদী ছাত্রলীগের নোংরা রাজনীতির বীভৎস চেহারা ফুটে ওঠে। এরপর ১৯৭৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮১ জন, রাবিতে ৩০ জন, চবিতে ১০ জন, জাবিতে পাঁচজন, ইবিতে চারজন, সারা দেশে পাঁচ শতাধিক হত্যার শিকার হয় ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের হাতে। (এপ্রিল ২০২১, ইনকিলাব)

দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগেই ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবেও ছিল ছাত্রলীগের সক্রিয় উপস্থিতি। ঢাকার রাজপথসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের সাথে সন্ত্রাসে নামে ছাত্রলীগ। ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হলে ছাত্রলীগের পুরনো চরিত্র আবার দৃশ্যমান হতে থাকে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের হাতে খুন হয়েছে ৩৩ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের হাতে চলে গেছে ১২৯ জনের জীবন। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা ছাড়াই প্রায় পাঁচ শতাধিক জীবন কেড়ে নিয়েছে দানবীয় ছাত্র সংগঠনটি।

ছাত্রলীগের হাত রক্তাক্ত, তাদের রাজনীতি আদতে গুম ও খুনের রাজনীতি। তাদের নোংরা লালসার শিকার হয়ে খুনের তালিকা এত বেশি লম্বা যা উল্লেখ করা সম্ভব নয়। নারকীয় এই তাণ্ডবের এবং বীভৎস হিংস্রতার শিকার হয়ে জীবন বিলিয়ে দেন খুলনা বিএল কলেজের আবুল কাশেম পাঠান, আব্দুল হালিম। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের আসলাম, শরিফুজ্জামান নোমানী। বুয়েটের আবরার ফাহাদ, ঢাবির আবু বকর প্রমুখ। তাদের বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি বিশ^জিত নামক হিন্দু শ্রমিকও। প্রকাশ্য রাজপথে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ধর্ষণ ও নারী কেলেঙ্কারিতেও চ্যাম্পিয়ন ছাত্রলীগ
নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের আরেক পরিচয় ধর্ষকলীগ হিসেবেও। সাল ১৯৯৮। দুর্ধর্ষ ছাত্রলীগ ক্যাডার জসিম উদ্দীন মানিক। হঠাৎ এক দিন বন্ধুদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে। কৌতূহলী বন্ধুরা জানতে চায় কী ব্যাপার সেঞ্চুরিটা পূর্ণ করলা নাকি? লালসার জিহ্বা বের করে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠল, তোরা বন্ধুরা সব কিছু অল্পতেই বুঝতে পারছ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০তম ছাত্রীকে ধর্ষণ করে সেঞ্চুরি উৎসব করছি! রাস্তার কুকুরকেও হার মানিয়েছে ধর্ষক মানিক। (আগস্ট-’৯৮, ইত্তেফাক)
বরিশালের গৌরনদীর সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ডালিয়াকে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা লঞ্চ থেকে অপহরণ করে রাতভর পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন চালায়। পবিত্র রমজান মাসে ওই বর্বরতা চালাতে একটুও হৃদয় কাঁপেনি হায়েনাদের। (১৮ জানুয়ারি-’৯৭ ইনকিলাব)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করতে আসে মডেলকন্যা বাঁধন। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের লোলুপ দৃষ্টি এড়াতে পারেনি সে। সেই রাতে তাকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টায় নিন্দার ঝড় ওঠে দেশব্যাপী। (৩১ ডিসে-’৯৯ ইনকিলাব)
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বর থেকে এক তরুণীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে ধর্ষণ করে সূর্যসেন হলের চার ছাত্রলীগ ক্যাডার। (৩০ জুন-২০০০ প্রথম আলো)

চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাইয়েও পারদর্শী ছাত্রলীগ
খুলনা সিটি করপোরেশনের গুদাম থেকে সরকারি মালামাল ট্রাক ভর্তি করে চুরি করতে গিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আনোয়ার হোসেন পুলিশের হাতে আটক হয়। (১৮ জুলাই-’৯৭ বাংলার বাণী)

চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানায় একটি হিন্দু বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র পাঁচ ক্যাডার। (৯ জানুয়ারি-’৯৭ ইনকিলাব)
সিলেট এমসি কলেজে স্বামীর সাথে বেড়াতে আসা গৃহবধূকে গণধর্ষণ করে ছাত্রলীগ। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় আট ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন। (২৬ সেপ্টে-২০২০ যুগান্তর)

অগ্নিসংযোগেও ছাত্রলীগ সিদ্ধহস্ত
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের হোস্টেলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে শতবর্ষের ঐতিহ্য এ ছাত্রাবাসটি। ছাত্রলীগ প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে বিচার বিভাগীয় কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। ২৯ জনকে চিহ্নিত করে কমিটি, যারা সবাই ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মী। (১৮ নভেম্বর-২০১৭, প্রথম আলো)
মাগুরা শহরের পার নান্দুয়ালি বাস টার্মিনালে দাঁড়ানো বাসে আগুন লাগাতে হাতেনাতে ধরা পড়ে ছাত্রলীগের তিন নেতা। (১ জানুয়ারি-২০১৪, প্রথম আলো)

ছাত্রলীগের অপরাধ জগৎ এত বেশি বিস্তৃত যা লিখে শেষ করা দুরূহ। মানবতার বিরুদ্ধে এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সাথে ছাত্রলীগের সম্পর্ক নেই। এই মানবতাবিরোধী, সন্ত্রাসী সংগঠন নিষিদ্ধ করা ছিল সময়ের অনিবার্য দাবি।

লেখক : এমফিল গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement